Bhujpur Thana

দুদিকে উঁচুনিচু পাহাড় আর মধ্যভাগে এক টুকরু জনপদ নাম ভূজপুর। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এ অঞ্চলটি যেন প্রকৃতির অবারিত সৌন্দর্যের আধার। হালদা নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠা ভূজপুর থানা অঞ্চলটি একদিকে যেমন প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে ভরপুর, অন্যদিকে ঘন সবুজে চাদরে ঘেরা চা বাগান মুগ্ধ করে সকল শ্রেনীর মানুষদের।

ভূজপুর অঞ্চলের নামকরণে রয়েছে একটি বিশেষ কল্পকাহিনী। লোকমুখে জানা যায়, খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কোন এক ভোজ রাজা এ অঞ্চলটির শাসনকর্তা ছিলো। সেই রাজার নামানুসারেই এ অঞ্চলটির নাম ভূজপুর হিসেবে সমাদৃত হতে থাকে।

ভূজপুরের প্রাচীন ইতিহাসও বেশ সমৃদ্ধ। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার শাসনকর্তা সুবেদার শায়েস্তা খানের পুত্র উমেদ আলী খাঁ আরাকান রাজাকে পরাজিত করে চট্রগ্রাম দখল করে ইসলামাবাদ নামে নামকরণ করেন। অতঃপর বৃহত্তর চট্রগ্রামকে ৭ টি ভাগে ভাগ করে ৭ টি পরগণার সৃষ্টি করেন। বাংলার ১২ ভূঁইয়াদের অন্যতম ঈসা খাঁ ফটিকছড়িসহ বর্তমান ভূজপুর অঞ্চলকে “ইছাপুর পরগণা” হিসেবে নামকরণ করেন। সেই ইছাপুর পরগণাই পরবর্তীকালে ফটিকছড়ি এবং ভূজপুর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে । বর্তমানে ভূজপুর থানাটি ২০০৭ সালের ২১শে জুলাই ফটিকছড়ি থানা অঞ্চল থেকে বিভক্ত হয়ে থানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

 

 

ঢাকা থেকে ২২২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং চট্রগ্রাম জেলা শহর হতে প্রায় ৫০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত একটি প্রাচীন ভূজপুর। ভূজপুর থানা অঞ্চলটি ফটিকছড়ি উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের সংমিশ্রনে গঠিত একটি জনপদ। ইউনিয়ন সমূহ হলো বাগানবাজার, দাঁতমারা, নারায়ণহাট, ভূজপুর, হারুয়ালছড়ি এবং সুয়াবিল। নারায়নহাট ও সুয়াবিল ইউনিয়নের মধ্যভাগদিয়ে বয়ে গেছে এশিয়ার সর্ববৃহৎ মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদী। তাছাড়া এ অঞ্চলের চারদিকে উঁচু নিচু ঢালু পাহাড়ে ছেয়ে গেছে রাশি রাশি চা বাগান। বাংলাদেশের ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে প্রায় ১৮টি চা বাগানের অবস্থান ভূজপুর থানা অঞ্চলে। এছাড়াও, ভূজপুরে রয়েছে তারাকো রাবার বাগান এবং দাঁতমারা রাবার বাগান নামে ২ টি রাবার বাগান। তন্মধ্যে, ৪ হাজার ৫০০ একর জুড়ে বিস্তৃত দাঁতমারা রাবারটি এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ রাবার বাগান হিসেবে স্বীকৃত।

ভূজপুর থানা অঞ্চলের পূর্ব দিকে খাগড়াছড়ি উপজেলার মানিকছড়ি এবং চট্রগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলা পশ্চিমে মিরসরাই ও সীতাকুন্ড উপজেলা উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য এবং দক্ষিণে হাটহাজারী উপজেলা অবস্থিত।

১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ভূজপুরের অবদান চিরস্মরনীয়। ভূজপুর ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায়, মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে সশস্ত্র প্রশিক্ষনে যাওয়ার জন্য এই পথকেই বেছে নিতো। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিসেনার দল। বিভিন্ন ছোট-বড় অপারেশন, সম্মুখযুদ্ধসহ গেরিলা আক্রমনে ক্রমশই পিছু হটতে শুরু করে পাক হানাদার বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহস এবং স্বাধীনতা অর্জনের প্রবল ক্ষুদা আরো তীব্র হতে থাকলে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এভাবেই এ অঞ্চলটি শত্রুমুক্ত হয় এবং ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় উদযাপন করে।

