Shohag1
ভালো ছাত্র হওয়ায় মা-বাবা চেয়েছিলেন ছেলেটিকে ডাক্তার বানাবে; তার জন্য মাধ্যমিকে ভর্তি করালেন বিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু ছেলেটির ভালো লাগে না জীববিজ্ঞান পড়া মুখস্ত করতে—হতে চান প্রকৌশলী। তাই উচ্চমাধ্যমিকে এসে অপশনাল বিষয়ে উচ্চতর গণিত পরিবর্তন করে জীববিজ্ঞান নিলেন। যথারীতি সফলতার সাথে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হলেন দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ বুয়েট-এ। সেখান থেকে পড়াশোনা শেষ করার আগেই রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেন; বছরখানেক বাদে সে ট্রাডিশন্যাল চাকরি ছেড়ে হলেন উদ্যােক্তা। গড়ে তুললেন দেশের বহুমাত্রিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অন্যরকম গ্রুপ। তৈরি করলেন দেশের হাজার হাজার তরুণের কর্মসংস্থান। বলছিলাম অন্যরকম গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান সোহাগ-এর কথা।

 

FB IMG 16569583050424190
প্রথমবারের মতো আয়োজিত রকমারি বেস্টসেলার পুরস্কার অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন মাহমুদুল হাসান সোহাগ | ছবি: রকমারি ডট কম
শিক্ষক বাবা আবুল হোসেনের তিন সন্তানের সবচেয়ে ছোট সন্তান মাহমুদুল হাসান সোহাগ ১৯৮৩ সালের ৭ জুন জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। সরিষাবাড়ীর স্হানীয় প্রতিষ্ঠান নাসিরউদ্দিন কিন্ডারগার্টে কাটে তাঁর বাল্যকাল। পরবর্তীতে রিয়াজ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় থেকে বোর্ড স্ট্যান্ডসহ কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক সম্পন্ন করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন; সে বছর উচ্চমাধ্যমিকে সম্মিলিত মেধাতালিকা ৫ম হন সোহাগ। উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে তড়িৎ ও ইলেকট্রিক্যাল প্রকৌশলীতে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটে। বুয়েটের শেষ বর্ষে থাকা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়টির আইআইসিটিতে (IICT) রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট হিসেবে চাকরি শুরু করেন। কিন্তু বছরখানেক বাদে গ্রাজুয়েশন সম্পন্নর সাথে সাথে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে দক্ষতা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন এই মূলমন্ত্র নিয়ে গড়ে তুলেন অন্যরকম গ্রুপের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান—সারাদেশে সবার হাতে বই পৌঁছে দিতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রকমারি ডট কম, অন্যরকম ইলেকট্রনিক্স কোম্পানি লিমিটেডের মাইক্রোকন্ট্রোলার বেইজড ডিভাইস ডিজাইন, ডেভলপমেন্ট ও বিভিন্ন ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল প্রোজেক্ট ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাজ করার প্রতিষ্ঠান পাই ল্যাবস বাংলাদেশ লিমিটেড, টেকশপ বাংলাদেশ লিমিটেড, অন্যরকম সফটওয়্যার লিমিটেড, অন্যরকম প্রকাশনী লিমিটেড, অন্যরকম সল্যুশনস লিমিটেড, অন্যরকম ওয়েব সার্ভিসেস লিমিটেড, দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বাবলম্বিতা অর্জনের জন্য কাজ করতে অন্যরকম ইলেকট্রনিক কোম্পানি লিঃ, যা শিশু-কিশোরদের বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী করে তুলতে বিজ্ঞান বক্স, শিক্ষাকে সবার কাছে সহজে পাঠ্য ও আনন্দময় করে তুলতে অন্যরকম পাঠশালাসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড-এর একাডেমিক কাউন্সিলরও ছিলেন। তার কোম্পানি পাই ল্যাবস বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে নির্মিত করা হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। এছাড়া তিনি ইজি ভোটিং কাউন্ট সিস্টেম (ইভিসিএস) ও ইজি ওমআর সল্যুশন সফটওয়্যারেরও জনক। সোহাগের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে প্রায় ২,০০০ হাজারের বেশি কর্মকর্তা আছে এছাড়াও খন্ডাকালীন কর্মকর্তা আছে তার কয়েকগুণ। সোহাগ বলেন,

