Lakshmipur-Model-Thana

মেঘনার কোল ঘেঁষে গড়ে উঠা সয়াবিন আর সুপারির রাজ্য খ্যাত একটি জনপদ; নাম লক্ষ্মীপুর। লক্ষ্মী মানে সৌভাগ্য এবং পুর অর্থ নগর। তাই, লক্ষ্মীপুরকে সৌভাগ্যের নগরও বলা হয়ে থাকে।

তবে লক্ষ্মীপুরের নামকরণের ইতিহাসে রয়েছে বিভিন্ন মত। জানা যায়, কৈলাশ চন্দ্র সিংহ রচিত “রাজমালা বা ত্রিপুরার’র” ইতিহাসে তৎকালীন নোয়াখালীর পরগণা ও মহালগুলোর নাম উল্লেখ করেছেন। সে বইতে দেখা যায়, সমসেরাবাদ মৌজার পশ্চিমে লক্ষ্মীপুর নামে একটি মৌজা ছিলো। আবার, কারো মতে, লক্ষ্মীপুরের প্রাচীন নাম ছিলো লক্ষ্মদহ। দহ শব্দের অর্থ বিশাল জলাশয়। এ জলাশয়ে পাওয়া যেতো প্রচুর মাছ। সেই মাছ বিক্রয় করে এলাকাবাসী প্রচুর অর্থ উপার্জন করতো। তাই লক্ষ্মী বা সৌভাগ্যের এই দহটি এলাকার সবার কাছে লক্ষ্মীদহ নামে সবার কাছে পরিচিতি লাভ করে। কালের বিবর্তনে লক্ষ্মীদহ থেকেই লক্ষ্মীপুর এর নাম উৎপত্তি।

এ সৌভাগ্যের নগরটিই এখন একটি জেলা শহর। তবে, লক্ষ্মীপুর সর্বপ্রথম থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬০ সালে। অতঃপর ১৯৭৬ সালে বাঞ্চানগর ইউনিয়ন লক্ষ্মীপুর পৌরসভায় রুপান্তরিত হলে, ক্রমশ গুরুত্বালাভ করে। ১৯৮৪ সালে লক্ষ্মীপুর জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে, লক্ষ্মীপুর সদর থানা গঠিত হয় যা বর্তমানে লক্ষ্মীপুর মডেল থানায় উন্নীত হয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

 

 

ঢাকা থেকে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত একটি প্রাচীন জনপদ লক্ষ্মীপুর। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মোট আয়তন ৪৮০ দশমিক তিন ছয় বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। লক্ষ্মীপুর সদরের পূর্ব দিকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলা, পশ্চিমে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর, মেঘনা নদী, এবং ভোলা জেলা;  উত্তরে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলা এবং দক্ষিণে কমলনগর উপজেলা অবস্থিত। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা মোট ২১টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত হলেও লক্ষ্মীপুর মডেল থানা ১টি পৌরসভা এবং ১২টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। ইউনিয়নসমূহ হলো; উত্তর হামছাদী, দক্ষিণ হামছাদী, দালাল বাজার, চর রুহিতা, পার্বতীনগর, বাঙ্গাখাঁ, লাহারকান্দি, শাকচর, ভবানীগঞ্জ, তেওয়ারীগঞ্জ, চর রমণীমোহন ও টুমচর। তন্মধ্যে, চর রমণীমোহন ইউনিয়নটি মেঘনা তীরবর্তী এলাকা হওয়ায় প্রায়শই নদীভাঙ্গনের শিকার হয় এ এলাকার মানুষ।

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ্মীপুরের রয়েছে নির্মম ইতিহাস। এপ্রিলের শেষভাগে পাক হানাদার বাহিনি লক্ষ্মীপুরে আসতে শুরু করে। হানাদারদের রুখতে, রহমতখালী খালের ব্রিজটি উড়িয়ে দেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। অতঃপর হানাদারেরা সেখানে বেইলি ব্রিজ এবং একটি বাংকার নির্মাণ করে। এই ব্রিজেই হাজার হাজার মানুষকে ধরে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করে লাশ ফেলে দিতো ঘাতকেরা। হানাদারদের উৎখাত করতে লক্ষ্মীপুর জেলা কমান্ডার আনোয়ারুল হক মাস্টারের নেতৃত্বে এক পরিকল্পনার ছক আঁকেন মুক্তিযোদ্ধারা। শুরু হয় ছোট বড় বিভিন্ন অপারেশন। মুক্তিযোদ্ধারা ৩ই ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর সদর থেকে শুরু করে উত্তর মজুপুর, সাহাপুর ও বাগবাড়িসহ পুরো এলাকা ঘিরে ধরলে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে হানাদারেরা টিকতে না পেরে রাজাকারদের ক্যাম্পে রেখে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। অতঃপর ৪ই ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের স্মৃতি আজীবন স্মরণ রাখতে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ, নির্মিত হয়েছে ৭১ এর গনহত্যার শহীদ সমাধি, পাশেই রয়েছে লক্ষ্মীপুর জেলা কমান্ডার আনোয়ারুল হক মাস্টারের সমাধিসৌধ।

