বরুড়া – বাংলার বিস্তৃত সবুজের শোভা, আধুনিক সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আবহের অপার মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা এক জনপদ। বরুড়া নামটির সাথেই মিশে আছে এ অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং মানুষের জীবনযাত্রার বিশেষত্ব। এলাকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের খেতাব হিসেবে ব্যবহার হয় বড়ুয়া। আবার এই অঞ্চলে রয়েছে প্রচুর পান চাষি যাদের চাষের জমিকে বলা হয় বরজ বা বর। তাই ধর্মীয় ইতিহাসের সাথে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মিলন ঘটিয়ে এই স্থানটির নামকরন করা হয় বরুড়া। যা একটি স্বতন্ত্র থানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৪৮ সালে এবং ১৯৮৩ সালে উপজেলায় উন্নীত হয়।

 

 

দিনের আলো ফুটে উঠতেই গ্রাম বাংলার চির সজীবতার আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতে শুরু করে নগরীর কোলাহল। কর্মজীবী মানুষের পদচারনায় যেন প্রানের স্পন্দন ফিরে পেতে শুরু করে এই বরুড়া। ঢাকা থেকে প্রায় ১০৮ কিলোমিটার এবং কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় ২৬ কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত, লালমাই পাহাড়ে ঘেরা একটি জনপদ বরুড়া। ২৪১.৬৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই অঞ্চলটিতে রয়েছে ৪ লক্ষেরও অধিক মানুষের বসবাস। থানার আওতাধীন রয়েছে মোট ১৫টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা । ইউনিয়ন সমূহ হল আগানগর, ভবানীপু্‌র, খোশবাস উত্তর, খোশবাস দক্ষিণ, ঝলম, চিতড্ডা, শাকপুর, ভাউকসার, শিলমুড়ী দক্ষিণ, শিলমুড়ী উত্তর, গালিমপুর, আড্ডা, আদ্রা, লক্ষ্মীপুর ও পয়ালগাছা।

১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে বরুড়া থানা অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা ছিল বেশ অগ্রগামী। পাক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প আক্রমণ করলে কয়েক দফায় বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা সহ প্রাণ হারান এ অঞ্চলের বহু নিরীহ জনগন। পয়ালগাছা, গালিমপুর, নারায়ণপুর, বটতলী যুদ্ধসহ বেশ উল্লেখযোগ্য কিছু সমরের পর হানাদার মুক্ত হয় বরুড়া থানা অঞ্চল।  মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের এসব স্মৃতি বহন করছে নারায়নপুরে অবস্থিত ১টি গণকবর; স্থাপন করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ এবং উপজেলা মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স ভবন।

শিক্ষাঃ

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই শিক্ষা খাতে ক্রমান্নয়ে সফলতা লাভ করছে বরুড়া থানা অঞ্চল । বর্তমানে এই এলাকার শিক্ষার হার পৌঁছেছে ৫২.১ শতাংশে। ৭টি কলেজ, ৩৬ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১টি কারিগরি কলেজ সহ তিনশোরো বেশী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বেশ কয়েকটি মাদ্রাসার মাধ্যমে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে এলাকার মানুষের মাঝে। রয়েছে পয়ালগাছা পোস্ট-গ্রাজুয়েট কলেজ, বরুড়া শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজ, শেহেরবানু আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ সহ বহু নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেখানে পাঠ্য পুস্তকের পাশাপাশি দেয়া হচ্ছে নানা বাস্তবধর্মী ও জীবনমুখী শিক্ষা।

