Kasba Thana

কসবা…বিস্তীর্ণ সমভূমি, লালমাটির মিশেলে গড়া পাহাড়ি টিলাভূমি আর সালদা নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠা অপরুপ এক জনপদ। কসবা শব্দটি ফার্সি, যার অর্থ উপশহর। তৎকালীন ভারতবর্ষের মুসলিম শাসন আমলে এ নামকরন করা হয়। জানা যায়, সুলতানি আমলের উপবিভাগীয় প্রশাসনিক কেন্দ্রস্থল ছিলো এই কসবা। ১৩৩৮ খিস্ট্রাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এ অঞ্চলে কৈলাঘর নামে একটি দূর্গ নির্মাণ করেন, যার আশে পাশে প্রথম দিকে জনবসতি এবং পরবর্তীতে ধিরে ধিরে গড়ে ওঠে ছোট্ট শহর কসবা।  কৈলাগড় দুর্গটির নাম থেকেই কসবা নামটির উৎপত্তি হয়েছে। পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে কসবা থানা গঠিত হলেও দেশভাগের পর ১৯৮৩ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে কসবা উপজেলায় উন্নীত হয়।

 

 

অবস্থানঃ

ঢাকা থেকে ১১২ কিলোমিটার পূর্বাংশে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দক্ষিনে অবস্থিত এক ঐতিহ্যবাহী জনপদ কসবা। এ থানা অঞ্চলের উত্তর দিক দিয়ে বয়ে গেছে তিতাস, সালদা ও বুড়ি নদী সহ বেশ কিছু ছোট- বড় নদনদী ও জলাশয়। তবে এর পূর্বপ্রান্তের ভারত সীমান্তবর্তী এলাকার কিছু অংশে দেখা মিলবে লাল মাটির ছোটবড় পাহাড়ি টিলা। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, প্রায় ২০৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জনপদটিতে বসবাস করেন ৩ লাখ ১৯ হাজার দুইশ একুশ জন মানুষ। এলাকাটির পূর্বদিকে ভারতের ত্রিপুরা, পশ্চিমে মুরাদনগর ও নবীনগর উপজেলা, উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও আখাউড়া উপজেলা এবং দক্ষিণে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার অবস্থান। বর্তমানে এ অঞ্চলটিতে ১টি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়ন রয়েছে এবং সম্পূর্ণ উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম কসবা থানার আওতাধীন। ইউনিয়ন সমূহ হল মূলগ্রাম, মেহারী, বাদৈর, খাড়েরা, বিনাউটি, গোপীনাথপুর, পশ্চিম কসবা, কুটি, কায়েমপুর ও বায়েক।

কসবা থানা অঞ্চল যেন গ্রাম বাংলার এক অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। যেখানে ভোরের আভা ফুটতেই মেঠোপথে কৃষকের ছুটে চলার পাশাপাশি দেখা যায় কর্মজীবী মানুষের আনাগোনা। হাটবাজার, কর্মস্থল, রেলষ্টেশনসহ অফিস-আদালতে ফুটে উঠে চঞ্চলতার চিত্র।

মুক্তিযুদ্ধঃ

৭১এর মুক্তিযুদ্ধে কসবা ছিলো ২ নং সেক্টরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। সে রণাঙ্গনের ২২শে নভেম্বর লতোয়ামুড়া ও চন্দ্রপুরের এক সম্মুখযুদ্ধে প্রান হারান শতাধিক মুক্তিযুদ্ধা। এছাড়াও, কসবার কোল্লা পাথর নামক স্থানে সংগঠিত যুদ্ধে পাকবাহিনীর বিপক্ষে লড়াইয়ে প্রকৌশলী, সিপাহী, সেনা সদস্য ও নারী সহ প্রান হারান প্রায় ৫০ জন নিরীহ বাঙালি। তাদের বীরত্বের স্মৃতি সংরক্ষনে নির্মিত হয়েছে কোল্লা পাথর শহীদ সমাধিস্থল। আরও নির্মিত হয়েছে কেখলা সম্মুখ সমরের স্মৃতিস্তম্ভ, লক্ষ্মীপুর সমাধিস্থল ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন।

শিক্ষাঃ

স্বাধীনতা উত্তর সময় থেকেই কসবাতে শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে এ অঞ্চলের শিক্ষার হার পৌছেছে ৫৬ শতাংশে। রয়েছে কসবা মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও সরকারি আদর্শ মহাবিদ্যালয় সহ ৮টি কলেজ, কসবা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় সহ ৪২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৫৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বেশ কিছু মাদ্রাসা।