বর্তমানে সমৃদ্ধির দিকে এগোচ্ছে লক্ষ্মীপুর সদর। ছুটতে শুরু করেছে অর্থনীতির চাকা। সদর এলাকা হওয়ায় ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ব্যপক হারে লক্ষণীয়। তবে, এ এলাকার বেশিরভাগ মানুষ কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল। কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত ধান, পাট, ডাল, শাকসবজি, মরিচ, পেঁয়াজ সহ বিভিন্ন ফল ফলাদি তাদের খাদ্যচাহিদা মিটিয়ে বাজারজাত করে থাকে। তাছাড়া, লক্ষ্মীপুরের ঐতিহ্য সুপারি আর সয়াবিন চাষ হচ্ছে প্রায় প্রতিটি এলাকায়। লক্ষ্মীপুরের প্রতিটি বাড়িতে দেখা মিলে সারি সারি সুপারি গাছ। দেশের সিংহভাগ সয়াবিন এবং সুপারির চাহিদা পূরন হয় এই লক্ষ্মীপুর থেকেই। এছাড়াও হ্যাচারি, বাড়ির পুকুরে মৎস্যচাষ, গবাদিপশু পালন সহ বিভিন্ন খাতে ভূমিকা রাখছে লক্ষ্মীপুর সদরের মানুষজন।

বর্তমানে শিক্ষাখাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করছে লক্ষ্মীপুর সদর। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ অঞ্চলের শিক্ষার হার ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ। লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন নামীদামী স্কুল কলেজের অবস্থান এ থানা অঞ্চলেই অবস্থিত। এখানেই রয়েছে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ, লক্ষ্মীপুর সরকারি মহিলা কলেজ সহ মোট ৬ টি কলেজ, ৬৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২০০শরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং বেশ কয়েকটি মাদ্রাসা।

অসাম্প্রদায়িক লক্ষ্মীপুর সদর হিন্দু,মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের সম্মিলিত বসবাস। তবে এ এলাকাটি একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। উপাসনার জন্য রয়েছে ৩০০ বছর পুরুনো তিতাখা জামে মসজিদ সহ মোট ৭০০শোরও বেশি মসজিদ, শ্রী শ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ দেব বিগ্রহ মন্দির সহ ৩টি মন্দির ও সেন্ট জোসেফ চার্চ নামে একটি গির্জা।

যোগাযোগের দিক দিয়েও অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে এ অঞ্চলে। ঢাকা থেকে সরাসরি বাস চলাচল সুবিধা থাকায়, লক্ষ্মীপুরবাসী এখান থেকেই দেশের সব জায়গায় অনায়াসে যাতায়াত করতে পারছেন। তাছাড়া রাস্তাঘাটের উন্নতির ফলে সদর হতে সব উপজেলায় নির্বিঘ্নে যাতায়াত সম্ভব হচ্ছে। ফলে সকলেই স্বাস্থ্যসেবায় সুফল পাচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে রয়েছে জেলা সদর হাসপাতাল, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক সহ ছোটবড় বেসরকারী হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

তাছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দাপ্তরিক প্রতিষ্ঠান যেমন, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস, উপজেলা পরিষদ, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, পৌরসভার কার্যালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশন সহ বিভিন্ন আর্থিক সেবাদান প্রতিষ্ঠান রয়েছে লক্ষ্মীপুর সদর এলাকায়।

লক্ষ্মীপুরের কামানখোলায় রয়েছে তিন শতাধিক বছরের প্রাচীন জমিদার হরেন্দ্র বাবুর কামানখোলা জমিদার বাড়ি। রয়েছে মেঘনা কূলে গড়ে উঠা মজু চৌধুরীর হাট; যেখানে দেখা যায় সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য। দালাল বাজার এলাকায় রয়েছে ৪০০শত বছর পুরনো দালাল বাজার জমিদার বাড়ি। এ বাড়ির রাজকীয় প্রবেশদ্বার, প্রাসাদ, অন্দরমহন ও শান বাধানো পুকুরঘাট মুগ্ধ করে দূর-দুরান্ত থেকে ছুটে আসা পর্যটকদের। এখানে আরো রয়েছে ৩০০ বছরের পুরনো বিশাল আয়তনের খোয়াসাগর দীঘি। প্রায় ২২ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এ দিঘিটির স্বচ্ছ পানি ও মনোরম পরিবেশ কাছে টানে অসংখ্য বিনোদনপ্রেমিদের।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।