Fatikchari

ফটিকছড়ি! হালদা নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠা চট্রগ্রাম জেলার সর্ববৃহৎ একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। উঁচুনিচু পাহাড়ের বুক চিরে বের হওয়া খালের স্বচ্ছ পানির স্রোত, রাশি রাশি চা বাগান; যেন সবুজের সমারোহে প্রকৃতির অপরূপ সাজে সজ্জিত একটি প্রাচীন জনপদ ফটিকছড়ি।

ফটিকছড়ির নামকরণেও রয়েছে বৈচিত্র্যতা। ফটিক বা স্ফটিক অর্থ স্বচ্ছ এবং ছড়ি মানে পাহাড়িয়া নদী। ফটিকছড়ি অঞ্চলের পশ্চিমাংশে ফটিকছড়ি খাল নামে একটি পাহাড়ি ঝর্না বা ছড়া সীতাকুন্ড পাহাড় থেকে হালদা নদীতে মিলিত হয়েছে। সেই স্বচ্ছ পাহাড়ি ঝর্নাটির নামানুসারেই এ অঞ্চলের নাম ফটিকছড়ি হিসেবে লোকমুখে প্রচলিত হয়।

ফটিকছড়ির প্রাচীন ইতিহাসও বেশ সমৃদ্ধ। জানা যায়, ১৭ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তথা ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন দিল্লির বাদশা আওরঙ্গজেবের শাসনামলে বাংলার শাসনকর্তা সুবেদার শায়েস্তা খানের পুত্র উমেদ আলী খাঁ আরাকান রাজাকে পরাজিত করে চট্রগ্রাম দখল করে ইসলামাবাদ নামে নামকরণ করেন। অতঃপর তাদের শাসনকার্য আরো সুবিধা করার লক্ষ্যে বৃহত্তর চট্রগ্রামকে ৭ টি ভাগে ভাগ করে ৭ টি পরগণার সৃষ্টি করেন। বাংলার ১২ ভূঁইয়াদের একজন ঈসা খাঁ বর্তমান ফটিকছড়ি এলাকায় অবস্থান কালে একে ইছাপুর পরগণা নামে অধিষ্টিত করেন। মুঘল আমলের সেই ইছাপুর পরগনাই বর্তমানে ফটিকছড়ি হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করেছে। ফটিকছড়ি ১৯১৮ সালে থানা হিসেবে এবং ১৯৮৩ সালে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে উপজেলায় আত্মপ্রকাশ করে।

 

 

ঢাকা থেকে প্রায় ২২০ কিলোমিটার এবং চট্রগ্রাম জেলা সদর থেকে ৫৬ দশমিক ৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত একটি প্রশাসনিক জনপদ ফটিকছড়ি। ফটিকছড়ি উপজেলাটি নাজিরহাট ও ফটিকছড়ি ২টি পৌরসভা, ১৮ টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। তবে ফটিকছড়ি উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ফটিকছড়ি থানা এবং বাকি ৬ টি ইউনিয়নের প্রশাসনিক কার্যক্রম ভুজপুর থানার অন্তর্ভুক্ত। ফটিকছড়ি থানার আওতাধীন ইউনিয়নগুলো যথাক্রমে পাইদং, কাঞ্চননগর, সুন্দরপুর, লেলাং, নানুপুর, রোসাংগিরী, বখ্‌তপুর, জাফতনগর, ধর্মপুর, সমিতিরহাট, আব্দুল্লাহপুর এবং খিরাম। এটি চট্রগ্রাম জেলার সর্ববৃহৎ থানা অঞ্চল হওয়ায় এ অঞ্চলের গুরুত্ব অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি। ফটিকছড়ি থানার উত্তর দিকে খাগড়াছড়ির মানিকগঞ্জ উপজেলা, উত্তর-পশ্চিমে চট্রগ্রামের ভুজপুর থানা, দক্ষিণে চট্রগ্রামের রাউজান উপজেলা, পূর্বে খাগড়াছড়ির লক্ষীপুর উপজেলা ও রাঙ্গামাটির কাউখালি উপজেলা এবং পশ্চিমে চট্রগ্রামের হাটহাজারি উপজেলা অবস্থিত।

১৯৭১ এর রণাঙ্গনে রয়েছে ফটিকছড়ির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। যুদ্ধের শুরু থেকেই ফটিকছড়ি ছিলো এক অনবদ্য দুর্গ। স্বাধীনতাকামী অদম্য সাহসী যুবকদের সংগঠিত করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে প্রেরণের পিছনে এই জনপদের অবদান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। ১৯৭১ এর মার্চে মুক্তিযোদ্ধারা রামগড়ে মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প স্থাপন করেন। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবেশপথ ছিলো এই ফটিকছড়ি। ফটিকছড়ি দিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে পাক হানাদার বাহিনীদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফটিকছড়ির প্রায় দেড় হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছোট-বড় বিভিন্ন সম্মুখযুদ্ধ এবং অপারেশন চালিয়ে প্রাণপণ লড়াই করে শত্রুমুক্ত করেন এবং বিজয় ছিনিয়ে আনেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া অগনিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ আজীবন স্মরণ রাখতে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ও গনকবর।