যোগাযোগঃ

আইন শৃঙ্খলার সার্বিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকায় এ এলাকার যোগাযোগ ব্যাবস্থায় এসেছে দৃশমান উন্নয়ন। থানাবাসীর দূরপাল্লায় যাতায়াতের সুবিধার্থে এ অঞ্চলের বুক চিরে বয়ে গেছে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক…রয়েছে দীর্ঘ রেলপথসহ কসবা রেলওয়ে স্টেশন। এছাড়াও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের সুবিধার্থে নির্মিত হয়েছে প্রায় ৩৬ কিলোমিটার আধাপাকা রাস্তা, ২১৪ কিলোমিটার পাকা রাস্তাসহ পর্যাপ্ত ব্রিজ ও কালভার্ট।

তবে কসবা থানা অঞ্চলটির বৃহৎ একটি অংশ সীমান্তবর্তী হওয়ায় এখানে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক পরিমান মাদক ও অবৈধ অস্ত্র চোরাচালান জনিত ঘটনা সংগঠিত হয়ে আসছিলো। তবে, চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজি নুরেআলম মিনা যোগদানের পর পরই মাদক চোরাচালান সহ সকল ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহন করেছেন। তারই বিশেষ দিকনির্দেশনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কর্তব্যপরায়ণ পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ শাখাওয়াত হোসেন বিপিএম জেলাবাসীর আইনি নিরাপত্তা নিশ্চিতে যুগোপযোগী ও কার্যকরী কর্মপরিকল্পনা গ্রহন করে যাচ্ছেন। সে লক্ষেই, কসবা সার্কেলের আওতাধীন আখাউড়া থানার পুলিশ সদস্যগণ নিষ্ঠার সাথে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করে চলেছেন।

অর্থনীতিঃ

কসবা থানা পুলিশের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে এ অঞ্চলের মানুষ ভৌগলিক সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বেশ সচ্ছল জীবনযাপন করছে। এলাকাটিতে বিস্তৃত কৃষি জমি থাকায় এখানকার মোট জনগোষ্ঠীর ৫২ শতাংশেরও বেশি মানুষই কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত। ফলে এখানে প্রতি বছর ধান, গম, আলু, ভুট্টা, ডাল সহ রেকর্ড পরিমাণ অর্থকরী ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। যা স্থানীয় বাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করে কৃষকেরা স্বাবলম্বী হচ্ছে। কৃষিকাজের বাইরেও স্থানীয় মানুষজন ব্যবসা, চাকুরিসহ প্রবাসে থেকে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

স্বাস্থ্য

থানাবাসীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে রয়েছে ১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৪টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র সহ ৪টি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান কেন্দ্র এবং ২টি কমিউনিটি ক্লিনিক। এছাড়াও পশুপাখির চিকিৎসায় রয়েছে উপজেলা প্রানিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল। এ থানা অঞ্চলে রয়েছে স্থানীয় সাংবাদিকদের সম্মিলিত সংগঠন কসবা প্রেসক্লাব। রয়েছে পাক্ষিক অপরাধপত্র, পাক্ষিক সকালের সূর্য সহ বেশ কিছু অঞ্চল ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম।

দর্শনীয় স্থানঃ

প্রকৃতির অপার মায়ায় গড়ে ওঠা কসবা থানা অঞ্চলে রয়েছে ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও দর্শনীয় ধর্মীয় স্থাপনা। রয়েছে কোল্লাপাথর শহীদ স্মৃতি পর্যটন কেন্দ্র ও দীঘি, মইনপুর মসজিদ, আড়াইবাড়ি তিন গম্বুজ মসজিদ সহ বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য স্থাপনা। থানায় আগত দর্শনার্থীদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা প্রদানে সোচ্চার অবস্থান পালন করে আসছে কসবা থানা পুলিশ।

কৃতি সন্তানঃ

কসবা থানা অঞ্চলেই জন্ম গ্রহন করেছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব হাসানাত আবদুল হাই। তার অনবদ্য সাহিত্য কর্মের জন্য তিনি ১৯৯৬ সালের ‘একুশে পদক’ সহ লাভ করেছেন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পুরস্কার। দেশের প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক এর জন্মস্থানও এই কসবা।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।