Brahmanbaria Sadar

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর… একদিকে সবুজ প্রান্তর, দুধারে বয়ে যাওয়া তিতাস নদী আর মধ্যভাগে ইট-পাথরে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ নগরী। অঞ্চলটির নামকরণের পিছনে বেশ কিছু জনশ্রুতি থাকলেও ধারনা করা হয়, একসময় এ এলাকায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বেশ আধিক্য ছিলো। তবে, তাদের পূজা-পার্বণ সম্পাদনার জন্য ব্রাহ্মণ গোত্রের অভাব দেখা দেয়। ফলে, এ অঞ্চলের তৎকালীন রাজা কলকাতা থেকে কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবার এনে এখানে বসবাসের ব্যবস্থা করেন। তারা শহরের কাজীপাড়া ও কান্ধীপাড়া এলাকায় তাদের বাসস্থান ঠিক করলে সে সময় থেকেই এই এলাকাটি কালক্রমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৮৬৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর এলাকাটি পৌর শহরে রুপান্তরিত হয়। পরবর্তীতে দেশভাগের পর ১৯৮৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে সদর মডেল থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়।

 

 

অবস্থানঃ

রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১১০ কিলোমিটার উত্তরপূর্বাংশে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রানকেন্দ্রে অবস্থিত বৈচিত্র্যময় একটি জনপদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর। এ অঞ্চলের পূর্বদিকে আখাউড়া ও বিজয়নগর উপজেলার একাংশ ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পশ্চিমে আশুগঞ্জ ও নবীনগর উপজেলা, উত্তরে সরাইল ও নাসিরনগর উপজেলা এবং দক্ষিণে আখাউড়া ও কসবা উপজেলার অবস্থান। ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী ২৩৭ দশমিক ৩৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ থানা অঞ্চলে বসবাস করে প্রায় ৫ লক্ষ ২১ হাজার ৯৯৪ জন মানুষ। বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানা এলাকাটি ১টি পৌরসভা ও ১১টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত। ইউনিয়ন সমূহ হল মজলিশপুর, বুধল, সুহিলপুর, পূর্ব তালশহর, উত্তর নাটাই, দক্ষিন নাটাই, রামরাইল, সুলতানপুর, বাসুদেব, মাছিহাতা ও সাদেকপুর।

মুক্তিযুদ্ধঃ

৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে এ অঞ্চলের রয়েছে বর্বরোচিত ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক হায়েনারা এলাকার কাউতলী, পৈরতলা, সিঙ্গারবিল, নাটাই, মজলিশপুর, বিজেশ্বর, রামরাইল এবং আটলা সহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২০৪ জন নিরীহ লোককে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদেরকে প্রতিরোধের লক্ষে মুক্তিযোদ্ধারা এলাকার বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তুললে ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর শুত্রুমুক্ত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর। তাদের বীরত্বের স্মৃতি চিরস্মরণীয় করে রাখতে নির্মিত হয়েছে সৌধ হিরন্ময়, শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ, ভাস্কর্য এবং সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন।    

শিক্ষাঃ 

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের শিক্ষার মানোন্নয়নে গৃহীত হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এ থানা অঞ্চলের শিক্ষার গড় হার ৫৩ শতাংশ। রয়েছে বেশ কিছু স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারী কলেজসহ ১০টি কলেজ, পুলিশ লাইন উচ্চবিদ্যালয় ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় সহ ৫৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, প্রায় ২৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩৬টি কিন্ডার গার্টেন ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রাহমান প্রতিষ্ঠিত সুহিলপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা সহ বেশ কিছু নামকরা মাদ্রাসা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাবলিক লাইব্রেরি, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাঠাগার।

যোগাযোগঃ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া মডেল থানা পুলিশের তৎপরতায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসতে শুরু করেছে দৃশ্যমান উন্নয়ন। এ অঞ্চল দিয়েই বয়ে গেছে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। তাছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের কল্যাণে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ সুবিধা অব্যহত আছে। ফলে, দেশের নানা প্রান্তে সহজেই যাতায়াত করতে পারছে থানাবাসী। নির্মিত হয়েছে ১৪০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা সহ আঞ্চলিক সড়কপথ, ৩২ কিলোমিটার রেলপথ ও ৪০ কিলোমিটার নৌপথ।

অর্থনীতিঃ

থানা পুলিশের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে এ অঞ্চলের মানুষ বেশ সচ্ছলতার সাথেই তাদের জীবনমান পরিচালনা করে আসছেন। গ্রামীণ ও শহুরে আবহের মিশেলে গড়ে ওঠা এ জনপদটির অধিকাংশ মানুষের পেশাই কৃষির সাথে সম্পৃক্ত। তবে, শহরাঞ্চলের উল্লেখযোগ্য মানুষজন ব্যবসা ও চাকরিতে নিযুক্ত রয়েছেন। এছাড়াও প্রায় অধিকাংশ পরিবারেই প্রবাসী সদস্য থাকায় দেশের রেমিট্যান্স অর্জন করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে থানাবাসী।

স্বাস্থ্য

তাদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে রয়েছে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সহ প্রায় ২০টি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান কেন্দ্র এবং ৩টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও বেশ কিছু ক্লিনিক। তাছাড়া গবাদি পশুর স্বাস্থ্য সেবায় রয়েছে উপজেলা প্রানীসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল।

প্রেসক্লাবঃ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানা অঞ্চলে রয়েছে সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব। রয়েছে দৈনিক ফ্রন্টিয়ার, দৈনিক সরোদ, আজকের ব্রাহ্মণবাড়িয়া সহ বেশ কিছু পত্রিকা ও সংবাদ মাধ্যম।

কৃতিসন্তানঃ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানা অঞ্চলটি দেশবরেণ্য বহু রথি মহারথীদের জন্মস্থান। এখানেই জন্মগ্রহন করেছেন বিশিষ্ট ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এছাড়া প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, জাতীয় বীর আব্দুল কুদ্দুস মাখন, বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আয়েত আলি খাঁ এবং ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নামক বিখ্যাত উপন্যাসটির লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্মস্থানও এ থানা অঞ্চলে।

দর্শনীয় স্থানঃ

এখানেই রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান ও বিনোদন কেন্দ্র। রয়েছে প্রায় ৩৬১ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত ১ গম্বুজ বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ভাদুঘর শাহী মসজিদ। জিন্দাপীর মুহম্মদ আওরঙ্গজেব আলমগীরের শাসনামলে মুঘল রীতিতে তৈরি এ মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী মুগ্ধ করে মুসল্লীদের। এর সামনে বিশাল ঈদগাহ ময়দানে প্রতি ঈদে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। রয়েছে ১৭২৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উলচাপাড়া শাহী জামে মসজিদ। আরও রয়েছে ৪০ শতকের শেষ দশকে নির্মিত আধুনিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে উঠা সুহাতা জামে মসজিদ। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রাচীনতম স্টেডিয়াম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা স্টেডিয়াম বা নিয়াজ মোহাম্মদ স্টেডিয়াম এর অবস্থানও এ থানা অঞ্চলে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।