Nabinagar thana Sobuj Songket Thumbnail 2024 02

নবীনগর… অবারিত সবুজে ঘেরা প্রান্তরে একে বেঁকে চলা মেঠো পথ আর পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী… যেন গ্রাম বাংলার সহজ সরল জনজীবনের ফুটে ওঠা এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি। তিতাস, মেঘনা ও বুড়ি নদীর কোলঘেষে গড়ে ওঠা ঐতিহাসিক এ জনপদটি বৌদ্ধ যুগে সমতট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যা মুসলিম যুগে ৩টি পরগনায় বিভক্ত ছিল। জানা যায়, মুসলিম শাসনামলে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর দিনে নবী এবং নগর শব্দ দুটির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এ অঞ্চলের নামকরন করা হয় ‘নবীনগর’। ১৮৭৫ সালে এটি থানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালের ২৪শে মার্চ প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে উপজেলায় উন্নীত হয়।

 

 

অবস্থানঃ

ঢাকা থেকে প্রায় ১১১ কিলোমিটার উত্তর পূর্বাংশে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দক্ষিন পশ্চিমে অবস্থিত এক বিস্তৃত জনপদ নবীনগর। এ থানা অঞ্চলের পূর্ব দিকে কসবা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা, পশ্চিমে মেঘনা নদী, বাঞ্চারামপুর ও রায়পুরা উপজেলা, উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও আশুগঞ্জ উপজেলা এবং দক্ষিণে কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার অবস্থান।

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ৩৫০.৩৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জনপদটিতে ৪ লাখ ৯৩ হাজার পাঁচশ আঠারো জন মানুষ বসবাস করলেও বর্তমানে জনসংখ্যা ৮ লাখ ছাড়িয়েছে। নবীনগর ১টি পৌরসভা ও ২১টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত। ইউনিয়ন সমূহ হল- বড়াইল, বীরগাঁও, কৃষ্ণনগর, নাটঘর, বিদ্যাকুট, পূর্ব নবীনগর, পশ্চিম নবীনগর, বিটঘর, শিবপুর, শ্রীরামপুর, জিনোদপুর, লাউর ফতেপুর, ইব্রাহিমপুর, সাতমোড়া, শ্যামগ্রাম, রাসুল্লাবাদ, বড়িকান্দি, ছলিমগঞ্জ, রতনপুর, দক্ষিন কাইতলা এবং উত্তর কাইতলা।

মুক্তিযুদ্ধঃ

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ অঞ্চলে রচিত হয়েছে বীরত্বের মহাকাব্য। রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে নবীনগরের প্রায় ২ হাজার ৪০০ মানুষ সরাসরি অংশ নেয়। এলাকার বিভিন্ন স্থানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু যুদ্ধ সংগঠিত হলেও নবীনগর সদর ও ইব্রাহিমপুরে সংগঠিত যুদ্ধ তার মধ্যে অন্যতম। ১৪ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী তাদের সুনিপুণ পরিকল্পনায় পাকিস্তানিদের ক্যাম্প আক্রমন করলে আত্মসমর্পনে বাধ্য হয় পাকবাহিনী। ফলে শত্রু মুক্ত হয় নবীনগর। শহীদ বহু মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ বাঙ্গালিদের আত্মত্যাগের স্মৃতিকে আজীবন স্মরণীয় করে রাখতে সংরক্ষিত আছে ৩টি গনকবর, নির্মিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সম্বলিত স্মৃতিস্তম্ভ ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন।

শিক্ষাঃ

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই এ অঞ্চলের শিক্ষাখাতে বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। বর্তমানে এ অঞ্চলের শিক্ষার গড় হার ৬৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। রয়েছে নবীনগর সরকারি কলেজ সহ মোট ৫টি কলেজ, নবীনগর সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় সহ ৪৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, প্রায় ১৪৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বেশকিছু নামকরা মাদ্রাসা। শিক্ষার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চার দিকেও বিশেষ নজর দিয়ে আসছে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

