Anwarra Thana

পেঁজা তুলোর মত মেঘে ঢাকা রূপবৈচিত্র‍্যে পরিবেষ্টিত চট্টগ্রামের প্রাচীন জনপদটির নাম আনোয়ারা। সাঙ্গু নদীর উত্তর-পশ্চিমে এবং কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগরের পূর্বে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা আনোয়ারা অঞ্চলের চারপাশে রয়েছে সাজানো ফসলের মাঠ ও উঁচুনিচু বৃক্ষের সমারোহ।

 

আনোয়ারা অঞ্চলকে ঘিরে রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। এ অঞ্চলটি একসময় দেয়াঙ নামে পরিচিত ছিল। সেসময় দেয়াঙ ছিল আরাকান রাজ্যের রাজধানী। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, ১৫৯৩ সালে মেং রাজ্যাগী আরাকান রাজ্যে এবং তার আপন ভাই আনাপোড়ম দেয়াঙে ক্ষমতায় আসীন হন। তবে, পরস্পরের মধ্যে মতবিরোধ হওয়ায় আরাকানের রাজা প্রায় আশি হাজার সৈন্য ও সাত হাজার লড়াকু হাতি নিয়ে দেয়াঙে আক্রমণ করেন। এ ভয়াবহ যুদ্ধে আনাপোড়ম প্রচণ্ড আহত হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে বর্তমান সন্দ্বীপে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। আরাকানীদের আঘাতে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া আনপোড়মের রাজকার্যালয়টিকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলটির নামকরণ হয় আনাপোড়া। পরে লোকমুখে আনাপোড়া থেকে আনোয়ারা নামে পরিচিত হতে থাকে।

 

 

ঢাকা থেকে প্রায় ২৭২ কিলোমিটার ও চট্টগ্রাম জেলা সদর থেকে মাত্র ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অঞ্চল আনোয়ারা। আনোয়ারার উত্তরে পটিয়া, দক্ষিণে বাঁশখালী, পূর্বে চন্দনাইশ ও পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর রয়েছে। এ অঞ্চলটি চট্টগ্রাম নগরীর লাইফলাইন খ্যাত কর্ণফুলী নদীবিধৌত অঞ্চল হওয়ায় এর তাৎপর্য আরো দৃশ্যমান। উল্লেখ্য, নয়নাভিরাম ও সুগভীর কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল আনোয়ারা থানা অঞ্চল থেকেই শুরু হয়েছে। তাই ১৬৪.১০ বর্গকিলোমিটার নিয়ে গড়ে উঠা এ জনপদের প্রায় ২ লাখ ৫৯ হাজার মানুষ আনোয়ারাকে নিয়ে দেখছে নতুন স্বপ্ন, কারণ বাণিজ্য ও যোগাযোগ খাতের ক্রমবর্ধমান উন্নতির কারণে আনোয়ারা এখন হয়ে উঠেছে একটি আধুনিক উপশহর। তাছাড়া চট্টগ্রামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভৌগোলিক অবস্থানে থাকায় আনোয়ারা থানা অঞ্চল একই সঙ্গে চট্টগ্রামের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোকে সংযুক্ত করেছে।

চট্টগ্রাম রেঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক এলাকা আনোয়ারাকে ১৮৭৬ সালে চট্টগ্রামের দ্বিতীয় থানা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে, ১৯৮৩ সালে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সময় আনোয়ারা থানাকে উপজেলায় রূপান্তরিত করা হয়। বর্তমানে আনোয়ারা উপজেলায় ১১ টি ইউনিয়ন, ৮০ টি মৌজা ও ৮১ টি গ্রাম রয়েছে। ইউনিয়ন গুলো হলো, বারশত, রায়পুর, বটতলী, বরুমছড়া, বারখাইন, আনোয়ারা, চাতরী, পরৈকোড়া, হাইলধর, বৈরাগ ও জুঁইদণ্ডী। তবে উপজেলাধীন বৈরাগ ইউনিয়নের কিছু অংশ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কর্ণফুলী থানার আওতায় রয়েছে।

যুগের পালাবদলে অনেকদূর এগিয়েছে আনোয়ারা। তবে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে আনোয়ারার বীরত্ব গাঁথা ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান আজও দাগ কাটে সকল শ্রেনীপেশার মানুষের হৃদয়ে। সেই রণাঙ্গনে ১ নম্বর সেক্টরের অধীনে থাকা আনোয়ারা অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবময় অবদান এখনো ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের দুর্গম সময়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর কাফকো, কালীগঞ্জ, পরৈকোড়া প্রভৃতি জায়গায় বেশকিছু লড়াই সংঘটিত হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের কঠুর আক্রমণে বহু পাকিস্তানি হানাদার গায়েল হয়। সে সময় প্রায় ৫৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সেসব নির্মম ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে রয়েছে আনোয়ারা অঞ্চলের কর্ণফুলি ফার্টিলাইজার কোম্পানি, পারৈকোড়া ও কালীগঞ্জ বধ্যভূমি। আনোয়ারা অঞ্চলে সংঘটিত হানাদারদের বর্বরোচিত হামলার ইতিহাস আনোয়ারার জনমানুষের হৃদয়ে চিরকাল অক্ষুণ্ণ হয়ে থাকবে।