❝অত্যাধিক জনসংখ্যাকে আমরা সমস্যা মনে করি; কিন্তু বাস্তবতায় জনসংখ্যাকে ঠিকমতো কাজে না লাগাতে পারাটা সমস্যা। আমাদের ফোকাস যদি হয় জনশক্তিকে দক্ষ করে তোলা, সমৃদ্ধ করা—তবেই আমরা অর্থনীতিতে অন্যদের থেকে এগিয়ে যাব।❞

তবে সোহাগের উদ্যোক্তা জীবনের শুরু তারও আগে বুয়েটের প্রথম বর্ষে থাকাকালীন সময়ে। একদিকে সেশনজট তাকে ভাবিয়ে তোলে অন্যদিকে ক্লাশ, প্রাইভেট পড়ার সময় খেয়াল করতেন শিক্ষকদের তেমন একটা প্রশ্ন করার সুযোগ থাকতো না। আর শিক্ষকেরাও বেশি প্রশ্ন করাকে তেমন একটা পছন্দ তো করেনই না, বরং অনেকক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের উপর ক্ষেপে যায়। সে থেকে তিনি চিন্তা করেন, একটা একাডেমিক প্রতিষ্ঠান করবেন, সেখানে নির্দ্বিধায় যেকেউ যেকোনো প্রশ্ন করবে। যে চিন্তা সেই কাজ—কয়েকজন সহপাঠীকে নিয়ে মাত্র ছয় হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে চালু করেন ‘উদ্ভাস’ একাডেমিক কেয়ার। ৮০০ টাকা ভাড়ায় একটি কক্ষে কার্যক্রম শুরু করেন; প্রতিষ্ঠার কয়েকমাস পর ছাত্রসংখ্যা কমতে থাকায়, জমে যায় বেশ কয়েকমাসের বকেয়া ভাসা বাড়া। এমন পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকজন পার্টনার বিদায় নিয়ে নেয়; কিন্তু সোহাগ ও আরেক পার্টনার আবুল হাসান চালিয়ে নেন উদ্ভাস। সময়ের পালাবদলে সেই উদ্ভাস এখন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি সহযোগী শিক্ষা সংস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে তাঁদের প্রায় ৬০ টিরও বেশি শাখা রয়েছে। উদ্ভাসের পাশাপাশি স্বপ্নধারা পাঠশালা নামেও একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালক করে উদ্ভাস। উদ্ভাসের সফলতার পেছনে অন্যরকম পাঠশালার যুগান্তকারী কার্যক্রম বেশি ভুমিকা রেখেছে। সেখানে বিভিন্ন পাঠ্যবিষয়ের ওপর পূর্ণাঙ্গ ভিডিও ক্লাস সিডিতে ধারণ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ করা হতো। শর্ত থাকত, নিজে উপকৃত হওয়ার পর অন্তত আরও দুজনকে সিডিটি দিতে হবে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যােগ গ্রহণ করে দেশের ই-কমার্স খাতে যুগান্তকারী ভুমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়েছেন উদ্যোক্তা সম্মাননা, আনোয়ারুল কাদির ইনোভেটর অ্যাওয়ার্ড, প্রথম আলো উদীয়মান তরুণ উদ্যোক্তা সম্মাননা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে তরুণ উদ্যোক্তা এবং ইভিএম জি কো-ইনভেন্টর হিসেবে অবদান রাখায় ‘বিশেষ সম্মাননা’ পুরস্কার। এছাড়াও বিশ্বের সর্ববৃহৎ সিটি স্কুল ‘সিটি মন্টেসরি স্কুল’ কর্তৃক ‘অ্যামবাসেডর অব পিস’ সম্মাননাসহ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা।
error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।