Nasirnagar

নাসিরনগর… ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার হাওড় বেষ্টিত বৈচিত্রময় একটি অঞ্চল। কথিত আছে, হযরত শাহ জালাল (রহ.) অন্যতম সঙ্গী সৈয়দ নাসির উদ্দীন সিলেটের গৌড় গোবিন্দ রাজার রাজ্য আক্রমণ এবং ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য যাওয়ার পথে এখানে অবস্থান করেছিলেন। তার নামানুসারে এ এলাকার নামকরন করা হয়েছিল নাসিরনগর। ১৮৬০ সালে তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার অধীনে নাসিরনগর মহকুমার সৃষ্টি হলে সেখানে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়। অতঃপর ১৮৭৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা গঠিত হলে ফৌজদারি কার্যক্রমের সুবিধার্থে ১৯১০ সালে নাসিরনগর পুলিশ ফাঁড়িটি থানা হিসেবে ঘোষিত হয়। পরবর্তীতে দেশভাগের পর ১৯৮৩ সালে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের লক্ষে একে উপজেলায় উন্নীত করা হয়।

 

 

অবস্থানঃ

রাজধানী ঢাকা থেকে ১১৩ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বাংশে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর থেকে প্রায় ২৯ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত শ্যামল বাংলার অপরূপ নিদর্শন এই নাসিরনগর। এ এলাকার পূর্বেদিকে মাধবপুর উপজেলা, পশ্চিমে মেঘনা নদী ও অষ্টগ্রাম উপজেলা, উত্তরে বলভদ্রা নদী ও লাখাই উপজেলা এবং দক্ষিণে সরাইল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা অবস্থিত। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ২৯৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জনপদটিতে বসবাস করেন প্রায় ৩ লাখ ৯ হাজার ১১ জন মানুষ। বর্তমানে এ অঞ্চলটি ১৩টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত যার সম্পূর্ণ প্রশাসনিক কার্যক্রম নাসিরনগর থানার আওতাধীন। ইউনিয়ন সমূহ হল চাতলপাড়, ভলাকুট, কুন্ডা, গোয়ালনগর, নাসিরনগর সদর, বুড়িশ্বর, ফান্দাউক, গুনিয়াউক, চাপৈরতলা, গোকর্ণ, পূর্বভাগ, হরিপুর ও ধরমন্ডল।

মুক্তিযুদ্ধঃ

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে নাসিরনগর জুড়ে রচিত হয়েছে গৌরবময় আত্মত্যাগের ইতিহাস। ১৫ই নভেম্বর কুন্ডা, বোলাকোট, গোকর্ণ ও নাসিরনগর সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে পাকবাহিনীর হামলায় প্রান বিসর্জন দেয় বহু নিরীহ মানুষ। পরবর্তীতে তুল্লাপাড়া গ্রামের বটতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনে বহু রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনা নিহত হলে শত্রু মুক্ত হয় নাসিরনগর থানা অঞ্চল। মুক্তিযোদ্ধাদের এসব স্মৃতি আজীবন স্মরণ রাখতে নির্মিত হয়েছে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সম্বলিত একটি স্মৃতি স্তম্ভ।

১৯৭১ সালে পাঁক হানাদারদের তান্ডবের সময়ে এখানে হানা দিয়েছিলো প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়। সে ঘূর্ণিঝড়ে চাপৈরতলা ও চিতনা গ্রাম দুটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ১৯৭৪ ও ১৯৮৮ সালের বন্যাতেও নাসিরনগর ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

শিক্ষাঃ

বর্তমানে নাসিরনগর ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। এ থানা অঞ্চলের শিক্ষার হার ৩৫ শতাংশ হলেও শিক্ষার মানোন্নয়নে বিভিন্ন কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহন করা হচ্ছে। রয়েছে মৎস্য ও প্রানিসম্পদ মন্ত্রনালয়ের আওতাধীন ইনস্টিটিউট অব লাইভস্টক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। যেখানে কারিগরি শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। এর পাশাপাশি আরও রয়েছে ২টি কলেজ, ১৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, প্রায় ১১৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ ১০টিরও বেশী কিন্ডারগার্টেন ও বেশ কিছু মাদ্রাসা।

