Monohorganj Thana

মনোহরগঞ্জ… ডাকাতিয়া নদীর দুপাশে গড়ে উঠা একটি লোকবৈচিত্র্যময় অঞ্চল। এলাকাটি একসময় দেশের পাট ব্যবসার কেন্দ্রস্থল ছিলো। ব্যবসায়ীদের যোগাযোগে ডাকাতিয়া ও ঘাগরিয়া নদীর মোহনা অংশটি খুব মনোহরণকারী স্থান হিসেবে পরিচিত হওয়ায় এর নাম হয় মনোহরগঞ্জ। আবার কারো কারো মতে, মনোহর নামে এক ব্যাক্তি মাটির হাড়ি পাতিল তৈরির কারখানা স্থাপন করলে, ঐ ব্যাক্তির নামেই এ অঞ্চলটি মনোহরগঞ্জ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

বর্তমানে মনোহরগঞ্জ একটি প্রসিদ্ধ ব্যবসায়িক স্থান। এটি ২০০৪ সালের ২৬ আগস্ট লাকসাম হতে বিভক্ত হয়ে উপজেলা এবং ২০০৫ সালে আলাদা থানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

 

 

ঢাকা থেকে ১৩২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং কুমিল্লা জেলা শহর হতে প্রায় ৪২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী থানা অঞ্চল মনোহরগঞ্জ। ১৬৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের মোট ১১টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত এ অঞ্চলটিতে বসবাস করেন প্রায় আড়াই লাখ মানুষ। ইউনিয়ন সমূহ হলো বাইশগাঁও, সরসপুর, হাসনাবাদ, উত্তর ঝলম, দক্ষিণ ঝলম, মৈশাতুয়া, লক্ষণপুর, খিলা, উত্তর হাওলা, নাথেরপেটুয়া ও বিপুলাসার। এ থানা অঞ্চলের পূর্ব দিকে নাঙ্গলকোট উপজেলা, পশ্চিমে চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলা, উত্তরে, লাকসাম উপজেলা এবং দক্ষিণে নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলা অবস্থিত।

আবহমান গ্রাম-বাংলার চিরচেনা গ্রামীণ জনপদের চিত্রপট…আর ইট পাথরের ছোঁয়ায় গড়ে উঠা শহুরে জনপদ নিমিষেই মিশে যায় তাদের নিজ নিজ কর্মতৎপরতায়…

৭১ এর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ছিলো মনোহরগঞ্জবাসীর প্রত্যক্ষ ভূমিকা। ১৩ই সেপ্টেম্বর চৌমুহনীতে মুক্তিযোদ্ধাদের এক বীরত্বগাথা সম্মুখযুদ্ধে ৭০জন পাকসেনা নিহত হয়। অতঃপর আরো ছোট বড় অপারেশনে পিছু হটে হানাদারেরা। এভাবেই শত্রুমুক্ত হয় এ অঞ্চল। মুক্তিযুদ্ধাদের স্মৃতি আজীবন স্মরন রাখতে নির্মিত হয়েছে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন; হাসনাবাদে রয়েছে একটি গনকবর।

স্বাধীনতার পর হতেই শিক্ষার আলো দেখছে মনোহরগঞ্জ এর মানুষজন। বর্তমানে এ অঞ্চলের শিক্ষার হার প্রায় ৫৬ শতাংশ। রয়েছে ১টি সরকারি কলেজ সহ মোট ৪টি কলেজ, ২৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১০৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ ২৬টি মাদ্রাসা।

আইনের যথাযথ প্রয়োগে যোগাযোগ খাতে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছে এ অঞ্চল। একসময় মনোহরগঞ্জের বুক চিরে বয়ে যাওয়া ডাকাতিয়া নদীটিই ছিলো যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। তবে, বর্তমানে সড়কব্যবস্থার উন্নয়নে স্থলপথেই আসা যাওয়া করতে পারে এলাকাবাসী। নাথেরপেটুয়া রেল ষ্টেশনের কল্যাণে ট্রেনযোগেও যোগাযোগ করতে পারছে মনোহরগঞ্জবাসী। তথাপি মালামাল আনা নেয়ায় সীমিত আকারে নদীপথ ব্যবহৃত হচ্ছে। রয়েছে মোট ১১১ কিলোমিটার পাকারাস্তা সহ অভ্যন্তরীণ সড়ক ও ২১ কিলোমিটার নৌপথ।

মনোহরগঞ্জ থানা পুলিশের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় এ অঞ্চলের গ্রামীণ ও শহুরে জনপদের অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। নদীমাতৃক জনজীবন হওয়ায় এ অঞ্চলটি বিশেষত কৃষি নির্ভর। প্রধান অর্থকরী ফসল উৎপাদনের বাইরেও মৎস্য চাষ, গবাদীপশু পালন সহ, মৌসুমি ফলমূল আবাদ করে থাকেন চাষীরা। তাছাড়া, এ অঞ্চলটি ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবেও বেশ প্রসিদ্ধ। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মিল ফ্যাক্টরি থাকায় একদিকে যেমন স্থানীয় বেকার সমস্যা নিরসন হচ্ছে ঠিক তেমনি দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে মনোহরগঞ্জ বাসী।

তাদের দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে রয়েছে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সহ উপজেলা পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ইউনিয়নভিত্তিক উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক। তাছাড়া গবাদিপশুর সুচিকিৎসা নিশ্চিতে রয়েছে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল।

মনোহরগঞ্জ যেন মনোহরকর স্থাপনা গুলোর কেন্দ্রবিন্দু। এখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৪০০ বছর পুরোনো মুঘল রীতিতে তৈরি এক বিস্ময়কর পুরাকীর্তির নিদর্শন শরীফপুর শাহী জামে মসজিদ। দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদটিতে নামাজ পড়তে এবং অনিন্দ্য কারুকাজে মুখরিত হতে দূর-দুরান্ত থেকে আসেন মুসল্লিরা। ঢাকার হাতিরঝিল ব্রিজ সদৃশ খরখড়িয়া ব্রিজের অবস্থানও এ অঞ্চলে। বাইশগাও ইউনিয়নে রয়েছে নাগেশ্বর দীঘি যা কুমিল্লা জেলার সর্ববৃহৎ দীঘি হিসেবেও সুপরিচিত। এর পাশেই অবস্থিত আছে “সুলতানুল আউলিয়া সৈয়দ শাহ শরীফ বাগদাদী (রহঃ) দরগাহ শরীফ”। তাছাড়া হাসনাবাদ ইউনিয়নের কমলপুর গ্রামে এখনো ধংসাবশেষ হয়ে আছে রাখাল রাজার জমিদার বাড়ি। ১৭০০ শতাব্দীর শেষের দিকে নির্মিত পোড়ামাটির ইটের তৈরি এ বাড়িটি এখনো দেখতে আসেন নানা পর্যটক।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।