Lakshmipur Zila

দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত চট্রগ্রাম বিভাগের একটি বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল লক্ষ্মীপুর জেলা। এ অঞ্চলটি তার অনন্য লোকবৈচিত্র, এবং নদীমাতৃক গ্রামীণ পরিবেশের কারণে দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী জেলা হিসেবে স্থান পেয়েছে।

হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতিতে লালিত এই জনপদের রয়েছে বিস্তর ইতিহাস। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লক্ষ্মীপুর ভুলুয়া রাজ্যের অধীনে ছিলো। সেই ভুলুয়া রাজ্যের একটি পরগনার নাম ছিলো লক্ষ্মীদাহ পরগনা। জানা যায়, এই লক্ষ্মীদাহ পরগণা থেকেই লক্ষ্মীপুর নামের উৎপত্তি। ১৯০৬ সালের স্বদেশী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এ অঞ্চল। সেসময় মহাত্মা গান্ধী তার অহিংসা বানী নিয়ে ভ্রমণ করেন লক্ষ্মীপুরে। তাছাড়া বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও ১৯২৬ সালে লক্ষ্মীপুর ভ্রমনে আসেন।

এ অঞ্চলটি সর্বপ্রথম থানা হিসেবে গঠিত হয় ১৮৬০ সালে। অতঃপর ১৯৭৬ সালে লক্ষ্মীপুর পৌরসভায় উন্নীত হলে তা বিশেষ গুরুত্বালাভ করে। ফলে, ১৯৭৯ সালের ২৯শে জুলাই লক্ষ্মীপুর মহকুমা গঠিত হয়; যা ১৯৮৪ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ সময়ে নোয়াখালী থেকে বিভক্ত হয়ে লক্ষ্মীপুর জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

বর্তমানে লক্ষ্মীপুর দেশের একটি বিশেষ জেলা অঞ্চল। এ অঞ্চলের সকল নাগরিকের আইনি সেবা নিশ্চিতে অতন্ত প্রহরী হয়ে আছে লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশ। চট্রগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের প্রধান অভিভাবক তথা ৬১তম উপমহাপরিদর্শক নূরে আলম মিনার সার্বিক দিক নির্দেশনায়, লক্ষ্মীপুর জেলার সকল জনসাধারণের সার্বিক নিরাপত্তা, সামাজিক সচেতনতা এবং আইন শৃঙ্খলার মান সমুন্নত রাখতে বিচক্ষণতার সাথে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন জেলার সুযোগ্য পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ পিপিএম। তিনি গত ২৭শে জুলাই ২০২৩ তারিখে লক্ষ্মীপুর জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করার পর থেকেই জনমুখী বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। তাঁরই যুগান্তকারী নেতৃত্বে কিভাবে চলছে লক্ষ্মীপুরের পুলিশি সেবার সার্বিক কার্যক্রম, অপরাধ প্রবনতাই বা কেমন? সেসব প্রশ্নের যথার্থ উত্তর, জেলার সমসাময়িক পরিস্থিতি, দর্শনীয় স্থানসহ সকল বিষয়াদি নিয়ে আমাদের আজকের সবুজ সংকেত “লক্ষ্মীপুর জেলা”।

 

 

ঢাকা থেকে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত একটি ক্রমবর্ধমান জনপদ লক্ষ্মীপুর জেলা। বর্তমানে লক্ষ্মীপুর জেলাটি মোট ৪টি পৌরসভার সমন্বয়ে ৫টি উপজেলা, ৪৭৪ টি মৌজা, ৫৪৭টি গ্রাম নিয়ে গঠিত। জেলাবাসীর আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় সুযোগ্য পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ পিপিএম এর নেতৃত্বে লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশের আওতাধীন রয়েছে মোট ৬ টি থানা যথাক্রমে; রামগঞ্জ থানা, রায়পুর থানা, রামগতি থানা, কমলনগর থানা, চন্দ্রগঞ্জ থানা এবং লক্ষ্মীপুর সদর থানা।

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী লক্ষ্মীপুর জেলার মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ লক্ষ ২৯ হাজার একশ আটাশি জন এবং আয়তন ১৪৫৬ বর্গ কিলোমিটার। এ জেলার পূর্ব দিকে নোয়াখালী, পশ্চিমে মেঘনা নদী, ভোলা ও বরিশাল জেলা; উত্তরে চাঁদপুর এবং দক্ষিণে ভোলা ও নোয়াখালী জেলা অবস্থিত।

