মানুষের জীবনের পরিধি সামান্য, অথচ সামান্য পরিধির জীবনে সাফল্যের সম্ভাবনা অসামান্য। এই অসামান্য সম্ভবনাকে কাজে লাগিয়ে অসংখ্য জন সমাজকে আলোকিত করেছেন, জাতিকে এগিয়ে নিয়েছেন অনেকদূর। তাদেরই একজন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। যিনি একাধারে শিক্ষক, সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারক।
১৯৩৯ সালের ২৫শে জুলাই গ্রীষ্মের এক পড়ন্ত বিকালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন আজকের আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। শিক্ষক বাবা আযীম উদ্দিন আহমদের কর্ম সূত্রে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে দেশের নানা জায়গায়। ১৯৫৫ সালে পাবনা জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা সম্পন্ন করে উচ্চ মাধ্যমিক ভর্তি হন প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে। সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে স্নাতকে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। পরবর্তীতে একই বিভাগ থেকে ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন।

 

বাতিঘর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
পিতার শিক্ষক হিসেবে অসামান্য সাফল্য ও জনপ্রিয়তা শৈশবেই তাকে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট করে। বাবার দেখাদেখি সিদ্ধান্ত নিযেছিলেন, জীবনে কিছু করলেই শিক্ষকতাই করবেন। তাই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করার পরপরই মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে খন্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তখন ওই কলেজে অধ্যক্ষ ছিলেন তাঁরই বাবা। তিনি ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদককে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তার ভেতরে যেহেতু শিক্ষকের রক্ত আছে, আমি বিশ্বাস করি সে ভালো শিক্ষক হবে।’  বাবার কলেজে কয়েকমাস শিক্ষকতা করার পর যোগ দেন সিলেট মহিলা কলেজে। এখানেও বেশিদিন স্থায়ী হলেন না; ১৯৬২ সালের পহেলা এপ্রিলে যোগ দেন রাজশাহী কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে। মাত্র পাঁচমাস বাদে বদলি হয়ে আবার যোগ দিলেন তৎকালের ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে যার বর্তমান নাম ঢাকা বিজ্ঞান কলেজ। এই কলেজে থাকাবস্থায় দুই বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অল্প সময়ে কর্মজীবনে এতো পালাবদল, কিন্তু তখনো তিনি ২৪ বছরের টগবগে যুবক। এরমধ্যে মহীয়সী নারী রওশন আরার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের কোল জুড়ে এসেছিল দুই কন্যা সন্তান।
পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে ঢাকা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন আহমেদের আমন্ত্রনে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগে। মূলত ঢাকা কলেজের শিক্ষক থাকাবস্থায় তার শিক্ষক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রদের সাথে তার গড়ে উঠে  আত্নীক সম্পর্ক। যে সম্পর্ক এতোটাই বিস্তার হয়েছিল যে, উচ্চ বেতনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবার সুযোগ পেয়েও সেখানে যাননি; একইসময়ে সিনেমার অভিনেতা হওয়ারও প্রস্তাব পেয়েছিলেন, কিন্তু তাতে সাই দেননি তিনি। ঢাকা কলেজে প্রাণবন্ত পরিবেশে ছাত্রদের পড়ানোর তৃপ্তি, শিক্ষক জীবনের অনির্বচনীয়তম আস্বাদ ছেড়ে তিনি কখনো যেতে চাননি সিনেমার জগতে। এই নিয়ে তিনি বলেছিলেন,
❝টেলিভিশনের এক ভদ্রলোক একটা চলচ্চিত্র বানাবেন। আমাকে তিনি তাঁর চলচ্চিত্রের নায়ক করতে চাইলেন। তখন আমি ঢাকা কলেজে পড়াই। তাঁকে বললাম, আমি শিক্ষক মানুষ, চারিদিকে আমার এত ছাত্র, আমি কীভাবে নায়ক হব, নায়িকার হাত ধরে সমুদ্রের পারে, পাহাড়ের চূড়ায় হাঁটব? এটা আমি পারব না।❞
শিক্ষক থাকাবস্থায় তিনি সত্তরের দশকে টিভি উপস্থাপক হিসাবেও তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেন।
সাহিত্যিক হিসেবে হয়ে উঠেন সক্রিয়। ষাটের দশকে বাংলাদেশে যে নতুন ধারার সাহিত্য আন্দোলন হয়, তিনি ছিলেন তার অগ্রপথিক। প্রতিষ্ঠা করলেন সাহিত্য পত্রিকা ‘কণ্ঠস্বর’। এই পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে সেকালের নবীন সাহিত্যযাত্রাকে তিনি নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন বহু বছর।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিখ্যাত উক্তি
শিক্ষকতা, সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে রইলেন না। সমাজসংস্করণেও নামলেন পুরোদমে। উপলব্ধি করলেন, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদের প্রয়োজন অসংখ্য উচ্চায়ত মানুষ।
ফলশ্রুতিতে আলোকিত মানুষ গড়ার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে ‘আলোকিত মানুষ চাই’— স্লোগানকে বুকে ধারণ করে গড়ে তুললেন ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’। প্রথমদিকে তার তত্ত্বাবধানে মাত্র পঁচিশ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী বিশ্বের মহান সাহিত্যকর্মগুলো পড়তে ও সেগুলোর উপর আলোচনা করা শুরু করে। ধীরে ধীরে এই পাঠচক্রে স্কুল-কলেজ ও সাধারণ মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৫০০ টি শাখা দেশের মোট ৫৪ টি জেলায় কর্মকান্ড বিস্তৃত করেছে।  বাংলাদেশে পাঠাগারের অপ্রতুলতা অনুধাবন করে ১৯৯৮ সালে থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভ্রাম্যমান লাইব্রেরি কার্যক্রম আরম্ভ করে।
বহুমাত্রিক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৭৭ সালে জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার, ১৯৯৮ সালে মাহবুব উল্লাহ ট্রাস্ট পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে রোটারি সিড পুরস্কার, ২০০০ সালে বাংলাদেশ বুক ক্লাব পুরস্কার, ২০০৫ সালে একুশে পদক পান, ২০০৪ সালে র‌্যামন মাগাসেসে পুরস্কার এবং ২০১২ সলে বাংলা একাডেমী পুরষ্কারসহ দেশ-বিদেশের অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মামনায় ভূষিত হন।
শিক্ষকতা, সাহিত্য আর সমাজ সংস্করণের মাধ্যমে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সমাজকে এগিয়ে নিতে যে প্রয়াস চালিয়ে গেছেন, তা হয়ত বেগবান হবে কাল থেকে কালান্তর।
error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।