-
Positive Think
- News Blogs
- 0 Comments
আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে প্রাচীন মৃৎশিল্প
বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি অনন্য এক নিদর্শন মৃৎশিল্প। মাটি দ্বারা হাতে তৈরি সৌন্দর্যময় সৃষ্টিশীল এই শিল্পকে ঘিরে একসময়ে তৈরি হয়েছিল অসংখ্য গ্রামীণ জনপদ, সে সব জনপদকে কেন্দ্র করে তৈরি হযেছিল মানুষের কর্মসংস্থান।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, মৃৎশিল্প প্রথম চীনের বিখ্যাত শহর থাংশানে প্রচলিত ছিলো। মিং রাজবংশের ইয়ং লে-এর সময়কালে থাংশানে মৃৎশিল্পের উৎপত্তি ও বিকাশের সূত্রপাত হয়। ইতিহাসকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সে সময়ে থাংশান শহরটিকে মৃৎশিল্পের শহর বলে নামকরণ করা হয়। ঐ সময়ে চীনের স্হানীয় ভাষায় মাটির তৈরি জিনিসপত্রকে বলা হতো ‘সেলাডন’। এই সেলাডন পরবর্তীতে এশিয়া, ইউরোপসহ আশপাশে ছড়িয়ে যায়। আদিমকালে বাংলাদেশেও এর ব্যাপকতা লাভ করে। সে সময়ে পানি রাখা ও খাওয়ার জন্য মাটির তৈরি কলস ও হাঁড়ি-পাতিল-ই ছিলো একমাত্র ভরসা। মাটির তৈরি এই মৃৎশিল্পে বাংলাদেশে রয়েছে নিজস্ব সমৃদ্ধ এক ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্যের রূপকার হলেন হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত কুমার শ্রেণীর পেশাজীবীরা। বংশ পরম্পরায় তারা এ কাজ করে আসছেন। মাটি দিয়ে হাতে তৈরি সৌন্দর্যবর্ধন এই শিল্পকর্মের মধ্যে অন্যতম হাঁড়ি-পাতিল, কলস, বদনা, ফুলদানি, জীবজন্তু, পাখির অবয়ব, ঘটি-বাটি, শো-পিস, পিঠা তৈরির ছাঁচসহ নানা রকম উপকরণ।

প্রাচীনকালে গ্রামের সুনিপুণ কারিগরের হাতে তৈরি মাটির জিনিসের কদর ছিল অনেকাংশে বেশি। পরিবেশবান্ধব এই শিল্প শোভা পেত গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে। মাটির এসব তৈজসপত্র তৈরিতে দরকার হয় এঁটেল মাটি, শুকনো ঘাস, জ্বালানি কাঠ, খড়ো বালি। মৃৎশিল্পীরা কাঁচামাটি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী বানানোর পর পুড়িয়ে, এবং কখনো কখনো বিভিন্ন কালারের রং করে সেগুলো বাজারে বা গ্রামে ফেরি করে বিক্রি করতেন। কখনো কখনো নৌকাবোঝাই করে এসব সামগ্রী নিয়ে পাল মশাইরা বেশ কয়েক দিনের জন্য বেরিয়ে পড়তেন। নদীতীরবর্তী বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে সেগুলো বিক্রি শেষ হলে বাড়ি ফিরতেন।
এক সময়ে বাংলাদেশে মৃৎশিল্পের হাঁড়ি-পাতিল-কলসি ছাড়াও সুন্দর পোড়ামাটির ফলকের সাহায্যে গড়ে ওঠােছিল ‘টেরাকোটা’—যা প্রাচীন মৃৎশিল্পের-ই অবদান। নকশা করা মাটির ফলক ইটের মতো পুড়িয়ে তৈরি হতো এই টেরাকোটা। ময়নামতির শালবন বিহার, বগুড়ার মহাস্থানগড় ও বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদে যেসব পোড়ামাটির ফলকের নিদর্শন মৃৎশিল্পের-ই বর্তমান উদাহরণ। নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় সহজে পরিবহন, কাঁচামালের সহজলভ্যতা, পর্যাপ্ত জ্বালানি এবং সর্বোপরি দেশব্যাপী বিপুল চাহিদা থাকায় অতীতে মৃৎশিল্পের ছিল জয়জয়কার। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখনকার চিত্রটা ভিন্ন। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন গ্রাম বা শহরের মানুষ ধাতব, প্লাস্টিক, ম্যালামাইন ও চীনামাটির সামগ্রী ব্যবহার করে। ফলে বর্তমানে মৃৎশিল্পে অনেকটা ভাটা পড়েছে। স্টিল, ম্যালামাইন, সিরামিক, সিলভারসহ বিভিন্ন ধাতব পদার্থের তৈরি তৈজসপত্রের চাহিদা বাড়তে থাকায় কমছে মৃৎশিল্পের প্রয়োজনীতা। তাছাড়া কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মাটির মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি সংকট, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি, ঋণ প্রাপ্তিতে জটিলতাসহ নানা কারণে মুখথুবড়ে আজ বিলুপ্তির পথে বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য এই মৃৎশিল্প।

এই শিল্পের ভাটার ফলে অনেক কষ্ট আর দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলার কুমার শ্রেণির বর্তমান দিনকাল। অনেকেই এই পেশা ছেড়ে নানা কাজে নিজেকে জড়িয়ে নিছেন; যারা এ পেশায় এখনো টিকে আছেন, তারা পরিবার নিয়ে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন। অভাব আর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে তাদের। আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজ বিলুপ্তির পথে বাংলাদেশের প্রাচীন এই মৃৎশিল্প।