Bajidpur

“উজান-ভাটির মিলিত ধারা, নদী-হাওর মাছে ভরা” খ্যাত কিশোরগঞ্জ জেলার  অন্যতম একটি উপজেলা  বাজিতপুর । ১৯৩.৭৬ র্বগ কিলোমিটার আয়তন এর এই বাজিতপুর উপজেলা।উত্তরে কটিয়াদি ,নিকলী এবং অষ্টগ্রাম উপজেলা , দক্ষিণে কুলিয়ারচর  এবং সরাইল উপজেলা, র্পূবে অষ্টগ্রাম এবং নাসিরনগর উপজেলা  আর পশ্চিমে কটিয়াদি উপজেলা দ্বারা বেষ্টিত।

হাজার বছর পূর্বে খাল-বিল, হাওড়ের গভীর জলে নিমজ্জিত ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ থাকা একটি দুর্গম এলাকার বর্তমান পরিচিতি বাজিতপুর। কালের স্রোতে পলি মাটির আস্তরণে ও প্রাকৃতিক বিবর্তনে যে সমস্ত ভূ-ভাগ জলগর্ভ থেকে উত্থিত হয় তার একটি উল্লেখযোগ্য স্থান বাজিতপুর অঞ্চল। বাজিতপুর একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন জনপদ। কিশোরগঞ্জ জেলার হাওড় অঞ্চল এখান থেকেই শুরু হয়েছে। তাই বাজিতপুর ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার নামে জেলাবাসীর কাছে সুপরিচিত।

বাজিতপুর নামের ইতিহাস

নাম অনেক অর্থবহ একটি বিষয়। আর কোন এলাকার ক্ষেত্রে তো তা আরও বেশি। বিশ্বের অনেক শহরের নামকরণের উৎসই বেশ চমকপ্রদ! অনেক সময় এলাকার নাম শুনেই সেই এলাকা সম্পর্কে অনেক কিছু ধারণা করে নেয়া যায়।  তেমনি ভাবেই বাজিতপুর নামের উৎপত্তি সম্মন্ধে দুটি জনশ্রতি ইতিহাস স্বীকৃত হয়েছে। তবে গ্রহণযোগ্য সুত্রে বলা হয় মুগল আমলে বায়োজিদ খাঁ নামক জনৈক রাজ কর্মচারী তার অপর তিন ভ্রাতা ভাগল খাঁ, পৈলন খাঁ ও দেলোয়ার খাঁসহ দিল্লী থেকে এসে এখানে অবস্থান করেন। কিছুদিন পর তারা বাজিতপুর এর আশেপাশে ৪টি স্থানে স্ব-স্ব বাসস্থান ঠিক করে নেওয়ার পর তাদের নামের মূল অংশের সাথে পুর যুক্ত হয়ে পরবর্তী সময়ে এ অঞ্চলের ক্ষেত্রে উচ্চারণ বিবর্তনের ফলে বাজিতপুর নামে পরিচিতি লাভ করে।

ইতিহাস থেকে জানা যায় ব্রিটিশ শাসন আমলে এই উপজেলার দুলালপুরের নদীবন্দর উপমহাদেশে বিখ্যাত ছিল। নীল কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল এ উপজেলার গোপিনাথপুর এবং ঘোড়াঘাটে। ভাটি এলাকার মুক্তা চালান করা হত এই এলাকা দিয়েই। তাছাড়া বাজিতপুর অঞ্চলটি ইতিহাসের বহু ঘটনার সাথে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে বিশ^বাসির কাছে। ভারতবর্ষের বাংলার মাটিতে “ফকির-সন্ন্যাসী” আন্দোলন বাজিতপুরে প্রচন্ডভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধে বাজিতপুর উপজেলার ইতিকথা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে এ দেশের সাধারণ মানুষ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ দেশের সাধারণ মানুষ নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে। এছাড়াও ১৯৭১ এর স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বাজতিপুর অঞ্চলের ৪০০ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছিল পাক আর্মি এবং ৬০ জন নারী তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছিল এই বাজিদপুরে। অতপর সাত জন মুক্তিযুদ্ধার জীবনের বিনিময়ে ২৬ অক্টোবর বাজিতপুরকে হানাদার মুক্ত করা হয়েছিল।

