Picsart 22 07 29 01 20 57 660

কম কথা বলা শিশুদের ক্ষেত্রে অভিভাবকের করণীয়

আমার ছেলে কয় না কথা হয়েছে ডিজিটাল বয়, মোবাইল-ট্যাব-টিভি নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত রয়!
আমার ছেলে কয় না কথা থাকে বুয়ার কাছে, সিরিয়ালেই কাটায় খালি তার সময় আছে?
আমার ছেলে কয় না কথা বাসায় নাই লোক,
সংসারেতে এতো কাজ রাখবো ক’দিকে চোখ?
আমার ছেলে কয় যে কথা ডোরেমনের ভাষায়, ডাক্তার আপা কিছু করেন, এসেছি বড় আশায়!
কি কথা বলবে শিশু:
স্বাভাবিক নিয়মে একটা বাচ্চা জন্মের পর থেকে ৪ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু হাসি বা কান্না দিয়েই তার ভাব প্রকাশ করবে। এরপর বু বু করে বাবলিং সাউন্ড করবে। আস্তে আস্তে দা দা, বা বা, মা মা করে শব্দ করবে ৭-৮মাসে, এক বছরে দাদা,মামা, চাচা, এরকম দুই অক্ষরের শব্দ বলতে শিখবে। ধীরে ধীরে তার শব্দ ভান্ডার বাড়বে। দুই বছরে “আমি খাবো, এটা দাও, বাবা যাবো” এরকম দুই শব্দের এবং পরবর্তীতে “আমি ভাত খাবো” এরকম তিন শব্দের বাক্য বলতে শিখবে তিনবছরের মধ্যে।
কখন এর ব্যতিক্রম হয়:
ছেলেদের চেয়ে মেয়ে বাচ্চারা সাধারণত তাড়াতাড়ি কথা বলা শেখে। কোন কোন বাচ্চা দেড় বছর বয়সেই পটপট করে সব কথা বলা শিখে যায়। আবার কোন বাচ্চা দেখা যায় দু বছরের একটা দুটোর বেশী শব্দ বলতে পারে না। এটা বংশগত কারনেও হতে পারে, যেমন, পরিবারে কেউ যদি ছোটবেলায় দেরীতে কথা বলে থাকে, অনেকসময় সেই ফ্যামিলির বাচ্চারা কথা বলতে দেরী করে।
আবার পরিবেশগত কারনেও বাচ্চা কথা বলতে দেরী করে। এটা বেশী হয় একক পরিবারগুলোতে। বাবামা দুজনেই হয়তো চাকুরী করেন। বাসায় বাচ্চার সাথে কথা বলার বা খেলার মত আর কোন বাচ্চা নেই। কাজের লোক থাকলেও, নিজের কাজে সে ব্যস্ত বা টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখছে। অথবা বাচ্চাকে ব্যস্ত রাখার জন্য হয়ত হাতে মোবাইল দিয়ে গান বা টিভিতে কার্টুন ছেড়ে দিয়ে রাখে।
কিংবা, মা হয়তো গৃহিণী, বাসায় হাজারটা কাজের ব্যস্ততায় বাচ্চার দিকে নজর দিতে পারছেন না প্রয়োজনমত। বাচ্চা সময় কাটানোর জন্য একা একা খেলনা দিয়ে খেলে। কারো বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়না বা আশেপাশে সমবয়সী কোন বাচ্চা না থাকায় খেলার সঙ্গী পায় না, এমনটাও দেখা যায়।
এর বাইরে বাচ্চার জন্মগত কানে না শোনার কারনে, জন্মের সময় দেরী করে কাঁদার কারনে, মাথা, জিহ্বা অথবা হরমোনজনিত জন্মগত ত্রুটির কারনেও বাচ্চা দেরীতে কথা বলা বা কথা একদমই নাও বলতে পারে।
তবে শুধু কথা না বলতে পারাকেই অটিজম বলা ঠিক নয়। অটিজমে কথা না বলার সাথে, চোখে চোখ রেখে কথা না বলা ( eye contact), একা একা একই খেলনা দিয়ে একইভাবে খেলা, আশেপাশে কি হচ্ছে তাতে মনযোগী না হওয়াসহ আরো অনেক লক্ষণ থাকে যা অন্য কোনদিন আলাপ করবো।
কথা বলানোর উপায় কি :
ট্যাব, টিভি, কম্পিউটার বাসা থেকে সরান,
গল্প, ছবি, ছড়ার বই এনে ওদের হাতে ধরান।
বলতে হবে প্রচুর কথা শব্দ ভান্ডার বাড়ান,