১৯৭১ এর রণাঙ্গনে লক্ষ্মীপুরের রয়েছে বীরত্বগাঁথা ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের উত্তাল ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে লক্ষ্মীপুরের মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীনের তীব্র ক্ষুদায় যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। পাকিস্তানী হানাদারেরা ৭১ এর এপ্রিলে লক্ষ্মীপুর জেলায় প্রবেশ করলে তাদের রুখতে মুক্তিযোদ্ধারা লক্ষ্মীপুরের প্রবেশপথ ধ্বংস করে দেয়। তবুও পিছপা হয়নি হিংস্র হানাদারেরা। তারা বাগবাড়ি বীজ গোডাউনে ক্যাম্প স্থাপন করে নিরীহ মানুষদের উপর চালায় অমানুষিক অত্যাচার। এসবের প্রতিশোধ নিতে এবং হানাদারমুক্ত করতে করতে জেলা কমান্ডারের নেতৃত্বে প্রাণপণে জেগে উঠে মুক্তিযোদ্ধারা। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। ছোট বড় মোট ৩৭টি যুদ্ধ সংঘটিত হয় এ অঞ্চলে। সর্বশেষ ৩ই ডিসেম্বরে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলে তোপের মুখে টিকতে না পেরে রাজাকার-আলবদরদের ক্যাম্পে রেখে নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় হানাদারবাহিনী। অতঃপর মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় মিছিল শুরু করলে নিরুপায় হয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় রাজাকারেরা। এভাবেই ৪ই ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় লক্ষ্মীপুর জেলা। তাদের বীরত্ব আজীবন স্মরণ রাখতে নির্মিত হয়েছে ৩টি স্মৃতিস্তম্ভ, ৭১ এর গনহত্যার শহীদ সমাধি সহ ২টি বধ্যভূমি এবং ৪টি স্মৃতিস্তম্ভ।

বর্তমানে লক্ষ্মীপুর একটি স্বনির্ভর জেলা। এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি। অর্থকরী ফসল হিসেবে ধান, গম, সরিষা, আলু, চীনাবাদাম ও নানারকম শাকসবজি উৎপাদন হয় লক্ষ্মীপুরে। তবে, এ জেলা নারিকেল, সুপারি, সয়াবিন ও ইলিশের জন্য সারাদেশে বিখ্যাত। সয়াবিন উৎপাদনে বিশ্বের ৩৫তম এবং দেশের প্রথম স্থান দখল করে আছে লক্ষ্মীপুর জেলা। শুধু তাই নয়, এ জেলা ইলিশ উৎপাদনে সারাদেশে ৩য়, নারিকেল উৎপাদনে ২য় এবং সুপারি উৎপাদনে সর্বপ্রথম অবস্থানে রয়েছে। নারিকেল, সয়াবিন ও সুপারি বাজারজাত করে সারাদেশের চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে রপ্তানিতে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা রাখছে লক্ষ্মীপুরবাসী। ফলে নতুন ভাবে এগোচ্ছে অর্থনীতির চাকা। উন্নয়নশীল অঞ্চল হতে ক্রমশ উন্নত অঞ্চলে রুপান্তরিত হচ্ছে। লক্ষ্মীপুরের প্রায় সকল থানা অঞ্চলের পুকুরে চাষ হয়ে হরেক রকম মাছ। তাছাড়া হ্যাচারি, হাস-মুরগি ও গবাদীপশু পালন সহ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে নিয়োজিত আছে লক্ষ্মীপুরের গ্রামীণ জনপদ। অপরদিকে, শহরবাসীদের অধিকাংশই চাকরি, ব্যবসাসহ বিভিন্ন খাতে লক্ষ্মীপুরের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তবে ব্যতিক্রমী হিসেবে দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় এ জেলায় প্রবাসীর সংখ্যা বেশি। সারাদেশের ন্যায় লক্ষ্মীপুরের প্রবাসীরা বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।

দেশবরেণ্য ব্যাক্তিদের জন্মস্থান এই লক্ষ্মীপুর। এখানেই জন্মগ্রহন করেছিলেন ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী মোহাম্মদ তোয়াহা। জন্মগ্রহন করেন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী ব্যক্তি আ.স.ম আব্দুর রব। বাংলাদেশের প্রথম নারী এভারেস্ট বিজয়ী নিশাত মজুমদার, টিভি অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ, নাট্য ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রী দিলারা জামান এবং জনপ্রিয় অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানের জন্মস্থানও এই লক্ষ্মীপুর।

শিক্ষাখাতে অন্যান্য জেলার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে লক্ষ্মীপুর। বর্তমানে লক্ষ্মীপুর জেলার স্বাক্ষরতার হার ৬২.০১ শতাংশ। রয়েছে প্রায় ১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৫৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৪টি স্কুল এন্ড কলেজ, ৪টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ২৮টি কলেজ, একটি বিশ্ববিদ্যালয় সহ শতাধিক মাদ্রাসা। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় লক্ষ্মীপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাওয়ায় লক্ষ্মীপুরবাসীর আশার আলো ফুটছে।