বর্তমানে ভূজপুর থানা অঞ্চল ক্রমশ উন্নয়নশীল হয়ে উঠছে। সর্বশেষ আদমশুমারীর তথ্যানুসারে এ অঞ্চলের জনসংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার। এ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর প্রধান আয়ের উৎস কৃষি। ধান, আলু পিয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় শাকসবজি উৎপাদন করে এ অঞ্চলের কৃষকরা, যা তারা তাদের খাদ্যচাহিদা পূরন করে জেলা সদর সহ বিভিন্ন অঞ্চলে বাজারজাত করে থাকে। তাছাড়া গবাদিপশু পালন, হ্যাচারী, মৎস্যচাষেও এ থানা অঞ্চলের মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কৃষিকাজের বাইরে এ অঞ্চলের গড়ে উঠেছে বিভিন্ন চা শিল্প এবং রাবার শিল্প প্রতিষ্ঠান। উঁচুনিচু টিলা পাহাড়গুলোতে বানিজ্যিকভাবে চায়ের চাষ ব্যপক হারে লক্ষনীয়। ভোর হতেই সাড়ি সাড়ি চা শ্রমিকের মেলা আর পাখির কিচিরমিচির ডাক যেনো প্রকৃতির এক অপরূপ মেলবন্ধন। এছাড়াও এশিয়ার সর্ববৃহৎ রাবার বাগান দাতমারা রাবার বাগানে উৎপাদিত রাবার প্রস্তুত ও বাজারজাতকরণ সহ বিদেশে রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ভূজপুরবাসী।

বর্তমানে ভুজপুর থানা অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই প্রশংসনীয়। ভুজপুর দিয়েই বয়ে গেছে দুটি আঞ্চলিক মহাসড়ক । একটি আঞ্চলিক মহাসড়ক হেয়াকো এলাকা হয়ে খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলায় এবং অন্য আরেকটি মহাসড়ক বারৈয়ারহাট হয়ে ঢাকা চট্রগ্রাম জাতীয় মহাসড়কে মিলিত হয়েছে। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী থানা অঞ্চল মীরসরাই এবং সীতাকুন্ডে নির্বিঘ্নে যোগাযোগের জন্য জেলা সড়ক নির্মিত হয়েছে। এছাড়াও ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ নাজিরহাট-কাজিরহাট সড়ক এবং ৮ দশমিক ৬৪ কিলোমিটার কাজিরহাট-গাড়িটানা সড়ক ভুজপুরবাসীর যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

যোগাযোগের সুব্যবস্থা থাকায় স্বাস্থ্যখাতেও অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী ক্লিনিক সহ বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। এছাড়াও এ অঞ্চলে ভূমি অফিস, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের হেয়াকো বীজ বাগান কেন্দ্র সহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারী পরিদপ্তর রয়েছে।

অসাম্প্রদায়িক ভুজপুরে বসবাস করে নানা ধর্মাবলম্বীর মানুষ। তবে ভুজপুর একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপদ। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের সম্মিলিত বসবাস এ অঞ্চলে। ধর্মীয় উপাসনার জন্য রয়েছে প্রায় ২০০ মসজিদ, বেশ কয়েকটি প্যাগোডা ও গির্জাসহ প্রায় ৫০টিরও বেশী মন্দির রয়েছে। তাছাড়া শিক্ষাব্যবস্থায় আশার ফুল ফুটতে শুরু করেছে এ অঞ্চলে। ভুজপুর থানায় মোট ১৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৫টি মাদ্রাসা, প্রায় ১০০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ, ৬টি কিন্ডারগার্টেন, ১ টি স্কুল এন্ড কলেজ এবং ২টি ডিগ্রি কলেজ রয়েছে।

ভূজপুর থানা অঞ্চল এখন উন্নয়নের ছোঁয়া পেতে যাচ্ছে। চা ও রাবার শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন উৎপাদন শিল্প প্রতিষ্ঠান। সেসব শিল্প প্রতিষ্টানগুলোতে চা ও রাবার শ্রমিক সহ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত আছে ভুজপুর অঞ্চলের মানুষ।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।