Hatia

হাতিয়া… প্রকৃতির অকৃত্তিম রুপের হাতছানি আর সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে জেগে ওঠা একটি দ্বীপাঞ্চল। যেখানে প্রতিনিয়ত উপকূলীয় বন ও বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশির প্রবল দাপটের সাথে সংগ্রাম করে টিকে আছে হাতিয়ার বাসিন্দারা। রুপবৈচিত্রে পরিপূর্ণ অপার সম্ভাবনাময় এ অঞ্চলটি প্রতিনিয়ত ভাঙ্গা-গড়ার মধ্য দিয়ে বয়ে চলছে তার নিজস্ব মহিমায়।

হাতিয়ার নামকরন নিয়ে বেশ কিছু প্রচলিত মত থাকলেও ধারনা করা হয় তৎকালীন বাংলার শাসক শেরশাহ্ এ দ্বীপে জলদস্যুদের দৌরাত্ম ও অত্যাচার দমনের লক্ষে হাতিয়াল খা নামক সেনাপতির নেতৃত্বে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। তারা এ অঞ্চল থেকে দস্যুদের দমন করে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনলে ঐ সেনাপতির নামানুসারে এ দ্বীপের নামকরণ করা হয় “হাতিয়াল দ্বীপ”। কালক্রমে হাতিয়াল থেকে ‘ল’ উঠে গিয়ে এর নাম হয় হাতিয়া দ্বীপ। এটি ১৭৯৩ সালে থানা হিসেবে গঠিত হয়, যা দেশভাগের পর ১৯৮৩ সালে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে উপজেলায় উন্নীত করা হয়।

অবস্থানঃ

বাংলাদেশের মুল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দক্ষিনে সাগরের অকৃত্রিম নীল ভেদ করে জেগে ওঠা হাতিয়া থানা অঞ্চলটি রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ২৩৩ কিলোমিটার এবং নোয়াখালী সদর থেকে প্রায় ৫৭ কিলোমিটার দক্ষিনাংশে অবস্থিত। যার পূর্ব ও দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে ভোলা জেলার মনপুরা ও তজুমদ্দিন উপজেলা, এবং উত্তরে সুবর্ণচর ও লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলা। প্রায় ২ হাজার ১০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বৃহৎ এ জনপদটি নোয়াখালী জেলার সবচেয়ে বড় থানা অঞ্চল। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এ অঞ্চলে বসবাস করেন প্রায় ৪ লক্ষ ৫২ হাজার মানুষ যা বর্তমানে ৮ লাখ ছাড়িয়েছে।

এটি একটি পৌরসভা ও ১১টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত। ইউনিয়ন সমূহ হলো, হরণী, চানন্দী, সুখচর, নলচিরা, চর ইশ্বর, চর কিং, তমরদ্দি, সোনাদিয়া, বুড়িরচর, জাহাজমারা ও নিঝুমদ্বীপ। তন্মধ্যে, চর ইশ্বর ইউনিয়নের ভাসানচর দ্বীপটি ভাসানচর থানার অন্তর্ভুক্ত।

রাতের আধার কাটতেই সমুদ্রের গর্জন আর পাখির কলকাকলীতে জেগে উঠে হাতিয়াবাসী। মাঠে মাঠে গরু মহিষের পাল আর উত্তাল সাগরে ট্রলার নিয়ে জেলেদের ছুটে চলার পাশাপাশি, হাট-বাজার, অফিস আদালতে শুরু হয় কর্মজীবী মানুষের ব্যস্ততা…

মুক্তিযুদ্ধঃ

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে হাতিয়া ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। ১১ মে পাকহানাদাররা প্রথম হাতিয়া আক্রমণ করে এবং ব্যাপক নির্যাতন ও লুণ্ঠন চালায়। এলাকার আফাজিয়া বাজার ও উছখালি বাজারে বেশ কয়েকজন নিরীহ বাঙালীকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে হায়েনারা। বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথেও একাধিক সম্মুখ সমরে শহীদ হন বহু বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা। পরবর্তীতে, ১৪ আগস্ট হাতিয়ায় হানাদারদের ঘাঁটি আক্রমন করেন মুক্তিযোদ্ধারা। এই আক্রমণে ১২০ জন রাজাকার সহ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পণ  করে। এভাবেই শত্রুমুক্ত হয়ে হাতিয়া। মুক্তিযুদ্ধে এসব বীরত্বপূর্ণ স্মৃতি সংরক্ষণে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ও মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স ভবন।

শিক্ষাঃ

হাতিয়া একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হওয়ায় পূর্বে শিক্ষাখাতে অনেকটাই পিছিয়ে ছিলো। তবে, বর্তমানে শিক্ষার আলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে। বর্তমানে এ অঞ্চলের শিক্ষার হার ৬৯ শতাংশ ছাড়িয়েছে। রয়েছে হাতিয়া দ্বীপ সরকারি কলেজ, হাতিয়া ডিগ্রী কলেজ সহ মোট ৫টি কলেজ, ৩৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, প্রায় ২৫৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বেশ কিছু মাদ্রাসা।