যোগাযোগঃ

একসময় যাতায়াতে বেশ বেগ পোহাতে হতো এ থানা অঞ্চলের মানুষদের। তবে, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসতে শুরু করেছে দৃশ্যমান উন্নয়ন। ভুলতা – নবীনগর – রাধিকা সড়ক, কোম্পানিগঞ্জ – নবীনগর সড়ক, বাঞ্ছারাম – নবীনগর সড়কের কল্যাণে খুব সহজেই বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করতে পারছে থানাবাসী। রয়েছে মোট ৮৫ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৩২ কিলোমিটার আধাপাকা রাস্তাসহ অভ্যন্তরীণ সড়কপথ। ও পর্যাপ্ত ব্রিজ কালভার্ট। তবে, নদী বিধৌত থানা অঞ্চল হওয়ায় নবীনগরের প্রতিটি প্রান্তে সড়ক পথে পৌঁছানো সম্ভব না হলেও নৌপথে যাতায়াতের পর্যাপ্ত সুবিধা থাকায় যোগাযোগ সহজতর হচ্ছে। রয়েছে ১০৪ কিলোমিটার নৌপথ, বিভিন্ন নৌযান এবং একাধিক ফেরি ও লঞ্চঘাট।

অর্থনীতিঃ

থানা পুলিশের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ও নিবিড় তত্ত্বাবধায়নে এ অঞ্চলের মানুষজন নির্বিঘ্নে তাদের জীবনমান পরিচালনা করে আসছে। অধিকাংশ মানুষ কৃষি পেশার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য পরিমান অর্থকরী ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। তাছাড়া পর্যাপ্ত পরিমান নদী, খাল-বিল ও জলাশয় থাকায় এখানকার একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী মৎস্য উৎপাদন ও আহরনের সাথেও যুক্ত আছেন। ফলে এ থানা অঞ্চলে প্রতিবছর প্রায় ৮ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হচ্ছে। এছাড়া এ এলাকার বেশ কিছু মানুষ সম্পৃক্ত রয়েছে কাঠ ব্যবসার সাথে। পাশাপাশি চাকুরি, ব্যবসা, পরিবহণ খাত সহ প্রবাসে থেকে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে নবীনগরবাসী।

স্বাস্থ্যঃ

তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে রয়েছে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৮টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ১৪টি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান কেন্দ্র সহ বেশ কিছু ক্লিনিক। তাছাড়া গবাদি পশুর স্বাস্থ্য সেবায় রয়েছে উপজেলা প্রানীসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল। এছাড়া নবীনগর থানা অঞ্চলে রয়েছে সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্ব মূলক সংগঠন নবীনগর রিপোর্টার্স প্রেসক্লাব।

কৃতিসন্তানঃ

এ থানা অঞ্চলে জন্মগ্রহন করেছেন বহু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ। জন্মগ্রহন করেন বিশ্ববরেণ্য সুরসম্রাট উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। বিখ্যাত সাধক কবি মনোমোহন দত্তের জন্মস্থানও এ থানা অঞ্চলেই। তার স্মরণে সাতমোড়া ইউনিয়নে স্থাপন করা হয়েছে একটি ম্যুরাল। এছাড়া বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী অতীন্দ্রমোহন রায়, একুশে পদক প্রাপ্ত সঙ্গীতশিল্পী ও সুরকার আবেদ হোসেন খান, বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব আলি যাকের, জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেতা আলমগীর সহ বহু রথি মহারথীদের জন্মস্থান এই নবীনগর থানা অঞ্চল।

দর্শনীয় স্থানঃ

নবীনগর থানা অঞ্চলে রয়েছে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ও মনোমুগ্ধকর দর্শনীয় স্থান। রয়েছে প্রাচীন বাংলার জমিদারদের স্মৃতি বিজড়িত রায়বাড়ির জমিদার বাড়ি, ধরভাঙ্গা গ্রামে অবস্থিত মেঘনার কোল ঘেঁষা এমপি টিলা, শিবপুর খাঁ পাড়া জামে মসজিদ, প্রাচীন শ্যাম গ্রাম মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, সাধক মহেন্দ্র নারায়ন চৌধুরীর উপাসনালয় ও মনোমোহন পাবলিক পার্ক সহ বিভিন্ন মাজার শরীফ। এসব দৃষ্টিনন্দন স্থান ও স্থাপনাসমূহে আগত সকল দর্শনার্থীদের নিরাপত্তায় সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রেখে চলেছে নবীনগর থানা পুলিশ।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।