Ashuganj

আশুগঞ্জএকদিকে ক্রমবর্ধমান শিল্পনগরী ও মেঘনার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক নদীবন্দর অপর দিকে ফসলী মাঠ আর সারি সারি বাগানে ঘেরা গ্রামীণ বাংলার আবহে বয়ে চলা একটি জনপদ। সব মিলিয়ে বর্তমান আশুগঞ্জ যেন অপরুপ বাংলার রূপে সজ্জিত এক আধুনিক নগরী। বহুকাল আগে থেকেই এ অঞ্চলটি আউশ ধান উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল। আশু শব্দের অর্থ আউশ ধান আর গঞ্জ শব্দের অর্থ হাটবাজার বা লোকালয়। তাই ধারনা করা হয় আশু ও গঞ্জ শব্দ দুটির সন্ধিতেই উৎপত্তি হয়েছে আশুগঞ্জ নামটির। ১৯৮৪ সালের ২৮ নভেম্বর আশুগঞ্জ একটি থানা হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ২০০০ সালের ২৫শে জুলাই তা উপজেলায় উন্নীত হয়।

 

 

অবস্থানঃ

মেঘনা কন্যা খ্যাত আশুগঞ্জ থানা অঞ্চলটি রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৮৩ কিলোমিটার উত্তর পূর্বাংশে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত। যার পূর্বদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা, পশ্চিমে মেঘনা নদী ও কিশোরগঞ্জের ভৈরব এবং নরসিংদী’র রায়পুর উপজেলা, উত্তরে সরাইল উপজেলা ও দক্ষিণে নবীনগর উপজেলার অবস্থান। ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী ৬৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এলাকাটিতে বসবাস করেন প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার ৬৫৪ মানুষ। বর্তমানে এ থানা অঞ্চলটি মোট ৮টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত। ইউনিয়ন সমূহ হল আড়াইসিধা, তারুয়া, আশুগঞ্জ সদর, দুর্গাপুর, চর চারতলা, পশ্চিম তালশহর, লালপুর ও শরিফপুর।

মুক্তিযুদ্ধঃ

৭১এর মহান মুক্তিযুদ্ধে এ অঞ্চলের মানুষকে দিতে হয়েছে বহু আত্মত্যাগ। রচিত হয়েছে গৌরবোজ্জ্বল বীরত্বগাঁথা। সেসময় পাকবাহিনী এ এলাকার সাধারন মানুষদের ধরে এনে সাইলো বধ্যভূমিতে নির্যাতন করে হত্যা করত। এরপর মুক্তিবাহিনীর একের পর এক হামলায় পিছু হটতে থাকে হানাদাররা। সবশেষ ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি যুদ্ধে প্রান হারান অন্তত ৭০ জন। ১০ ডিসেম্বর হানাদাররা এলাকা ত্যাগ করলে শত্রু মুক্ত হয় আশুগঞ্জ। স্বাধীনতা যুদ্ধের এসব আত্মত্যাগের ইতিহাস চির স্বরনীয় করে রাখতে নির্মিত হয়েছে সাইলো বধ্যভূমি, লালপুরে একটি গনকবর, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি ফলক ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন।

শিক্ষাঃ

বর্তমানে এ অঞ্চলের শিক্ষার মানোন্নয়নে কোমলমতী শিশু-কিশোরদের বিশেষ নজর দেয়া  হচ্ছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি আনুযায়ি এ এলাকার শিক্ষার হার ছাড়িয়েছে ৫১ শতাংশে। স্থাপিত হয়েছে বেশ কিছু নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রয়েছে ফিরোজ মিয়া সরকারি কলেজ, বঙ্গবন্ধু কারিগরি মহাবিদ্যালয় সহ ৪টি কলেজ, ১৪টি উচ্চ বিদ্যালয়, ৪৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ বেশ কিছু মাদ্রাসা।

