Brahmanbaria Zila

ব্রাহ্মণবাড়িয়া… নামটির সাথে জড়িয়ে আছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচ ও আবহমান কাল ধরে চলে আসা তিতাস নদীর নৌকা বাইচের ঐতিহ্য। ইতিহাসের আবর্তে কালের পরিক্রমায় সৃষ্ট, রুপবৈচিত্রে পরিপূর্ণ এ অঞ্চলটি অতীতে প্রাচীন বাংলার সমতটের অংশ ছিল যা সুলতানী শাসনামলে সরাইল পরগনার অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই সরাইলেই জন্মগ্রহন করেন বাংলার বারো ভুঁইয়াদের নেতা ঈসা খাঁ। তিনি এ পরগনার জমিদারি লাভের পর এ অঞ্চলকে তার প্রথম রাজধানী হিসেবে স্থাপন করেন।

১৮৩০ সালে সরাইলকে ত্রিপুরা রাজ্যের আওতাধীন করা হয়। তবে, ১৮৬০ সালে নাসিরনগর মহকুমা গঠিত হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বৃহত্তর এলাকা এর অংশ হয়। সেই নাসিরনগর মহকুমাটিই পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৮৪ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি পৃথক জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ও অর্থনৈতিক ভাবে গুরুত্ববহনকারী ব্রাহ্মণবাড়িয়া বর্তমানে দেশের বিশেষ একটি জেলা অঞ্চল। জেলাবাসীদের আইনি সেবা নিশ্চিতে অতন্ত প্রহরী হয়ে কাজ করে যাচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশ। চট্রগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের প্রধান অভিভাবক তথা ৬১তম উপ মহা-পরিদর্শক নুরেআলম মিনা ডিআইজি পদে যোগদানের পর থেকেই এ জেলাকে অপরাধমুক্ত রাখতে যুগপোযোগী ও কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আসছেন। তাঁরই বলিষ্ঠ নেতৃত্বে কর্মপরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সকল জনসাধারণের সার্বিক নিরাপত্তা, সামাজিক সচেতনতা এবং আইনের সুশাসন বজায় রেখে বিচক্ষণতার সাথে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন জেলার কর্তব্যপরায়ণ পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ শাখাওয়াত হোসেন বিপিএম। তিনি গত ১৩ই ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে যোগদান করার পর থেকেই তাঁর আওতাধীন থানাসমূহকে সম্পূর্ণ অপরাধমুক্ত রাখতে অফিসার ইনচার্জদের সাথে নিয়ে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহন করেছেন। তাঁরই যুগান্তকারী নেতৃত্বে কিভাবে চলছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সার্বিক পুলিশি কার্যক্রম? অপরাধ প্রবনতাই বা কেমন? সেসব প্রশ্নের যথার্থ উত্তর নিয়ে পজিটিভ থিংক এর আজকের বিশেষ আয়োজনে থাকছে জেলার সমসাময়িক পরিস্থিতি, দর্শনীয় স্থানসহ সকল বিষয়াদি নিয়ে সবুজ সংকেত “ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা”।

অবস্থানঃ

রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১০৪ কিলোমিটার উত্তর পূর্বাংশে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা অঞ্চল ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এ অঞ্চলের মোট আয়তন ১ হাজার ৯২৭ দশমিক ১১ বর্গকিলোমিটার এবং ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা ২৮ লাখ ৪০ হাজারেরো অধিক। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার পূর্ব দিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও হবিগঞ্জ জেলা, পশ্চিমে মেঘনা নদী, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ জেলা। উত্তরে কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ জেলা ও মেঘনা নদী এবং দক্ষিণে কুমিল্লা জেলার অবস্থান।

বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশ ৫টি পৌরসভায়, ৬টি সংসদীয় আসনে মোট ৯টি উপজেলা, ১০০টি ইউনিয়ন ও ১৩২৪টি গ্রাম সহ ৯টি থানায় তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। থানা সমূহ হলোঃ বিজয়নগর, আখাউরা, আশুগঞ্জ, কসবা, নবীনগর, নাসিরনগর, বাঞ্ছারামপুর, সরাইল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানা। জনবহুল এ অঞ্চলের মানুষের আইনি সেবা সুগমের লক্ষে ২০২৩ সালের ২৫ জুন চট্রগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি পদে যোগদান করেন পেশাদারিত্বের অন্যতম ব্যক্তিত্ব নুরেআলম মিনা। তিনি তার ২৩ বছরের কর্মজীবনে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে তার যোগ্যতা, নিষ্ঠা ও নৈতিকতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কর্তব্যপরায়ণ পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ শাখাওয়াত হোসেন বিপিএম জনগনের সুখ দুঃখে পাশে থেকে একজন সৎ, দায়িত্বশীল ও মানবিক পুলিশ হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছেন। তিনি এ জেলার পুলিশ সুপার পদে যোগদান করেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানাবিধ অপরাধ রুখতে ও আইনি সেবা নিশ্চিতে তাঁর আওতাধীন সকল থানার পুলিশ সদস্যদের সময়-উপযোগী দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন।

মুক্তিযুদ্ধঃ

১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে এ অঞ্চলে রচিত হয়েছে কালজয়ী ইতিহাস। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় পাঁক হায়েনাদের কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিলো একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। তাই, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া দখলে শুরু থেকেই বেশ তৎপর ছিলো হায়েনারা। ১৬ এপ্রিল বিমান ও স্থল হামলায় অসহায় হয়ে পড়ে বাঙ্গালীরা। পরবর্তীতে ১৮ই এপ্রিল আখাউড়ার দরুইনে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল। তাদের প্রতিহত করতে এক হতে থাকে তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা, গড়ে তুলে দুর্গ। জেলার বিভিন্ন স্থানে বাঙালি ও পাকহানাদারদের মধ্যে শুরু হয় একাধিক সম্মুখ যুদ্ধ। আড়াইবাড়ী, ইব্রাহীমপুর, চারগাছ, তুল্লাপাড়া, দেবগ্রাম, দরুইন, দুর্গারামপুর, নবীনগর, শাহবাজপুর ও কুল্লাপাথর প্রভৃতি স্থানে সংগঠিত যুদ্ধে প্রান হারান বহু মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ বাঙালি। অতঃপর ৮ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। মুক্তিযুদ্ধে তাদের আত্মত্যাগের স্মৃতি বহন করে আছে জেলার ৬টি গনকবর, ৮টি সমাধিসৌধ সহ বেশ কয়েকটি স্মৃতি সৌধ ও ভাস্কর্য এবং উপজেলাভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন।

শিক্ষাঃ

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই ক্রমান্নয়ে বৃদ্ধি পেয়ে আসছে এ অঞ্চলটির শিক্ষার হার, ধরা দিচ্ছে উত্তরোত্তর সাফল্য।  ২০১১ সালের শিক্ষা জরিপ অনুযায়ী এ জেলার শিক্ষার হার ৪৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। রয়েছে ১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ৩৯টি কলেজ, ২১৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১ হাজারের অধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩৬৪টি মাদ্রাসা ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

যোগাযোগঃ

আইন শৃঙ্খলার স্থিতিশীলতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নততর হচ্ছে। জেলার বুক চিরে বয়ে গেছে ঢাকা – সিলেট মহাসড়ক ও কুমিল্লা – সিলেট মহাসড়ক। ফলে দুরপাল্লার যাতায়াতে স্বস্থি পাচ্ছে জেলাবাসী। তাছাড়া আঞ্চলিক যোগাযোগ নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে রয়েছে পর্যাপ্ত অভ্যন্তরীণ সড়ক ও ব্রিজ কার্লভার্ট। মেঘনা ও তিতাস নদীসহ বিস্তৃত হাওড়াঞ্চল থাকায় নৌপথেও যাতায়াত সহজতর হচ্ছে। নির্মিত হয়েছে একাধিক লঞ্চ ও ফেরিঘাট। পাশাপাশি ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন, আখাউড়া জংশন রেলওয়ে স্টেশন সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশনগুলোর কল্যাণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অতি সহজেই যাতায়াত করতে পারছে সাধারণ মানুষজন।