হিন্দি ছবি, সিরিয়াল আর কার্টুন দেখা কমান!
নিতে হবে খোলা মাঠে সব বাবুদের সাথে,
মিশলে বাবু সবার সাথে ফল পাবেন হাতেনাতে। ঝগড়া-বিবাদ ভুলে গিয়ে প্রচুর সময় দিলে, ফুটবে মুখে ভাষা ওদের বলবে সবাই মিলে।
বাংলাদেশের বাচ্চারা কথা শুরু করে বাংলায়, ইন্ডিয়ায় হিন্দিতে, আমেরিকায় ইংলিশে….. এর কারন কি?
জন্মের পর একটা বাচ্চা যে শব্দ বা ভাষা শুনবে সেটাই বলার চেষ্টা করবে। আপনি হিন্দি সিরিয়াল দেখতে দেখতে হিন্দি শিখে ফেলেন না? সেরকম আরকি। আর কথা বলার সুযোগ না পেলে, সোজা বাংলায়, আলাপচারিতার সুযোগ ছাড়া কি কথা বের হয়?
একটা বাচ্চা যখন টিভি, ট্যাব, কম্পিউটারে কোন গান, ছড়া বা কার্টুন দেখে তখন সে শুধু কান দিয়ে শুনে, কিন্তু বাক্য বিনিময় বা পাল্টা তার কথা বলা দরকার হয় না । যার ফলে বাচ্চা কথা তো বলেই না বরং বিজাতীয় ভাষার কার্টুন, গান, ছবি দেখে সে না বাংলা না হিন্দি না ইংলিশ, কোন ভাষাই ঠিকমতো শিখতে পারে না। বাচ্চা খিচুড়ি ভাষায় কথা বলা শুরু করে।
কাজেই বাচ্চা কথা বলাতে হলে কিছু নিয়ম পালন করতে হবে
১. বাচ্চার সাথে প্রচুর কথা বলতে হবে। সেটা ছড়া হোক বা গান, ভালো হয় ছবির বই দেখিয়ে একই শব্দ দিয়ে তিন চার রকমের বাক্য বললে। যেমন, বল নিয়ে তিন চারটা বাক্য বললে “বল” শব্দটা বাচ্চা মাথায় ঢুকে গেলো।
২. কখনই টিভি, ট্যাব, কম্পিউটার দেখিয়ে বাচ্চাকে খাওয়াবেন না বা দীর্ঘসময় ধরে দেখতে দিবেন না। তাতে বাচ্চার মনযোগ নষ্ট হয় খাবারে, পর্যাপ্ত পুষ্টি ও বুদ্ধি হয় না।
৩. বাচ্চার সাথে যখন কথা বলবেন, এমন বাক্য কখনই বলবেন না, যার উত্তর হ্যা বা না দিয়ে দেয়া যায়। যেমন, “তুমি কি ভাত খাবে? ” না বলে, বলতে হবে
” তুমি কি খেতে চাও? “
৪. বাচ্চা যদি ইশারায় কিছু চায় তাহলে তা না শোনা বা না বুঝার ভান করবেন। মুখে কথা বলাকে উৎসাহিত করবেন।
৫. বাচ্চাকে তার আশেপাশের ব্যবহৃত জিনিস গুলোর নাম ও কাজ শেখাবেন। ছবির বই দিয়ে ফুল, ফল, মাছ, পশু প্রভৃতির নাম শেখাবেন তথা তার শব্দ ভান্ডার বাড়াবেন। কখনও কিছু জানতে চাইলে তাকে নিরুৎসাহিত করবেন না।
৬. বাচ্চাকে অবশ্যই অন্য বাচ্চাদের সাথে মিশতে দিবেন। আশপাশের বাচ্চাদের সাথে মিশতে দিলে বাচ্চার যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কথা বলা বৃদ্ধি পাবে। বাচ্চা আছে এমন বাসা বা পার্কে খেলতে নিয়ে যাবেন মাঝেমধ্যে।
৭. এরপরও কথা বলা নিয়ে সমস্যা হলে, ডাক্তারের পরামর্শ নিন, বাচ্চার কান পরীক্ষা করে দেখতে হবে সে কানে শোনে কিনা বা অন্য কোন ত্রুটি আছে কিনা। যে কোন সরকারি মেডিকেল কলেজ বা টার্সিয়ারি হাসপাতালে শিশুবিকাশ কেন্দ্র বা নিউরোলজি বিভাগ আছে। বাচ্চাকে স্পিচ থেরাপি দেয়ার জন্য, যেকোন শিশুবিকাশ কেন্দ্রে নিয়ে যেতে পারেন।
কাজেই, বাচ্চা কথা না বললে অবশ্যই তা গুরুত্ব সহকারে সমাধানে উদ্যোগী হোন। কথা না বলার কারনটি অনুসন্ধান করুন।

পরামর্শক: ডাঃ লুনা পারভীন
আবাসিক মেডিকেল অফিসার
বহির্বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।