তবে স্বাধীনতার পরে ধীরে ধীরে আনোয়ারা অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা সচল হয় কৃষিকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে এ অঞ্চলের ৪১.২৫ শতাংশ মানুষ কৃষি পেশার সাথে জড়িত। ধান, আলু ও শাকসবজিই এ অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য শস্য। তবে কিছুদিন ধরে আনোয়ারা থানা অঞ্চলে ভুট্টা চাষে ব্যাপক সাফল্য পাওয়ায় অনেক কৃষক ভুট্টা চাষ করতে আগ্রহ পাচ্ছে। এছাড়াও গবাদি পশু পালন ও মৎস্য চাষ করে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আরও বেগবান হচ্ছে। গহীরা সমুদ্র সৈকতের তীরে জাল বোনার মহোৎসবে এ অঞ্চলের মৎস্য চাষীরা হয়ে ওঠেন শিল্পীর মতো। আনোয়ারা অঞ্চলে প্রায় ৩৪ টি হাট-বাজার রয়েছে। কৃষকদের উৎপন্ন বিভিন্ন ফসল ও শাকসবজি স্থানীয় হাট-বাজারগুলোতে বিক্রি করা হয়।

আনোয়ারা বর্তমানে ক্রমশ শিল্পনগরী হয়ে উঠছে। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এলাকায় এবং কর্ণফুলী নদীর কোল ঘেষে গড়ে উঠছে বিভিন্ন কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান। এখানেই গড়ে উঠেছে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন – কেইপিজেড। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদিত পন্য বিদেশে বাজারজাত করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা রাখছে এ অঞ্চল। তাছাড়া এখানে রয়েছে বিদ্যুত স্টেশন, চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার  সার কারখানা, সহ অসংখ্য মিল ফ্যাক্টরি, রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও পারকি সমুদ্র সৈকতের আশপাশের উন্নত রাস্তাঘাট ও পর্যটকদের জন্য তৈরি বহুতল মোটেলগুলো এ অঞ্চলে পর্যটনশিল্পেরও প্রসার ঘটিয়েছে। তা-ই, পর্যটন, নির্মাণ, চাকরি, রেমিটেন্স ইত্যাদি কোনো খাতেই পিছিয়ে নেই আনোয়ারার জনসাধারণ।

আনোয়ারা দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী একটি উপজেলা। এখানে, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী সুদীর্ঘ কালধরে শান্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস করছেন। অসাম্প্রদায়িক এই অঞ্চলে প্রায় ৩৬৫ টি মসজিদ, ৮৩ টি মন্দির ও ৮ টি বিহার রয়েছে। তন্মধ্যে হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ:) এর মাজার, দেয়াং পাহাড়ের বিহার, মনু মিয়ার মসজিদ প্রভৃতি বহু ঐতিহাসিক ও বিখ্যাত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে আনোয়ারাতে। এছাড়াও শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমানে এসেছে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। এ অঞ্চলে শিক্ষার হার প্রায় ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ। আনোয়ারা সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন কলেজ, ২২ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৮৮ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং বেশ কয়েকটি আলিম ও ফাযিল মাদ্রাসা রয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা সদর থেকে দূরত্ব কম হওয়ায় আনোয়ারা অঞ্চলে যোগাযোগ খাতেও এসেছে অতুলনীয় পরিবর্তন। আনোয়ারা অঞ্চলে ঢোকার পথে শাহ আমানত সেতু চট্টগ্রাম মহানগরীর সঙ্গে যাতায়াত সুবিধা সুগম করেছে। চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে কর্ণফুলী নদীযোগে নৌপথেও যাতায়াতের সুব্যবস্থা রয়েছে। তবে আনোয়ারা অঞ্চলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যোগাযোগ সুব্যবস্থা হলো বঙ্গবন্ধু টানেল। এ টানেলের ফলে আনোয়ারা হয়ে উঠেছে একটি নতুন উপশহর। বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের ফলে সারা বিশ্ব এখন চট্টগ্রামের পাশাপাশি আনোয়ারাকে চিনছে নতুনভাবে।

আনোয়ারার বর্তমান যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে সহায়তা করছে, তেমনি জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতেও ব্যপক ভূমিকা রাখছে। আনোয়ারা থানা অঞ্চলে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট ১ টি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ১ টি উপজেলা পরিবার কেন্দ্র ও ৮ টি ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র রয়েছে। তাছাড়া উপজেলাভিত্তিক জনকল্যাণমুখী নানা সরকারি দাপ্তরিক প্রতিষ্ঠান যেমন, উপজেলা পরিষদ, উপজেলা ভূমি অফিস, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন রয়েছে এ অঞ্চলে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।