আধুনিক অঞ্চলে স্বীকৃতি…

ব্রিটিশ আমলের প্রাচীন মসলিন “তাঞ্জাব” উৎপাদনকারী শহর বাজিতপুরে ১৮৩৫ সালেই থানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ১৮৬৯ সালে পৌরসভা হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাজিতপুর শহর। এরপর ১১২ বছর পর বাজিতপুরকে উপজেলায় উন্নিত করা হয়।

বাজিতপুরের বসবাসরত মানুষের সেবা প্রদানে রয়েছে বিভিন্ন সরকারি অফিস ও প্রতিষ্ঠান । রয়েছে আইন শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিষয়ক-অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের কার্যালয়,ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স,আনসার ও ভিডিপি অফিস। শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক-উপজেলা শিক্ষা অফিস,উপজেলা রিসোর্স সেন্টার। মানব সম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক-উপজেলা সমাজ সেবা অফিস,উপজেলা যুবউন্নয়ন অফিস, উপজেলা সমবায় অফিস, উপজেলা মহিলা উন্নয়ন অফিস, উপজেলা পল্লী দারিদ্র বিমোচন অফিস।

১৯৩.৭৬ বর্গ কি.মি. আয়তনের বাজিতপুর উপজেলায় বর্তমানে ছোট-বড় বড় কিছু শিল্পমাধ্যম গড়ে উঠেছে। রাইস মিল ২৫টি , স’মিল ১০ টি , লোহার কারখানা ২টি , বরফ কল ৩ টি , জুতা তৈরীর কারখানা ১ টি এবং বেশ কিছু ওয়েল্ডিং সহ রয়েছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প  যা স্থানীয় কিছু বেকার জনগোষ্টির কর্মসংস্থান স্মৃষ্টিতে সহায়ক ভুমিকা রাখছে।

বাজিতপুর উপজেলায়  উল্লেখ্যযোগ্য ব্যক্তিবর্গ…

বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ট শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম এর জন্মভূমি বাজিতপুরের ভাগলপুর গ্রামে।তিনি  প্রতিষ্ঠা করেছিলেন  ‘বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন’ যা তাঁর দক্ষ ব্যবস্থাপনায় বৃহৎ ও প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। জহুরুল ইসলামের ব্যবসায়ী জীবনের প্রথম দিকের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হল বাংলাদেশ ব্যাংক, পুরানো হাইকোর্ট ভবন, সুপ্রিম কোর্ট ভবন, গণভবন, ঢাকার নগর ভবন  ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের শপিং কমপ্লেক্স। অক্লান্ত পরিশ্রমী ও আত্মপ্রত্যয়ী এই ব্যক্তিত্ব স্বল্পতম সময়ে নির্মাণ সম্পন্ন করেন এমপি হোস্টেল, পুরানো সংসদ ভবন সহ বিভিন্ন সড়ক যা এদেশের নির্মাণ শিল্পে স্থাপন করেছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

উল্লেখ্য যে, নবাব আলীবর্দী খাঁর সময়কালীন উপমহাদেশের বিজ্ঞ আলেম মৌলভী উবেদুল হাসান এর জন্ম এই বাজিতপুরের দিলালপুর ইউনিয়নে।

হাওড় বাউরে ভরপুর বাজিতপুর উপজেলা

মেঘনা, বাউলাই, ঘোড়াউত্রা, পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদী ঘেরা বাজিতপুর উপজেলায় রয়েছে ৭টি খাল-বিল, ১৫টি জলমহল।দিলালপুর ইউনিয়নের দিলালপুর বাজার ঘেরা ঘোড়াউত্রা নদীর পাড়ের সৌন্দর্য্য মুগ্ধ করবে যেকোন মানুষকে।

যোগাযোগ ব্যবস্থা

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে কৃষিপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্পজাত পণ্য সামগ্রী সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে স্থানান্তর করতে সুবিধা হয়। এর ফলে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, শিল্প ও ব্যবসার প্রসার ঘটে। এজন্য যোগাযোগ

ব্যবস্থাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।বাজিতপুরে রয়েছে  ৭০কিমি পাঁকা রাস্তা, মাটির রাস্তা ২৮৭কিমি, রেলওয়ে ১০কিমি, জলপথ ৪০কিমি।ঐতিহ্যবাহী যানবাহন পালকি ,মহিষের গাড়ি,ঘোড়ার গাড়ি,গরুর গাড়ি,পানসি নৌকা,সরাংগা নৌকা।যদিও এই  যানবাহনগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়।

