Chandraganj Thana

“আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে

জনশূণ্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে

শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার

রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার।”

সৌভাগ্যের নগরী খ্যাত লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ যেন সাক্ষাৎ রবি ঠাকুরের অমর এই কবিতারই প্রতিফলন। হেমন্তের বিমুগ্ধ দুপুরবেলায় দিগন্তবিস্তৃত মাঠের নিঝুম মায়াবী পরিবেশে কৃষাণ-কৃষাণীর ঠোঁটের কোণে একরাশ হাসি খেলা করে। সোনালী ফসল তোলার সময়ে উৎসবের আমেজে মেতে ওঠে গোটা চন্দ্রগঞ্জ। নবান্নের আনন্দধারা ছড়িয়ে পড়ে ঘরে ঘরে।

মায়াবী এই চন্দ্রগঞ্জ লক্ষ্মীপুর জেলার অন্তর্গত লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার একটি বিশেষ প্রশাসনিক থানা অঞ্চল। অঞ্চলটির পূর্বের নাম ছিল কালীগঞ্জ। জমিদার কালী নাথ গুহের নামানুসারে এই নামকরণ করা হয়েছিল। উনিশ শতকের শেষদিকে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলি আলহাজ্ব মৌলভী হামিদ উল্যাহ এ অঞ্চলে চন্দ্রগঞ্জ কারামাতিয়া আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এতে তৎকালীন জমিদাররা বিরোধীতা করলে তিনি স্থানীয় বাজার ‘কালীগঞ্জ ও ঠাকুরের হাট’ নামটি পরিবর্তন করে ‘চন্দ্রগঞ্জ বাজার’রাখেন। তাঁর দেওয়া নামের কারণে কালীগঞ্জ নামটি ধীরে ধীরে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পরে গোটা অঞ্চলটিই চন্দ্রগঞ্জ নামে পরিচিতি লাভ করে।

 

 

ঢাকা থেকে প্রায় ১৬৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ও লক্ষ্মীপুর জেলা সদরের পূর্ব-সীমান্তবেষ্টিত চন্দ্রগঞ্জ থানা এলাকার মোট আয়তন প্রায় ১৩৫ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ১১ হাজার জন। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় বর্তমানে ২টি থানার অধীনে ১টি পৌরসভা ও ২১টি ইউনিয়ন রয়েছে। তন্মধ্যে চন্দ্রগঞ্জ থানার আওতাধীন রয়েছে ৯ টি ইউনিয়ন। লক্ষ্মীপুর সদরের ৭নং বশিকপুর, ৮নং দত্তপাড়া, ৯নং উত্তর জয়পুর, ১০নং চন্দ্রগঞ্জ, ১১নং হাজিরপাড়া, ১২নং চরশাহী, ১৩নং দিঘলী, ১৪নং মান্দারী ও ১৮নং কুশাখালী ইউনিয়ন মিলে চন্দ্রগঞ্জ থানা পুলিশ তাদের প্রশাসনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

চন্দ্রগঞ্জ থানা অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ থানা অঞ্চলে ৭ টি কলেজ, ৩৫ টি উচ্চ বিদ্যালয়, প্রায় ১৩০ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৬৭ টি মাদ্রাসা রয়েছে। তন্মধ্যে ঐতিহ্য মন্ডিত বিদ্যাপীঠ কফিল উদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ চন্দ্রগঞ্জের অমূল্য সম্পদ। সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ-২০২৩ এ প্রতিষ্ঠানটি উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ কলেজ নির্বাচিত হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠানটির পার্শ্ববর্তী ওয়াপদা খালের রূপবৈচিত্র‍্য যোগ করেছে অনন্য মাত্রা। এছাড়াও, চারিদিকে সারিবদ্ধ ফলজ-বনজ-ঔষধী গাছের সবুজ বনায়ন, বিশাল এক পুকুরের শান বাধানো ঘাট ও স্বচ্ছ জলরাশি অনেককেই বিমোহিত করে।

চন্দ্রগঞ্জ জনপদটিতে সিংহভাগ মানুষ কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। মৃদুমন্দ বাতাসে কৃষকের শিল্পী হাতে গড়া শস্যখেতের অতুলনীয় দৃশ্যগুলো বেশ নজরকাড়া। তাছাড়া, গৃহস্থালির উঠোনে নারিকেল ও সুপারি গাছের মিশেল এ জনপদের বিশেষত্ব। মায়াময় এই চন্দ্রগঞ্জে শহুরে ছোঁয়া লাগলেও এখানকার গ্রামীণ আবহ মনকে আন্দোলিত করে। তাছাড়া, এ অঞ্চলে প্রসিদ্ধ চন্দ্রগঞ্জ বাজারসহ ছোট-বড় প্রায় ৩২ টি হাট-বাজার পল্লীগ্রামের রূপবৈচিত্রকে পূর্ণতা দিয়েছে। এসব হাট-বাজারে সূর্য ওঠার আগেই ভোরের স্নিগ্ধ কুয়াশা ভেদ করে শুরু হয় মানুষের আনাগোনা। বাড়ে গুঞ্জন, জমায়েত; শুরু হয় দামাদামি আর হাঁকডাক। সেই গুঞ্জন আর হাঁকডাকের মাঝে ক্রেতা-বিক্রেতাদের কর্মচাঞ্চল্যে সময় পেরিয়ে যায়, এগিয়ে যায় গ্রামীণ অর্থনীতি। ক্রেতা-বিক্রেতাদের অবাধ যাতায়াতে যাতে কোনো অসুবিধা সৃষ্টি না হয়, সে লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে চন্দ্রগঞ্জ থানা পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় বছরজুড়ে নারিকেল, সুপারি ও পান কেনাবেচায় সরগরম থাকে চন্দ্রগঞ্জ থানা অঞ্চলের হাট-বাজারগুলো। তাছাড়া, গুণগত মান ভালো হওয়ায় এসব অর্থকরী ফলজ উদ্ভিদের বেশ চাহিদা রয়েছে দেশে-বিদেশে। এছাড়াও, স্থানীয় হাট-বাজারগুলোতে স্বর্ণ ব্যবসার চল দেশবাসীর কাছে চন্দ্রগঞ্জকে আলাদাভাবে চিনিয়েছে।

চন্দ্রগঞ্জের বিশাল জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে রয়েছে ৩২ টি কমিউনিটি হাসপাতাল ও ৮ টি পরিবার পরিকল্পনা অফিস। তবে চন্দ্রগঞ্জ এখনো উপজেলা হিসেবে রূপান্তরিত না হওয়ায় কোনো উপজেলা স্বাস্থ্য কম্পলেক্স গড়ে উঠেনি। তা-ই, স্থানীয়রা লক্ষ্মীপুর জেলা সদরের উপজেলা স্বাস্থ্য কম্পলেক্স থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন। এছাড়াও, চন্দ্রগঞ্জ থানা অঞ্চলে পল্লী বিদ্যুৎ অফিস, ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়সহ রয়েছে প্রায় ২৯ টি সরকারি স্থাপনা। আরও রয়েছে প্রায় ৭০ টির মতো ব্যাংক-বীমাসহ নানা আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তবে এ অঞ্চলটিতে এখনো কোনো ফায়ার স্টেশন গড়ে উঠেনি। ফলে চন্দ্রগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাবনা দেখা দিলে বেশ তৎপর থাকতে হয় লক্ষ্মীপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের কর্মীদের। চন্দ্রগঞ্জ এলাকায় ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপন হলে সেটি থানাবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে আরও সহায়ক হবে বলে মনে করেন এলাকার জনসাধারণ।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।