ফটিকছড়ি এখন একটি ক্রমবর্ধমান জনপদ। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী ফটিকছড়ি থানা অঞ্চলের জনসংখ্যা ৩ লক্ষ ৫০ হাজারেরো অধিক। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রধান আয়ের উৎস কৃষি। এ এলাকার মানুষ ধান, আলু, পিয়াজ, রসুন, বিভিন্ন রকমের ডাল এবং শাকসবজির ফলন করে থাকেন। তাছাড়া গবাদিপশু পালন, হ্যাচারী, মৎস্যচাষ, হাঁস-মুরগির খামারে নিয়োজিত হয়ে অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। তবে উঁচুনিচু টিলা পাহাড়গুলোতে চায়ের চাষ ব্যপক ভাবে লক্ষনীয়।  চা ছাড়াও রাবার উৎপাদনেও রয়েছে ফটিকছড়ির সুখ্যাতি। চা এবং রাবার প্রক্রিয়াজাত করে দেশের নানা প্রান্তে বাজারজাত এবং বিদেশে রপ্তানি করে থাকে এ অঞ্চলের মানুষ। তবে ফটিকছড়ি অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে একটি বড় অংশ প্রবাসী। এ অঞ্চলের প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠিয়ে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এছাড়াও, ফটিকছড়ি থানা অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন ব্যবসা, চাকুরি, শিল্প, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে ।

ফটিকছড়ি থানা অঞ্চল একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপদ। তবে, অসাম্প্রদায়িক এ অঞ্চলটিতে হিন্দু,মুসলিম,বুদ্ধ ও খ্রিস্টান সকলে মিলে মিশে বসবাস করেন। ধর্মীয় উপাসনার জন্য প্রায় আটশরো বেশি মসজিদ, ৭০টি মন্দির, ৩০টিরও বেশি প্যাগোডা এবং একটি গির্জা রয়েছে।

ফটিকছড়িতেই আছে মাইজভান্ডার দরবার শরীফ। প্রতি বছর ৮,৯ ও ১০ই মাঘে ৩ দিন ব্যাপী ওরশ অনুষ্ঠিত হয় এই দরবার শরীফে। সারাদেশ থেকে লক্ষাধিক মানুষ জমায়েত হয়ে এ অনুষ্ঠান উদযাপন করেন।

ফটিকছড়ির নানুপুরে রয়েছে গৌতম বিহার। বৌদ্ধ পূর্ণিমা ও মাঘী পূর্ণিমা উপলক্ষে এ বিহারটিতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমাগম ঘটে। তাছাড়া, হজরত শাহ্‌ রুস্তম ফকির রহমতুল্লাহ আলাইহি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, ফকিরপাড়া গায়েবি মসজিদ সহ বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন মসজিদ সহ বিভিন্ন মাজার ও দরবার শরীফ রয়েছে ফটিকছড়িতে।

শিক্ষাখাতে অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে ফটিকছড়িতে। এ অঞ্চলে শিক্ষার হার ৫১ দশমিক চার শতাংশ। ফটিকছড়ি সরকারি কলেজ সহ বিভিন্ন কলেজ, একশোরও বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এবং প্রায় ৪০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বেশ কয়েকটি কিন্ডারগার্টেন রয়েছে।

যোগাযোগ খাতেও এসেছে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। তবে একসময় চট্রগ্রাম শহরের সাথে যোগাযোগ এবং মালামাল আনা নেওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিলো হালদা নদী। এখন সড়কপথে সুফল দেখতে শুরু করেছে ফটিকছড়িবাসী। ফটিকছড়ির উপর দিয়েই বয়ে গেছে দুটি আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং তিনটি জেলা সড়ক। ফটিকছড়ি থেকে একটি আঞ্চলিক মহাসড়ক খাগড়াছড়ি এবং অন্য একটি মহাসড়ক বারৈয়ারহাট হয়ে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে মিলিত হয়েছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় স্বাস্থ্যখাতেও সুফল পাচ্ছে ফটিকছড়িবাসী। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, উপজেলা প্রানিসম্পদ দপ্তর ভেটেরিনারি হাসপাতাল সহ ছোট বড় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। এছাড়াও, উপজেলাভিত্তিক বিভিন্ন সরকারি দাপ্তরিক প্রতিষ্ঠান যেমন, উপজেলা পরিষদ, উপজেলা ভূমি অফিস, হিসাবরক্ষণ অফিস, খাদ্যনিয়ন্ত্রন অফিস, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় রয়েছে। এছাড়াও, উপজেলা ডাকঘর, ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশন সহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ফটিকছড়ি থানা অঞ্চলে।

সবুজের বিস্তীর্ণ সমরোহে প্রকৃতি অপরূপ সাজে সাজিয়েছে ফটিকছড়িকে। পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণ এ থানা অঞ্চলের বেশ কয়েকটি চা বাগান। ফটিকছড়িতে রয়েছে, এশিয়ার বৃহত্তম চা বাগান কর্ণফুলী টি গার্ডেন। প্রায় সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি একরের এই চা বাগানটিতে প্রতি বছর ৯ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়ে থাকে। বিশাল এ বাগানটি এখন একটি বিশেষ পর্যটন কেন্দ্র। তাছাড়া ফটিকছড়িকে আরো সুন্দর্যমন্ডিত করে তুলেছে রাবার বাগান। এখানেই আছে রাঙ্গামাটিয়া রাবার বাগান সহ ছোট বড় বিভিন্ন রাবার বাগান। ভোর হতেই রাবার সংগ্রহের জন্য কর্মীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন, সংগ্রহ শেষে আঠালো রাবার কাঁধে নিয়ে ছুটে চলেন নির্ধারিত স্থানে। মনোমুগ্ধকর রাবার বাগান, চা বাগান সহ প্রাকৃতিক নানা সৌন্দর্যমন্ডিত স্থানগুলো দেখতে দূর-দুরান্ত থেকে নানা পর্যটকের ভীর হয় এ অঞ্চলে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।