রাজধানী ঢাকার সাথে লক্ষ্মীপুর জেলার সরাসরি যোগাযোগে রয়েছে লক্ষ্মীপুর-ঢাকা মহাসড়ক। মুজিব চত্বরেই রয়েছে লক্ষ্মীপুর বাস স্ট্যান্ড; এখান থেকেই চাঁদপুর-লক্ষ্মীপুর মহাসড়ক এবং কুমিল্লা-লক্ষ্মীপুর মহাসড়কের কল্যাণে দেশের নানা প্রান্তে অনায়াসেই যাতায়াত করতে পারছেন লক্ষ্মীপুরবাসী। তাছাড়া এ জেলাটি নদীমাতৃক এলাকা হওয়ায় নদী পথেও ভোলা সহ বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত সম্ভব হচ্ছে; লক্ষ্মীপুরবাসির প্রানের দাবি ঢাকা-লক্ষ্মীপুর নৌপথ চালু হওয়ায় যোগাযোগব্যবস্থা আরো সময় সাশ্রয়ী হয়ে উঠছে। যোগাযোগের সুবিধা থাকায় স্বাস্থ্যখাতেও উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। জেলাবাসীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে জেলা সদর হাসপাতাল সহ উপজেলাভিত্তিক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রসহ ইউনিয়ন ভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক এবং বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ক্লিনিক রয়েছে।

বর্তমানে উন্নয়নের ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে লক্ষ্মীপুর জেলা। জেলাবাসীর বিভিন্ন প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে নানা দাপ্তরিক প্রতিষ্ঠান। রয়েছে লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশ লাইন্স, জেলা প্রসাশকের কার্যালয়, সিভিল সার্জন কার্যালয়, নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়, উপ-কর কমিশনারের কার্যালয়, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, সার্কিট হাউজ, ত্রান গুদাম কাম দুর্যোগব্যবস্থাপনা তথ্য কেন্দ্র, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, জেলা কারাগার, কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, বিভিন্ন আর্থিক সেবাদান প্রতিষ্ঠান সহ উপজেলা গুলোতে উপজেলাভিত্তিক প্রায় সকল সরকারি-বেসরকারি পরিদপ্তর। তাছাড়া খেলাধুলার জন্য নির্মিত হয়েছে লক্ষ্মীপুর জেলা স্টেডিয়াম। এবং শিশু কিশোরদের জন্য রয়েছে পৌর শিশু পার্ক।

অসাম্প্রদায়িক এ অঞ্চলটি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সম্মিলিত বসবাস। তবে এটি একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯৫ দশমিক ৩১ শতাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বী, তাছাড়া ৪ দশমিক ৬৬ ভাগ হিন্দু এবং ০ দশমিক শুন্য তিন শতাংশ বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারী। ধর্মীয় উপাসনার জন্য রয়েছে প্রায় ৩৫৩৯টি মসজিদ, ৪৫টি মন্দির এবং ১টি গির্জা। তন্মধ্যে, পৌর বাজার এলাকায় প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো ইতিহাসের ধারক ও বাহক হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে লক্ষ্মীপুরের ঐতিহাসিক তিতাখাঁ জামে মসজিদ। রামগতিতে রয়েছে আধুনিক যুগে চোখ ধাঁধানো স্থাপত্যের জটিল সংমিশ্রণ আর দৃষ্টিনন্দন আস-সালাম জামে মসজিদ ও ঈদগাহ সোসাইটি।

লক্ষ্মীপুরের গ্রামীণ বৈচিত্র্যময়তা মুগ্ধ করে নানা শ্রেনীপেশার মানুষদের। মেঘনা কূলে গড়ে উঠা মতিরহাট সৈকতের নান্দনিক রূপ দেখতে ভীর করেন দেশের নানা পর্যটক। দালাল বাজার এলাকায় রয়েছে ৩০০ বছরের পুরনো বিশাল আয়তনের খোয়াসাগর দীঘি। প্রায় ২২ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এ দিঘিটির স্বচ্ছ পানি ও মনোরম পরিবেশ কাছে টানে অসংখ্য বিনোদনপ্রেমিদের। লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে রয়েছে ১৮৮৮ সালে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন জ্বীনের মসজিদ যা বর্তমানে মসজিদ-ই-আব্দুল্লাহ নামে পরিচিত। আরো রয়েছে জমিদার লক্ষ্মী নারায়ণের নির্মিত প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো এক ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি “দালাল বাজার জমিদার বাড়ি”।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।