কুমিল্লা…নামটি শুনলেই মাথায় আসে দেশ বিখ্যাত রসমালাই আর খাদি কাপড়ের আতুরঘর হিসেবে পরিচিত একটি রুপবৈচিত্রে ঘেরা অঞ্চল। কুমিল্লা জেলা আদি বাংলার সমতট ও ত্রিপুরা রাজ্যের সময়কাল থেকেই একটি বিশেষ এলাকা হিসেবে বিবেচিত। এ অঞ্চলের নাম করনের পেছনে বেশ কিছু প্রচলিত মতবাদ থাকলেও চীনা পরিব্রাজক ওয়াং চোয়াঙ তার সমতট রাজ্য পরিভ্রমণের বৃত্তান্তে কিয়া-মল-ঙ্কিয়া নামক যে স্থানের বিবরণ বর্ণনা করেছেন সেটি থেকে কমলাঙ্ক বা কুমিল্লা নামকরণ করা হয়েছে। অতীতে এটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলো যা ১৯৬০ সালে এসে সদর দপ্তরের নাম অনুসারে নামকরন হয় কুমিল্লা। পরবর্তীতে স্বাধীনতা লাভের পর কুমিল্লা একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
অবস্থানঃ
রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৯৭ কিলোমিটার দক্ষিন পূর্বে অবস্থিত একটি সমৃদ্ধ জেলা অঞ্চল কুমিল্লা। এ জেলা অঞ্চলের মোট আয়তন ৩০৮৭.৩৩ বর্গকিলোমিটার এবং ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা ৬২ লাখ ১২ হাজারেরো অধিক। কুমিল্লা জেলার পূর্ব দিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পশ্চিমে মেঘনা নদী, চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলা। উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নারায়নগঞ্জ জেলা এবং মেঘনা নদী। দক্ষিণে ফেনী ও নোয়াখালী জেলার অবস্থান।
বর্তমানে কুমিল্লা জেলা পুলিশ ৮টি পৌরসভায়, ১১ টি সংসদীয় আসনে মোট ১৭টি উপজেলা, ১৯২টি ইউনিয়ন, ৩৬৮৭টি গ্রাম সহ ১৮টি থানায় তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। থানা সমূহ হলোঃ কোতোয়ালী মডেল থানা, ব্রাহ্মণপাড়া, চান্দিনা, চৌদ্দগ্রাম, তিতাস, দাউদকান্দি মডেল থানা, দেবিদ্বার, নাঙ্গলকোট, বরুড়া, বুড়িচং, মনোহরগঞ্জ, বাঙ্গরাবাজার, মুরাদনগর, মেঘনা, লাকসাম, লালমাই,
সদর দক্ষিণ মডেল থানা এবং হোমনা থানা।
ভোরের আলো ফুটে ওঠার সাথে সাথেই মেঘনা নদীর অববাহিকায় শ্যামল বাংলার অপরুপ সাজে সজ্জিত কুমিল্লার মেঠোপথ, ফসলের মাঠ, নদীতীরে জীবিকার তাগিদে ছুটে যায় মানুষ। গ্রামের পাশাপাশি শহরেও শুরু হয় কর্মজীবী মানুষের আনাগোনা। অফিস-আদালত, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মানুষের ছুটে চলা সব মিলিয়ে ফুটে উঠতে থাকে ব্যাস্ত নগরীর কোলাহলপূর্ণ জনজীবন…
মুক্তিযুদ্ধঃ
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ২নং সেক্টরের আওতাধীন ছিল কুমিল্লা জেলা। ২৫শে মার্চ রাতের গনহত্যার পর পরই পাক হানাদারেরা কুমিল্লায় তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে এবং নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। তাদের ঠেকাতে পাকসেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে জড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা। ব্রাহ্মণপাড়া, চান্দলা, দেবীদ্বার, দাউদকান্দি, হোমনা, মনোহরগঞ্জ ও নাঙ্গলকোট সহ প্রভৃতি স্থানে সংগঠিত যুদ্ধে প্রান বিসর্জন দেয় শত শত বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তাদের আত্মত্যাগের স্মৃতি বহন করছে জেলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত বেশ কয়েকটি বধ্যভূমি, ১২টি গণকবর, ৪টি স্মৃতিস্তম্ভ ও ২টি মঠ সহ উপজেলাভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন।
শিক্ষাঃ
শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাবরই অন্যান্য জেলার তুলনায় এগিয়ে যাচ্ছে কুমিল্লা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে এ অঞ্চলের শিক্ষার হার। ২০১১ সালের শিক্ষা জরিপ অনুযায়ী জেলার শিক্ষার হার ৬০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এখানেই রয়েছে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের ২৬তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। রয়েছে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজসহ ৩টি মেডিকেল কলেজ, ১টি ক্যাডেট কলেজ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজসহ ৪৪টি কলেজ, কুমিল্লা জিলা স্কুল সহ ৬ শতাধিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২ হাজারের অধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১০৮৬টি কিণ্ডার গার্টেন এবং প্রায় ৩৭০টি মাদ্রাসা ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
