Lalmai Thana

লালমাই… নাম শুনলেই মনে আসে প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগে প্লাইস্টোসিন যুগে নির্মিত একটি বিচ্ছিন্ন পর্বতশ্রেণী লালমাই পাহাড়ের কথা। দেশের বরেন্দ্রভূমি ও ভাওয়াল গড়ের সমকালীন এই পাহাড়টির নামানুসারেই গড়ে উঠেছে একটি জনপদ ; লালমাই। ২০১৭ সালের ৯ই জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন এবং লাকসাম উপজেলার ১টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে লালমাই নামে আলাদা উপজেলা গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ফলে, লালমাই বাংলাদেশের ৪৯১তম ও কুমিল্লার ১৭তম উপজেলা এবং পরবর্তীতে ২০১৯ সালে লালমাই থানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ঢাকা থেকে ঢাকা–চট্রগ্রাম জাতীয় মহাসড়ক দিয়ে প্রায় ১০৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং কুমিল্লা জেলা সদর হতে কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণাংশে অবস্থিত একটি নবগঠিত থানা অঞ্চল লালমাই। মোট ৯টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত এ থানা অঞ্চলের ১৪৭ দশমিক শুন্য তিন বর্গ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বসবাস করেন প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার ৩২ জন মানুষ। ইউনিয়নসমূহ হলো: উত্তর বাগমারা, দক্ষিণ বাগমারা, উত্তর ভুলইন, দক্ষিণ ভুলইন, উত্তর পেরুল, দক্ষিণ পেরুল, উত্তর বেলঘর, দক্ষিণ বেলঘর, এবং উত্তর বাকই। এ থানা অঞ্চলের পূর্ব দিকে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা, পশ্চিমে বরুড়া উপজেলা, উত্তরে সদর দক্ষিণ উপজেলা এবং দক্ষিণে নাঙ্গলকোট উপজেলা অবস্থিত।

 

 

লাল মাটির লালমাই পাহাড়সারির পাদদেশে গড়ে উঠা এ জনপদটির ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় ভোর হতেই। গ্রামীণ কৃষককেরা যখন ফসল ফলাতে ব্যস্ত ঠিক তখনই শহুরে পেশাজীবিরা ছুটে চলে তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে…

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে এ অঞ্চলের রয়েছে বর্বরোচিত ইতিহাস। সেগুলোর মধ্যে কাকসা গনহত্যা, পনকুছা-ফতেহপুর গনহত্যা ও নিশ্চিন্তপুর গনহত্যা উল্লেখযোগ্য। হানাদারদের ঠেকাতে মুক্তিযোদ্ধারা লালমাই যুদ্ধ, বাগমারা যুদ্ধ, আলীশ্বর যুদ্ধ সহ বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করে। যুদ্ধে ঠিকতে না পেরে পরাস্ত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় পাঁক হায়েনারা। এভাবেই শত্রুমুক্ত হয় এ অঞ্চল। এ অঞ্চলের প্রবীণেরা আজও সাক্ষী হয়ে আছে এ ঐতিহাসিক গল্পের। শহিদদের স্মরনে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিসৌধ ও স্মৃতিফলক।

বর্তমানে ক্রমান্বয়ে সুশিক্ষিত হচ্ছে লালমাইবাসী। এ অঞ্চলে গড় শিক্ষার হার ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ। রয়েছে প্রায় ৮৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সহ বেশ কয়েকটি মাদ্রাসা। তাছাড়াও নির্মিত হচ্ছে শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেটর সেন্টার। ফলে লালমাই থানা অঞ্চলে একদিকে যেমন বেকারত্ব দূর হবে, ঠিক তেমনি তথ্যপ্রযুক্তিতেও উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধিত হবে বলে আশা করা যায়।

তাছাড়াও, আইনের যথাযথ প্রয়োগে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন লক্ষনীয় এ অঞ্চলে। ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক এবং কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের কল্যাণে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে। রয়েছে মোট ২১৪ দশমিক চার নয় কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৪০০ কিলোমিটার আধাপাকা রাস্তা সহ অভ্যন্তরীণ সড়কপথ এবং পর্যাপ্ত ব্রিজ কার্লভার্ট। রেলপথেও সার্বক্ষণিক যোগাযোগে রয়েছে আলীশহর রেলওয়ে স্টেশন ও লালমাই রেলওয়ে স্টেশন।

এ জনপদের অর্থনীতির উন্নয়ন দৃশ্যমান হচ্ছে। এ অঞ্চলের মানুষদের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি। অর্থকরী ফসলের বাইরেও বিভিন্ন ফলমূল ও শাকসবজি উৎপাদনসহ হ্যাচারি, মৎস্যচাষ ও গবাদিপশু পালন করেও জীবিকা নির্বাহ করছে গ্রামীণ জনপদ। এছাড়াও ব্যবসা, চাকরি সহ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এ থানার মানুষজন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।

লালমাইবাসীর স্বাস্থ্যসেবা সহজতর করার লক্ষে নির্মিত হয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ১টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র সহ ইউনিয়নভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক। তাছাড়া গবাদিপশুর সুচিকিৎসা নিশ্চিতে রয়েছে উপজেলা প্রানীসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল।

এ থানা এলাকায় রয়েছে অঞ্চলভিত্তিক সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন লালমাই প্রেস ক্লাব এবং দৈনিক লালমাই, জাগো লালমাই ও আজকের লালমাই সহ বেশ কয়েকটি অনলাইন গনমাধ্যম।

দর্শনীয় স্থানে মুখর লালমাই থানা অঞ্চল। লাল মাটির লালমাই দেখতে দেশ-দূরান্ত থেকে আসেন নানা পর্যটক। রয়েছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি প্রাচীন মন্দির লালমাই চন্ডী মন্দির। তাছাড়াও, লালমাই পাহাড়ের প্রথম ও একমাত্র পাহাড়ী চা বাগান মজুমদার টি গার্ডেন এর অবস্থানও এ অঞ্চলে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।