Kamalnagar Thana

মেঘনা নদীবিধৌত নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের আঁধার কমলনগর। গ্রামীণ রূপবৈচিত্রের ধারক ও বাহক নয়ে উঠছে কমলনগর থানা অঞ্চল। সোনালী ধানে মুখরিত বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, মেঘনার ভাসমান নৌকায় শিকার করা ইলিশে মুখরিত মাছঘাট, আর সুদীর্ঘ চরাঞ্চলে ঘেরা একটি জনপদ কমলনগর। যেখানে পাওয়া যায়, কবি শামসুর রাহমানের রচিত “মেঘনা নদীর তীরে” কবিতার পূর্ণ প্রতিফলন।

এটি লক্ষীপুর জেলার সর্বশেষ গঠিত থানা অঞ্চল। ২০০৫ সালের ১৭ই নভেম্বর প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির ৯৩তম সভায় লক্ষীপুর জেলার রামগতি উপজেলাকে বিভক্ত করে “কমলনগর” উপজেলা করনের প্রস্তাব দেয়া হয়। অতঃপর ২০০৬ সালের ২০ই সেপ্টেম্বর কমলনগর দেশের ৪৭২তম উপজেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এবং সর্বশেষ ২০০৮ সালে কমলনগর থানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ঢাকা থেকে প্রায় ১৬৫ কিলোমিটার এবং লক্ষ্মীপুর জেলা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত একটি প্রশাসনিক অঞ্চল কমলনগর। কমলনগর থানা অঞ্চলের পূর্ব দিকে নোয়াখালী সদর, পশ্চিমে মেঘনা নদী উত্তরে লক্ষ্মীপুর সদর এবং দক্ষিণে রামগতি উপজেলা অবস্থিত। কমলনগর উপজেলার আয়তন ৩১৫ বর্গ কিলোমিটার এবং সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী জনসংখ্যা প্রায় ২ লাখ ২৩ হাজার।

 

 

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে কমলনগরের ইতিহাস ভুলবার নয়। সেসময় কমলনগর রামগতি থানার আওতাধীন ছিলো। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের উত্তাল ভাষনে ছাত্র,  কৃষক, শ্রমিক, জনতা ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো”, “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা” স্লোগানে স্বাধীনতা লাভের তীব্র ক্ষুদায় হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে। মুক্তিযুদ্ধকালে কমলনগর এলাকায় পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশ না করলেও, এ এলাকার রাজাকারদের মাধ্যমে মুক্তিকামী মানুষদের অত্যাচার ও নীলনকশা বাস্তবায়ন করত। তোরাবগঞ্জ, কড়ইতলা সাইক্লোন সেন্টার ও হাজিরহাট স্থানে রাজাকারদের ক্যাম্প ছিলো। কমলনগরে, মুক্তিযোদ্ধাদের পাকবাহিনীর সাথে কোন যুদ্ধ না হলেও রাজাকারদের সঙ্গে একাধিক যুদ্ধ হয়। এছাড়াও কমলনগরের মুক্তিযোদ্ধারা রামগতি থানা অপারেশনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশ নেন। তবে, যুদ্ধের শেষভাগে রাজাকাররা কমলনগরের হাজিরহাটে একাধিক ক্যাম্প স্থাপন করে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করলে, মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

বর্তমানে কমলপুর উপজেলা ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এবং সম্পূর্ণ উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম কমলনগর থানার আওতাধীন। ইউনিয়নগুলো হলো; চর কালকিনি, সাহেবেরহাট, চর লরেন্স, চর মার্‌টিন, চর ফলকন, পাটারীরহাট, হাজিরহাট, চর কাদিরা এবং তোরাবগঞ্জ।