১৯৮৯ সালে ৪ একর জায়গা জুড়ে বাজিতপুরের রাবারকান্দি এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি কারাগার।কিন্তু হটাৎই ১৯৯২ সালে কারাগারটি বন্ধ ঘোষনা হয়। যা বর্তমানে দেশের চতুর্থ পর্যায়ের একটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র প্রকল্প তৈরির ঘোষনা করেছে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

উপজেলার দর্শনীয় স্থান

উপজেলার দর্শনীয় স্থান হিসেবে স্বীকৃত রয়েছে ভাগলপুর দেওয়ান বাড়ি মসজিদ, পাগলা শংকররে আখড়া,জহুরুল ইসলাম মডেকিলে কলজে ও হাসপাতাল, বাজতিপুর মঠ, রাম নারায়ণ সাহা ও র্দূগারাণী সাহা জোড়া মঠ, সতীশ চন্দ্র রায় চৌধুরী জমদিার বাড়ি ও বেংলা ফিসারী অন্যতম।

বাজিতপুর উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

প্রায় ১০টি মহাবিদ্যালয় সম্পন্য বাজিতপুর উপজেলায় মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১৫০টির অধিক। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ১টি,নার্সিং কলেজ ১টি,স্কুল এন্ড কলেজ ২ টি,উচ্চ বিদ্যালয় ১২টি, জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় ২টি,মাদ্রাসা ১০টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১১১টি।

কৃষি সমৃদ্ধ  বাজিতপুর উপজেলা

৭৫ শতাংশ শিক্ষার হারের বাজিতপুরে ৪২.২৯ শতাংশ মানুষই কৃষি পেশার সাথে নিজেকে মানিয়ে চলেছেন। কৃষকদের উৎপাদিত প্রধান শস্য ধান,পাট,গম,আলু,মিষ্টী আলু,মটরঁশুটি,শাকসব্জি। বিলুপ্তপ্রায় শস্য তিল, তিসি, চিনা, কাউন, তামাক, ডাল, পান। তাছারাও মাছ চাষ, পশুপালন , হাস-মুরগী পালনের  সাথে সম্পৃক্ত রেখেছে বাজিতপুরের কৃষকেরা। বাজতিপুর উপজেলাটি দেশের অন্যতম কৃষি প্রধান ছোট ভাটী এলাকার উপজেলা হিসেবেও বেশ পরিচিত।কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি হলেও শিক্ষার হার বৃদ্ধি, নগরায়ন ও আধুনিক উন্নত জীবনের প্রয়াসে ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনীতির মূল কর্মকান্ড হয়ে উঠেছে।

স্বাস্থ্যসেবায় বাজিতপুর উপজেলা

১৭৮টি গ্রাম সংশ্লিষ্ঠ ৯২টি মৌজায় বিভক্ত ১১টি ইউনিয়নের মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় সকলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে বাজিতপুর উপজেলায় রয়েছে প্রায় ৪০টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র।মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ১টি,উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১টি,কমিউনিটি ক্লিনিক ২৬টি,উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ৪টি ,ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ৭ টি।

বাজিতপুর উপজেলার  সাংস্কৃতিক সংগঠন

বাজিতপুর উপজেলার বসবাসরত মানুষের চিত্তবিনোদনের জন্য রয়েছে ৫২ টি ক্লাব, প্রেস ক্লাব ১টি, থিয়েটার ক্লাব ১ টি, পাবলিক লাইব্রেরী ১ টি , নারী সংগঠন ১ টি, খেলার মাঠ ৪টি, সিনেমা হল ২টি।

বর্তমানে বসবাসকৃত আড়াই লক্ষাধীক জনসংখার এ ভূমি তাদের একটি শান্তি প্রিয় স্থান।তবে সমাজের কিছু অপরাধ প্রবণ মানুষের জন্য এই শান্তি প্রিয় অঞ্চল জুড়ে সৃষ্টি হয়, অস্থিরতা, বিভিন্ন ঘটনায় আহত-নিহত বা সামাজিক বিশৃংখলামুলক কিছু অপরাধ। যা নিয়ন্ত্রণে কঠোর ভাবে কাজ করে চলেছেন বাজিতপুর থানা পুলিশ সহ  অত্র অঞ্চলের আইন শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিষয়ক সকল প্রতিষ্ঠান ।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।