যোগাযোগঃ
যোগাযোগ ব্যাবস্থায় অন্যান্য এলাকার তুলনায় কুমিল্লা জেলা অনেকটাই উন্নত। কুমিল্লা জেলা পুলিশের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকায় সারাদেশের ন্যায় উন্নয়ন কার্যক্রম বেগবান রয়েছে এ জেলাতে। বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বয়ে গেছে কুমিল্লা জেলার বুক চিরে। এছাড়াও রয়েছে কুমিল্লা-সিলেট, কুমিল্লা-নোয়াখালী এবং কুমিল্লা-চাঁদপুর মহাসড়ক সহ বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক মহাসড়ক। দুরপাল্লায় যাতায়াতের জন্য আরও রয়েছে সুদীর্ঘ রেলপথ, যেখান থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়মিত যাতায়াত করে বেশ কিছু ট্রেন। পাশাপাশি নৌ পথেও রয়েছে যাতায়াত সুবিধা।
অর্থনীতিঃ
কুমিল্লা জেলা পুলিশের সামাজিক কর্মতৎপরতা ও নিবিড় তত্ত্বাবধায়নে এ অঞ্চলের জনগণ নির্বিঘ্নে তাদের জীবনমান পরিচালনা করে আসছে। জেলার সিংহভাগ মানুষ কৃষির সাথে সম্পৃক্ত হলেও এখানে দেখা মেলে নানান পেশায় নিযুক্ত মানুষের। মোট জনগোষ্ঠীর ৪৭ শতাংশেরও বেশি মানুষ কৃষির সাথে যুক্ত থাকায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থকরী ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। পাশাপাশি গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান। কুমিল্লা একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় এখানে নির্মিত স্থলবন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি রপ্তানিও সম্পন্ন হয়। তাছাড়া জেলাবাসীর একটি বিশেষ অংশ প্রবাসে থাকায় দেশের রেমিট্যান্স অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে আসছে এ অঞ্চল।
স্বাস্থ্যঃ
কুমিল্লা বাসীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে এখানে রয়েছে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতাল, কুমিল্লা পুলিশ হাসপাতাল এবং সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল। এছাড়াও রয়েছে ২১টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ৪৮টি উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ১৩১টি ইউনিয়ন ভিত্তিক পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ১৩টি পল্লী স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও বিভিন্নও বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল। পশুপাখির স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে রয়েছে জেলা প্রানীসম্পদ দপ্তর সহ উপজেলাভিত্তিক প্রাণীসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল।
প্রেসক্লাবঃ
কুমিল্লা জেলায় সাংবাদিকদের কার্যক্রমকে বেগবান রাখতে রয়েছে সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন কুমিল্লা প্রেস ক্লাব। রয়েছে দৈনিক কুমিল্লার কাগজ, দৈনিক রূপসী বাংলা, দৈনিক মুক্তকণ্ঠ, সাপ্তাহিক কুমিল্লা বার্তা সহ বহু পত্র-পত্রিকা ও অনলাইন সংবাদ মাধ্যম।
দর্শনীয় স্থানঃ
প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি নগরীর নাম কুমিল্লা। ১৯২১ সাল থেকেই কুমিল্লার খাদি কাপড় ভারতবর্ষে ব্যপক প্রচলন ছিলো। এখনো কুমিল্লার বেশ কিছু জায়গায় খাদি কাপড়ের বুনন হয়ে আসছে। এ অঞ্চলের সুখ্যাতি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মাতৃভান্ডারের রসমালাই। স্বাদে অতুলনীয় এ মিষ্টান্ন শুধু বাংলাদেশ নয়…সুখ্যাতি অর্জন করেছে পৃথিবীব্যাপী।
তাছাড়া পূর্বে কুমিল্লা কতটা উন্নত ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমুহের দিকে নজর দিলেই অনুধাবন করা যায়। এখানেই রয়েছে ঐতিহাসিক ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার, শালবন বিহার, ইটাখোলা মুড়া, রুপবান মুড়া, আনন্দ বিহার, কোটিলা মুড়া, ধর্মসাগর, নবাব ফয়জুন্নেসার বাড়ি, মজিদপুর জমিদার বাড়ি, ভউকসার জমিদার বাড়ি সহ আরও বহু নিদর্শন। এছাড়াও রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা লালমাই পাহাড় ও বেশ কিছু প্রাচীন মসজিদ ও মাজার শরীফ। এসকল দর্শনীয় স্থান সমূহ দেখতে প্রতি বছর দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা পর্যটক ভীর জমায় কুমিল্লাতে। আগত পর্যটক ও জেলা বাসীকে কাঙ্খিত সেবা প্রদানে বদ্ধপরিকর কুমিল্লা জেলা পুলিশ।