প্রায় সম্পূর্ণ অঞ্চলটিই নদীভাঙ্গন এলাকা। মেঘনা নদীর কড়াল গ্রাসে তলিয়ে যায় এখানকার হাজারো পরিবারের স্বপ্ন। উত্তাল স্রোতের ভীরে হারাতে হয় তাদের ঘরবাড়ী, জায়গা-জমিসহ জমানো ছোট বড় স্বপ্নগুলো। কেউ কেউ হয়েছেন ঋণী, জায়গাজমি হারিয়ে হয়েছেন নিঃস্ব। অনেকে অস্থায়ীভাবে জমি ভাড়া করে বাড়ি বানিয়ে থাকছেন ছিন্নমূল পরিবেশে। প্রায় ২ যুগ ধরেই চলছে প্রকৃতির এই নিষ্ঠুরতা। কমলনগরের সাহেবেরহাট ইউনিয়নটি নদীভাঙ্গনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ। এখন এই ইউনিয়নের ৮৫ ভাগ তলিয়ে মাত্র ১৫ ভাগ ভূমি অবশিষ্ট আছে। তাছাড়া, চর ফলকন ইউনিয়ন এবং পাটারীহাট ইউনিয়নে অর্ধেকেরও বেশী অংশ তলিয়ে গেছে। এছাড়া চর লরেঞ্জ ইউনিয়ন ৮৫ ভাগ ও চর মার্‌টিন ইউনিয়ন ৯৫ ভাগ অক্ষত রয়েছে। তবে,উপজেলার হাজিরহাট, চর কাদিরা এবং তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নগুলো এখনো নদী ভাঙ্গনের মুখে পড়েনি। আশা করা যায়, তীরবর্তী এলাকায় স্থায়ী বাধ নির্মাণ হলে, স্থানীয়দের সমস্যা সমাধান হবে।

কমলনগর থানা অঞ্চলের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি। প্রায় ৫১ দশমিক তিন ছয় শতাংশ মানুষ কৃষিকাজে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। কমলনগরের বিস্তীর্ণ মাঠে ধানের প্রচুর ফলন হয়। এছাড়াও এ অঞ্চলে আলু, বেগুন, মরিচ, টমেটো, শিম, করলা এবং বিভিন্ন প্রকারের শাকসবজির চাষ হয়ে থাকে। তবে এই অঞ্চল নদীমাতৃক এলাকা হওয়ায় জেলেরা মতিরহাট মেঘনা নদীতে মাছ ধরে বাজারজাত করে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন করে থাকেন। এছাড়াও চাকরি, ব্যবসা ও প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা কমলনগরের অর্থনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

কমলনগরের মানুষ খুবই সহজ সরল ও শান্ত প্রকৃতির। নানাবিধ কর্মতৎপরতায় প্রায়শই মুখরিত হয়ে থাকে স্থানীয় হাটবাজার। এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী মেঘনা ঘাটের ইলিশের চাহিদা সারা দেশ জুড়ে। এখানেই রয়েছে হাজিরহাট, খাসেরহাট, তোরাবগঞ্জ, মতিরহাট সহ প্রায় ১০টিরও বেশি হাটবাজার। অসাম্প্রদায়িক কমলনগরে হিন্দু-মুসলিম সম্মিলিতভাবে বসবাস করে। তাদের ধর্মীয় উপাসনালয় হিসেবে আছে বেশ কয়েকটি মসজিদ ও মন্দির।

শিক্ষাখাতেও ধীরে ধীরে উন্নয়নের ছোঁয়া পাচ্ছে কমলনগরবাসী। এ অঞ্চলে গড় শিক্ষার হার ৪১ শতাংশ। রয়েছে মোট ৪টি কলেজ, ১৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৪টি মাদ্রাসা সহ ৩৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

কমলনগর থানা অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। ঢাকা সরাসরি লক্ষ্মীপুর জেলা সদর পর্যন্ত বাসযোগে এবং লক্ষ্মীপুর হতে কমলনগরে অনায়াসেই বাস,সিএনজি বা অটোরিকশাযোগে কমলনগরে যাতায়াত করা যায়। কমলনগর থানা অঞ্চলে মোট ৬২ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ১২ কিলোমিটার আধ-পাকা রাস্তা, ২৪ কিলোমিটার কাঁচারাস্তা সহ প্রায় ২৫ কিলোমিটার নৌপথ রয়েছে। ফলে, স্বাস্থ্যখাতেও উল্লেখ্যযোগ্য উন্নতি হচ্ছে। থানাবাসী খুব সহজেই তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে উপজেলা সদর সহ নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সেবা নিতে পারছে। কমলনগর থানা অঞ্চলে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৫টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিক সহ ছোট বড় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে।

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।