Chatkhil Thana

চারদিকে সবুজের সমারোহ, পরিপূর্ণ জলাধার আর মধ্যভাগে বয়ে চলা রাস্তাযেন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে ঘেরা একটি জনপদ…নাম চাটখিল। যেখানে, গ্রামীণ সহজ সরল মানুষের পদচারনার সাথে দেখা মেলে প্রবাহমান সমকালীন সভ্যতার প্রতিচ্ছবি। জনশ্রুতি আছে, অতীতে এ এলাকায় বেশ বড় একটি বিল ছিল। তবে বহুদিন ধরে এটি অব্যবহৃত ছিল, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হত খিল পরা। ফলশ্রুতিতে এখানে চাট পোকার উৎপাত সৃষ্টি হলে স্থানীয় অধিবাসীরা অনেকটা হুমকীর সম্মুখীন হন। কালক্রমে এ বিলের আশেপাশে জনবসতি স্থাপন শুরু হলে এলাকার নামকরন করা হয় চাটখিল। এটি ১৯৭৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারী একটি থানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে যা ১৯৮৩ সালের ১লা আগস্ট উপজেলায় উন্নীত হয়।

বর্তমানে এ থানা অঞ্চলটির সার্বিক আইন শৃঙ্খলার মানে পূর্বের তুলনায় আনা হয়েছে বহুমুখী পরিবর্তন। চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক নুরেআলম মিনার দ্বায়িত্বশীলতা ও বিচক্ষন নেতৃত্বে; নোয়াখালী জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত আছেন মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বিপিএম পিপিএম। যার প্রজ্ঞা, কর্মস্পৃহা ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে চাটখিল সার্কেল তথা চাটখিল থানা পুলিশ। বর্তমানে কেমন আছে চাটখিলবাসী? থানা অঞ্চলের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিই বা কেমন? পজিটিভ থিংকের আজকের আয়োজনে থাকছে এসকল প্রশ্নের উত্তর, এলাকার সমসাময়িক চিত্র, জনজীবন, থানা পুলিশের কর্মতৎপরতা ও দর্শনীয় স্থানসমূহ নিয়ে সাজানো সবুজ সংকেত – চাটখিল থানা।

অবস্থানঃ  

রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দক্ষিন-পূর্বাংশে এবং নোয়াখালী সদর থেকে প্রায় ৩৯ কিলোমিটার উত্তর পূর্বাংশে অবস্থিত নোয়াখালী জেলার ক্ষুদ্রতম থানা অঞ্চল চাটখিল। এর পূর্বদিকে সোনাইমুড়ি উপজেলা, পশ্চিমে রামগঞ্জ ও লক্ষীপুর উপজেলা, উত্তরে শাহরাস্তি ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা এবং দক্ষিণে লক্ষ্মীপুর সদর ও বেগমগঞ্জ উপজেলা অবস্থিত। এটি নোয়াখালী জেলারসর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১৩৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ থানা অঞ্চলটিতে বসবাস করেন ২ লক্ষ ৯০ হাজারেরও অধিক মানুষ। বর্তমানে চাটখিল ১টি পৌরসভা ও মোট ৯টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত। ইউনিয়ন সমূহ হল সাহাপুর, রামনারায়ণপুর, পরকোট, বদলকোট, মোহাম্মদপুর, পাঁচগাঁও, হাটপুকুরিয়া ঘাটলাবাগ, নোয়াখলা ও খিলপাড়া।

মুক্তিযুদ্ধঃ

একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে চাটখিল থানা অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা দিয়েছিল অদম্য সাহসিকতার পরিচয়। থানার বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত রাজাকার ও পাকহায়নাদের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধে শহীদ হন বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা। সেসময় মোহাম্মদপুর ইউনিয়নে হানাদাররা নিরস্ত্র বাঙ্গালির উপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। তবে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশলী আক্রমনে পিছু হটে হায়েনার দল। তাদের এ গৌরবময় স্মৃতি সংরক্ষনে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন।

শিক্ষাঃ

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই চাটখিলের শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশেষ নজর দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে এ অঞ্চলের শিক্ষার হার ছাড়িয়েছে ৬৫ শতাংশে। স্থাপিত হয়েছে চাটখিল পাঁচগাঁও মাহাবুব সরকারি কলেজ ও চাটখিল মহিলা ডিগ্রী কলেজ সহ মোট ৫টি কলেজ, ২৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১০৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রায় ৪০টি কিণ্ডার গার্টেন ও বেশকিছু মাদ্রাসা।