যোগাযোগঃ

আইন শৃঙ্খলা স্বাভাবিক থাকায় নাসিরনগরবাসী স্বাচ্ছন্দে যাতায়াত সুবিধা গ্রহন করতে পারছে। আঞ্চলিক সড়কপথ সরাইল – নাসিরনগর রোডই তাদের প্রধান যোগাযোগের মাধ্যম। এছাড়া থানা অঞ্চলটির বৃহৎ একটি অংশে তিতাস ও কালনী নদীর অবস্থান ও বিস্তৃত হাওর অঞ্চল থাকায় দুরপাল্লার যাতায়াতে নৌপথ একটি বড় ভুমিকা পালন করে থাকে। রয়েছে প্রায় ৬৪ কিলোমিটার পাকারাস্তা, ৯ কিলোমিটার আধা-পাকারাস্তা সহ ৭০ কিলোমিটার নৌপথ। নদী ও হাওর অঞ্চলের বাসিন্দা হওয়ায় এখানকার জনগনের জীবন যাপনও অনেক সহজ সরল।

অর্থনীতিঃ

নাসিরনগর থানা পুলিশের নিবিড় তত্ত্বাবধায়নে এ অঞ্চলের মানুষ বেশ নিরাপদে তাদের জীবনমান পরিচালনা করে আসছে। বিস্তৃত কৃষিজমি, হাওর ও নদী বিধৌত এলাকা হওয়ায় এখানকার সিংহভাগ মানুষই মৎস্য আহরন ও কৃষি পেশার সাথে সম্পৃক্ত। ফলে প্রতি বছরই বিপুল পরিমান মাছ ও অর্থকরী ফসল উৎপাদিত হচ্ছে নাসিরনগরে। কৃষিকাজের বাইরেও স্থানীয় মানুষজন ব্যবসা, চাকুরি ও প্রবাসে থেকে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।

স্বাস্থ্য

তাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে রয়েছে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, গুনিয়াউক ১০ শয্যা বিশিষ্ট পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ৩টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ১১টি ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। এ অঞ্চলে রয়েছে সাংবাদিকদের সম্মিলিত সংগঠন নাসিরনগর প্রেসক্লাব। যা উপজেলার সাংবাদিকদের কার্যক্রম বেগবান রাখতে কাজ করে যাচ্ছে।

দর্শনীয় স্থানঃ

বর্ষাকালে থইথই পানির সাজে অপরূপ হয়ে উঠে নাসিরনগরের হাওড়াঞ্চল। মেদির হাওরের মনুমুগ্ধকর দৃশ্য যেন এক চিলতে কক্সবাজার। অথৈ পানিতে ডিঙ্গি নৌকার মাছ শিকারের দৃশ্য যেন গ্রাম বাংলার এক চিরচেনা দৃশ্যপট। এ অঞ্চলটি অতীতে একটি জমিদার অধ্যুষিত এলাকা ছিল। যার নিদর্শন স্বরুপ এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু প্রাচীন জমিদার বাড়ি ও নিদর্শন। রয়েছে ১৭৫ বছর পূর্বে জমিদার গৌরী প্রসাদ রায় এবং কৃষ্ণ প্রসাদ রায় নির্মিত হরিপুর জমিদার বাড়ি বা বড় বাড়ি। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম এর পরিবেশনায় ফরিদুর রেজা সাগর ও ইবনে হাসান খানের প্রযোজনায় হুমায়ূন আহমেদ এর সর্বশেষ রচিত বিখ্যাত চলচ্চিত্র ঘেটুপুত্র কমলার শুটিং স্পট হিসেবেও পরিচিত এই জমিদার বাড়িটি। এছাড়া নাসিরনগরে গোকর্ণ গ্রামে জন্মগ্রহন করেন নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা। তার নির্মিত ত্রিতল বিশিষ্ট বাসভবন ‘গোকর্ণ নবাব বাড়ি কমপ্লেক্স’ এরও অবস্থান এই নাসিরনগরে। রয়েছে জমিদার কৃষ্ণ সেনের বাড়ি, ঠাকুরবাড়ি, গুনিয়াউক বাগান বাড়ি, শ্বেতপাথরের আদলে নির্মিত মসজিদ ই নুর, সাহেব বাড়ি মাজার, সর্বধর্ম যোগ মন্দির, রামকানাই ভবন, আনন্দময়ী কালিবাড়ি, ডেংগু শাহের মাজার সহ বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।