অর্থনীতিঃ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় জনসাধারণ নির্বিঘ্নে তাদের জীবনমান পরিচালনা করে আসছে। এ অঞ্চলে বিস্তৃত কৃষিজমি ও নদীমাতৃকতার ফলে কৃষিজীবী ও মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের আধিক্য লক্ষ করা যায়। জেলার সিংহভাগ মানুষ কৃষি পেশার সাথে সম্পৃক্ত থাকায় প্রতিবছর বিপুল পরিমান অর্থকরী ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। এছাড়াও শহরাঞ্চলে বিভিন্ন ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠায় ক্রমান্বয়ে বাড়ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। ভারতের ত্রিপুরা, মেঘালয় আসাম সহ ৭টি রাজ্যের প্রবেশদ্বার আখাউড়া স্থলবন্দর এর অবস্থান ও এ জেলায়। এ স্থলবন্দর দিয়েই প্রতিদিন মাছ, শুটকী, সিমেন্ট, পাথর সহ প্রায় অর্ধশতাধিক পন্য আমদানি-রপ্তানি হয়ে আসছে। ফলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে জেলাবাসী। এখানে প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের ভান্ডার থাকায় ভবিষ্যৎ শিল্প বিপ্লবের জন্য অপার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের বৃহত্তম গ্যাস ফিল্ড মেঘনা গ্যাসক্ষেত্র সহ বহু গ্যাস উত্তোলন কেন্দ্র, দেশের ২য় বৃহত্তম তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবস্থান এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

স্বাস্থ্য

জেলা বাসীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতাল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ হাসপাতাল। রয়েছে মোট ৯টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন ভিত্তিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, চক্ষু হাসপাতাল সহ বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। পশুপাখির স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে রয়েছে জেলা প্রানীসম্পদ দপ্তর সহ উপজেলাভিত্তিক প্রাণীসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল।

প্রেসক্লাবঃ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার স্থানীয় সাংবাদিকদের কার্যক্রম বেগবান রাখতে স্থাপিত হয়েছে সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব। রয়েছে দৈনিক ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া24 , দৈনিক দিনদর্পণ, দৈনিক কুরুলিয়া সহ বহু পত্র-পত্রিকা ও অনলাইন সংবাদ মাধ্যম।

দর্শনীয় স্থানঃ

মুসলিম শাসনামল থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল। মুঘল আমলে এ এলাকাটি মসলিন কাপড়ের জন্য বেশ বিখ্যাত ছিলো। তাছাড়া এ জেলার বিখ্যাত মিষ্টান্ন ছানামুখীর প্রশংসা ছড়িয়ে আছে দেশ-বিদেশে। ওপরে হালকা চিনির আবরণ, ভেতরের পুরোটাই দুধের ছানা। দেখতে চতুর্ভুজ আকারের ছোট ছোট টুকরার এই মিষ্টান্নটি সহ নৌকাবাইচ ও পুতুলনাচ মিশে আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শত বছরের ঐতিহ্যে।

তাছাড়া বর্ষাকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওড় অঞ্চলের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছর ভীর জমান উল্লেখযোগ্য পরিমান দর্শনার্থী। এখানেই রয়েছে নাসিরনগর থানাধীন ঐতিহাসিক হরিপুর জমিদার বাড়ি, আখাউড়ার খরমপুরে কেল্লা শহীদ মাজার, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সমাধি, সরাইলের ঐতিহাসিক আরিফাইল জামে মসজিদ, আখাউড়ার ১২০ একর জুড়ে বিস্তৃত ঘাগুটিয়া পদ্মবিল ও ১৭শ শতাব্দিতে প্রতিষ্ঠিত গোকর্ণ নবাব বাড়ি সহ বেশকিছু উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। জেলার বিভিন্ন স্থানে আগত দর্শনার্থীদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখে সেবা প্রদান করে যাচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশ।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।