যোগাযোগঃ

আইন শৃঙ্খলার সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকায় আশুগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এ অঞ্চল দিয়েই বয়ে গেছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও লালপুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক। এছাড়া পার্শ্ববর্তী উপজেলা ভৈরব সহ ঢাকা বিভাগের সাথে সরাসরি যোগাযোগের সুবিধার্থে মেঘনা নদীর উপরে নির্মিত হয়েছে ভৈরব সেতু বা বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য মৈত্রী সেতু যেটি ২০১০ সালে নাম পরিবর্তন করে জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের নামে নামকরণ করা হয়। সেতুটির পাশেই নির্মিত হয়েছে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রাহমান রেলওয়ে সেতু এবং আশুগঞ্জ-ভৈরব রেলওয়ে ব্রিজ। রয়েছে আশুগঞ্জ রেলওয়ে ষ্টেশন এবং তালশহর রেল স্টেশন যা ব্যবহার করে দূরপাল্লায় যাতায়াত করেন এ এলাকার বিপুল সংখ্যক মানুষ। তাছাড়া নদী বিধৌত থানা অঞ্চল হওয়ায় এখানে রয়েছে নৌপথে যাতায়াতের বাড়তি সুবিধা। রয়েছে ৭ কিলোমিটার রেলপথ, মোট ৪৭ কিলোমিটার পাকারাস্তা, ১২ কিলোমিটার আধা-পাকা রাস্তা সহ আঞ্চলিক সড়কপথ এবং ১৪ কিলোমিটার নৌপথ।

অর্থনীতিঃ

আশুগঞ্জ থানা পুলিশের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় এ থানা অঞ্চলের মানুষ বেশ সাচ্ছন্দেই তাদের জীবনমান পরিচালনা করে আসছেন। অঞ্চলটির অর্থনীতি মূলত শিল্প ও ব্যবসা নির্ভর হলেও এখানে রয়েছে নানা পেশার মানুষের বসবাস। মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষই শিল্প ও ব্যবসা খাতে জড়িত হওয়ায় এখানে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক কেন্দ্র। এর পাশাপাশি এখানকার মোট জনগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ অংশ কৃষি পেশার সাথেও সম্পৃক্ত রয়েছেন। আশুগঞ্জে মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের আধিক্য থাকায় এখানে মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে শুঁটকি পল্লী। এখানকার উৎপাদিত শুঁটকি পৌঁছে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এ অঞ্চলটি মূল্যবান প্রাকৃতিক গ্যাসে পরিপূর্ণ। রয়েছে বেশ কয়েকটি গ্যাস ক্ষেত্র ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এই আশুগঞ্জ। দেশের অন্যতম বৃহৎ সেচ প্রকল্প আশুগঞ্জ সবুজ প্রকল্পের অবস্থানও আশুগঞ্জেই। এছাড়া মেঘনা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক নদীবন্দর ব্যবহার করে দেশ ও দেশের বাইরে পন্য পরিবহন সহজতর হয়েছে।

স্বাস্থ্য

আশুগঞ্জ থানা অঞ্চলের মানুষের সার্বিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে রয়েছে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। রয়েছে ১টি উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ৮টি কমিউনিটি ক্লিনিক, ৬টি পরিবার কল্যান কেন্দ্র ও ৩টি ক্লিনিক। পশুপাখির স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে রয়েছে উপজেলা প্রানিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরেনারি হাসপাতাল। আশুগঞ্জ থানা অঞ্চলে রয়েছে স্থানীয় সাংবাদিকদের সম্মিলিত সংগঠন আশুগঞ্জ প্রেস ক্লাব।

দর্শনীয় স্থানঃ

মেঘনা নদীর বদ্বীপ আশুগঞ্জে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও স্থাপনা। নদীর পাড়ে একই স্থানে দেখতে পাওয়া যায় রেল ব্রিজ ও হাইওয়ে ব্রিজ যেখানে প্রায়শই ভীর জমায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দর্শনার্থী। রয়েছে মেঘনার বুকে জেগে উঠা চর সোনারামপুর দ্বীপ যার অপরূপ গ্রামীণ দৃশ্য মুগ্ধ করবে যে কাউকেই। এছাড়া আরও রয়েছে রহিছ শাহ মাইজভাণ্ডারীর মাজার ও হজরত আলাল শাহ (রঃ) এর মাজার।

কৃতিসন্তানঃ

আশুগঞ্জের আড়াইসিধা ইউনিয়নেই জন্মগ্রহন করেন প্রখ্যাত কবি আব্দুল কাদির। তার অসামান্য সাহিত্য কর্মের জন্য তিনি পেয়েছেন একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, বাংলা একাডেমী পুরস্কার সহ বহু স্বীকৃতি ও সম্মাননা।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।