কৃতি সন্তানঃ

কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার আড্ডা গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেছেন অত্র এলাকার কৃতি সন্তান, কুমিল্লা-৮ আসনের সংসদ সদস্য  ও এসকিউ গ্রুপ অ্যান্ড ফাউন্ডেশনের চেয়ারমান এ জেড এম শফিউদ্দিন শামিম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিং বিষয়ে প্রথম শ্রেনিতে স্নাতক ও স্নাতকত্তর এবং ওয়েস্ট স্কটল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত অবস্থায়ই তিনি ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর থেকেই তিনি এ এলাকার সার্বিক উন্নয়ন পরিস্থিতিকে পূর্বের তুলনায় আরও বেগবান করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান নিরাপত্তাসহ বহুমুখী সুবিধাকে মাথায় রেখে বরুড়ার মেধাবি ও ভূমিহীনদের বিনামূল্যে আবাসন নিশ্চিতের জন্য তিনি বরুড়া থানা অঞ্চলে ৪ একর জমিতে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছেন “বরুড়া স্বপ্নের আশ্রয়ন” প্রকল্প। এমনকি এই প্রকল্পের ২য় পর্যায়ের  কাজও শুরু হতে যাচ্ছে। এছাড়াও করোনা কালীন সময়ে খ্যাদ্য সামগ্রী বিতরন, বিনামূল্যে অক্সিজেন ও চিকিৎসা সামগ্রী বিতরন, করোনা আইসোলেশন সেন্টার সহ নানা ধরণের সেবা মূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দিন শামীম । এলাকার কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, শিক্ষা, ধর্মীয় ও মানবিক কর্মকাণ্ডেও তাঁর অবদান বেশ প্রশংসনীয়। এর পাশাপাশি তার প্রতিষ্ঠিত এস কিউ ফাউণ্ডেশন বরুড়াবাসীর জন্য চালু করেছে নিয়মিত অনুদান প্রকল্প। তার নানাবিধ উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের ফলে বড়ুরাবাসীর চোখে ফুটছে আশার আলো।

যোগাযোগঃ

বর্তমানে বরুড়া থানা অঞ্চলের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় এলাকার যোগাযোগ ব্যাবস্থায়ও এসেছে আমূল পরিবর্তন। এলাকাটিতেও গড়ে উঠছে প্রশস্ত পাকা রাস্তা, রেলপথ সহ অসংখ্য ব্রিজ ও কালভার্ট। তবে যোগাযোগের এই সুব্যাবস্থাকে কাজে লাগিয়ে নানান সময় বিভিন্ন ধরণের অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ড সংগঠিত হতে দেখা গেছে। তবে বরুড়া থানা পুলিশের যুগান্তকারী পদক্ষেপে তা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা

অর্থনীতিঃ

বরুড়া থানা পুলিশের নিবিড় তত্ত্বাবধায়নে এই এলাকার মানুষ সাচ্ছন্দে তাদের জীবনযাত্রা পরিচালনা করে আসছেন। এখানকার প্রায় ৫৫ শতাংশ মানুষই সংযুক্ত কৃষি পেশার সাথে। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই কৃষির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। গ্রামীন আবহের সরল জনজীবনের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত বয়ে চলছে নগরীর ব্যাস্ত জনজীবন। কৃষি পেশার বাইরেও দেখা মেলে ব্যাবসায়ি ও চাকরিজীবী মানুষের আনাগোনা। এছাড়া এ অঞ্চলের একটি বৃহৎ অংশ প্রবাসে থাকায় রেমিটেন্স যোগ হচ্ছে দেশের অর্থনীতিতে।

স্বাস্থ্য

বরুড়াবাসীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে রয়েছে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট ১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ১টি ক্লিনিক, ১৫টি পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ৫টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ১৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক। এছাড়াও গবাদীপশুর চিকিৎসায় রয়েছে উপজেলা প্রানিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেনারি হাসপাতাল।

দর্শনীয় স্থানঃ

বরুড়া থানা অঞ্চল একটা সময় ছিল জমিদার অধ্যুষিত এলাকা। যার নিদর্শন স্বরুপ বরুড়ার ভাউকসারে আজও টিকে আছে নবাব ফয়জুন্নেসার স্থাপিত মসজিদ। যেখানে এখনও নিয়মিত নামাজ আদায় করেন এলাকার মুসল্লিরা। এছাড়াও ওড্ডা ফতেহ খাঁ মসজিদ, চিতড্ডা জামে মসজিদ, পীর ফানাউল্লাহ সাহেবের মাজার, লগ্নসার আনন্দ বৌদ্ধ বিহার, চণ্ডীমুড়া সেবাশ্রম, শিব ও চণ্ডীর মন্দির এবং রহিতগিরি তপবন বৌদ্ধ বিহার এখানকার অন্যতম দর্শনীয় স্থান।

প্রেসক্লাব

বরুড়া থানা এলাকায় রয়েছে সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন বরুড়া প্রেস ক্লাব। এখানে রয়েছে সাপ্তাহিক টেলিফোন, সাপ্তাহিক বরুড়া কণ্ঠ, বরুড়া প্রতিদিন সহ বেশ কিছু গনমাধ্যম। যারা এ এলাকায় নির্বিঘ্নে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।