যোগাযোগঃ

নৌপথই যেন হাতিয়াবাসীদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হওয়ায়, দুরপাল্লার যাতায়াতে সরাসরি সড়ক পথ না থাকলেও ঢাকা থেকে নিয়মিত লঞ্চযোগে হাতিয়ায় যাতায়াত করা সম্ভব হচ্ছে। রয়েছে বেশ কয়েকটি নৌ বন্দর। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে নির্মিত হয়েছে ১৩০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৬০ কিলোমিটার আধাপাকা রাস্তা ও পর্যাপ্ত ব্রিজ কালভার্ট সহ প্রায় ২০৫ কিলোমিটার নৌপথ। তবে, চরাঞ্চল গুলোতে যোগাযোগের মাধ্যম সীমিত হওয়ায় পুলিশি টহল ও সেবাদানে কিছুটা বেগ পেতে হয় হাতিয়া থানার পুলিশ সদস্যদের।

অর্থনীতিঃ

হাতিয়া থানা পুলিশের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় স্বাচ্ছন্দ্যেই জীবনযাপন করছেন এ অঞ্চলের মানুষজন। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এ এলাকাটির অধিকাংশ বাসিন্দাই মৎস্য আহরন ও কৃষি পেশার সাথে সংযুক্ত। জেলেরা ট্রলার নিয়ে পাড়ি জমায় গভীর সমুদ্রে এবং আহরন করে বিপুল পরিমান মাছ। পাশাপাশি, প্রতিবছর এসব মাছ থেকে উৎপাদন হয় উল্লেখযোগ্য পরিমান শুটকি। নদী ও সামুদ্রিক মাছ সহ উৎপাদিত শুটকি সারাদেশে বাজারজাত ও বিদেশে রপ্তানি করছে হাতিয়াবাসী। তাছাড়া  উর্বর কৃষি জমি থাকায় উৎপাদিত হচ্ছে বহু অর্থকরী ফসল। কৃষিজীবী ও মৎস্যজীবীর বাইরেও চাকুরি, ব্যবসা, পর্যটন ও সেবা খাতেও যুক্ত থেকে দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে এ এলাকার জনগন।

ধর্মঃ

ঐতিহাসিকভাবে চট্রগ্রাম বাংলাদেশের ইসলাম ধর্মের প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচিত হলেও হাতিয়াতেই এদেশে ইসলামের সূত্রপাত বলে বিশ্বাস করেন এ দ্বীপের বাসিন্দারা। জানা যায় খ্রিষ্টীয় ৯ম শতাব্দিতে সর্বপ্রথম এখানে একটি বৃহত্তম মসজিদ গড়ে উঠে যা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।

হাতিয়ার অধিকাংশ মানুষ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও অসম্প্রদায়িক এ অঞ্চলটিতে রয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সম্মিলিত বসবাস। তাদের উপাসনার জন্য রয়েছে প্রায় ৪৭১টি মসজিদ ও ২৭টি মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। সকলের সহাবস্থান ও সম্পৃতি অক্ষুণ্ণ রাখার লক্ষে ও যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা মোকাবেলায় সোচ্চার অবস্থানে রয়েছে হাতিয়া থানা পুলিশ।

স্বাস্থ্য ও প্রেসক্লাবঃ

থানাবাসির স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে নির্মিত হয়েছে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। রয়েছে ৬টি উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ১০টি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র সহ কমিউনিটি ক্লিনিক। পশুপাখির সুচিকিৎসায় রয়েছে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল। এছাড়াও থানা অঞ্চলে রয়েছে স্থানীয় গনমাধ্যমকর্মীদের সম্মিলিত সংগঠন হাতিয়া প্রেসক্লাব।

দর্শনীয় স্থানঃ

সাগর ও নদী বেষ্টিত প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি হাতিয়ার সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছর এখানে আসেন দেশ-বিদেশ থেকে আগত বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থী। এখানে রয়েছে চিত্রা হরিনের চারণভূমি খ্যাত নিঝুম দ্বীপ। যার দক্ষিণ ও পশ্চিম কোণে বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত থেকে সুর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য অবলোকন করা যায়। ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার দ্বীপটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এর বিস্তৃত এলাকাকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এখানেই রয়েছে কৃত্তিম ও প্রকৃতি সৃষ্ট কাটাখালী ম্যানগ্রোভ বন, কমলার দীঘি, তমরুদ্দি পাথর ঘাট, রহমত বাজার পর্যটন কেন্দ্র, সূর্যমুখী সি বীচ, দানারদোল সি বীচ, সহ পর্যটকদের পছন্দনীয় বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।