যোগাযোগঃ  

সারাদেশে চলমান অবকাঠামোগত উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় চাটখিল থানা অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও এসেছে দৃশ্যমান উন্নয়ন। বৃহৎ কোন মহাসড়কের অবস্থান না থাকলেও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের সুবিধার্থে নির্মিত মাইজদী – রামগঞ্জ সড়ক, চাটখিল – চন্দ্রগঞ্জ সড়ক নির্মিত হয়েছে। ফলে, দূরদুরান্তে সহজেই যাতায়াত করতে পারছে অঞ্চলের জনসাধারণ। রয়েছে প্রায় ২৮৪ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৬ কিলোমিটার আধাপাকা রাস্তা, অভ্যন্তরীণ সড়কপথ ও পর্যাপ্ত ব্রিজ কালভার্ট।

অর্থনীতিঃ
থানা পুলিশের কর্মতৎপরতায় এ অঞ্চলের মানুষজন নির্বিঘ্নে তাদের জীবনমান পরিচালনা করে আসছেন। এখানকার প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। ফলে প্রধান অর্থকরী ফসলের বাইরেও বিপুল পরিমাণ মৌসুমি ফলমূল উৎপাদিত হচ্ছে যা স্থানীয় বাজারে বাজারজাত করে জীবিকা নির্বাহ করছে এখানকার কৃষকেরা। তাছাড়া, থানাবাসীর একটি বৃহৎ অংশ ব্যবসা, চাকরি, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে কর্মরত রয়েছেন। এটি একটি শিল্প সম্ভাবনাময় অঞ্চল। রয়েছে বৃহৎ কলকারখানা ও শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা।

পাশাপাশি জেলার অন্যান্য থানা অঞ্চলের তুলনায় চাটখিলে সর্বাধিক হারে প্রবাসী থাকায় প্রবাসীরা মূল্যবান রেমিটেন্স অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখে চলেছেন। প্রবাসীদের নানাবিধ প্রয়োজনে প্রবাসী হেল্প ডেস্ক এর মাধ্যমে সেবা প্রদান করে আসছে পুলিশ সদস্যগন।

স্বাস্থ্য ও প্রেসক্লাবঃ

থানাবাসীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে নির্মিত হয়েছে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। রয়েছে ১টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ৮টি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। আরো রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য খাতের অগ্রাধিকার প্রকল্পের ২৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক যার মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া এ থানা অঞ্চলে রয়েছে স্থানীয় গনমাধ্যমকর্মীদের সম্মিলিত সংগঠন চাটখিল প্রেসক্লাব। রয়েছে আলোকিত চাটখিল সহ বহু অনলাইন গনমাধ্যম।

দর্শনীয় স্থানঃ

রূপবৈচিত্রে পরিপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী এ থানা অঞ্চলটি একসময় একটি জমিদার অধ্যুষিত এলাকা ছিল। স্থানীয় সেসব জমিদারদের নিদর্শন হিসেবে আজও টিকে আছে চৌধুরী জমিদার বাড়ি ও দেওয়ান জমিদার বাড়ি। ভাঙা ইট পাথর আর জরাজীর্ণ দালান গুলোই যেন যুগ যুগ ধরে বহন করে আছে অজানা ঐতিহাসিক গল্পের প্রতিফলন। রয়েছে মল্লিকা দীঘি ও মেঘা দীঘি। এছাড়াও ১৯৪৬ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে এ অঞ্চলে শান্তির বাণী নিয়ে এসেছিলেন ভারতের অবিসংবাদিত নেতা মহাত্মা গান্ধী, কিছুকাল অবস্থান করেছিলেন চাটখিলে। তার বসবাসের স্থান ও স্মৃতি বিজড়িত বিভিন্ন নিদর্শন নিয়ে নির্মিত হয়েছে গান্ধী স্মৃতি জাদুঘর।

কৃতিসন্তানঃ

চাটখিল বেশ কিছু দেশবরেণ্য খ্যাতনামা ব্যাক্তিত্বের জন্মস্থান। এখানেই জন্মগ্রহন করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের প্রধান বিচারপতি রেজাউল হাসান। জাতীয় অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ কবীর চৌধুরী এবং তার অনুজ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর পৈত্রিক নিবাস চাটখিলেই। তাছাড়া জাতীয় সংসদের বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম নারী স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পৈত্রিক নিবাস এই চাটখিল।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।