Nachole Thana

হারিয়ে যাওয়া গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর, গ্রামীণ রুপবৈচিত্রতা আর মায়াময় প্রকৃতির মিশেলে গড়া একটি জনপদ….নাম নাচোল। এটি তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলামিত্রের স্মৃতি বিজড়িত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার একটি বিশেষ থানা অঞ্চল।

নাচোল এর নামকরণে রয়েছে বিস্তর ইতিহাস। ধারনা করা হয়, ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় এ এলাকার নামকরণ হয়েছিলো। ১৮১৩ সালে মালদহ জেলা গঠিত হলে, নাচোল থানা এ জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীতে “মালদহ জেলার ইতিকথা” গ্রন্থে নাচোল নামকরনের বিবরনে পাওয়া যায়, সাঁওতাল অধ্যুষিত এ অঞ্চলটিতে প্রায়ই নাচের আসর হতো। আর এ নাচে অংশগ্রহনের জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে দলবেধে ছুটে আসতেন সাঁওতাল রমণীরা। এই “নাচে চল” শব্দ থেকেই প্রথম “নাচচল” এবং বিবর্তিত হয়ে “নাচোল” শব্দের উৎপত্তি হয়।

নাচোল ১৯১৮ সালে থানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ কালে উপজেলায় উন্নীত হয়।

ঢাকা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর হতে ২৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত একটি প্রাচীন জনপদ নাচোল। এটি একটি পৌরসভা এবং ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। ইউনিয়ন সমূহ হলো; কসবা, ফতেহপুর, নাচোল এবং নেজামপুর ইউনিয়ন।

তন্মধ্যে নাচোলের ফতেহপুর এলাকার কূল ঘেঁসেই বয়ে গেছে মহানন্দা নদী যা বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্তবর্তী গঙ্গার একমাত্র উপনদী মহানন্দা নদী। নাচোল থানা অঞ্চলের পূর্ব দিকে রাজশাহী জেলার তানোর এবং নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলা; উত্তর-পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলা এবং দক্ষিণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা অবস্থিত।

১৯৪৬ সালের তেভাগা আন্দোলনের ন্যায় ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধেও ছিলো নাচোলবাসীর প্রত্যক্ষ ভূমিকা। বিশেষকরে এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধে সাউতাল জনগোষ্ঠীর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯শে এপ্রিলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা এলাকায় পাকবাহিনীরা ব্যপক গুলিবর্ষণ শুরু করে। হানাদারদের আক্রমণ ও নির্বিচারে গুলিবর্ষণে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পাকবাহিনী যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য নাচোলের প্রায় ২০০ প্রতিরোধযোদ্ধা নাচোল-আমনুরা রেললাইনের ৩টি সেতু সহ সড়ক পথের কয়েকটি সেতুও ধ্বংস করা হয়। এসবের ফলে নাচোলে পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশ বিলম্বিত হয়। তবে প্রবল আক্রমনে প্রতিরোধ চেষ্টা ব্যর্থ হলে পরিকল্পনার ছক আঁকেন মুক্তিযোদ্ধারা। শুরু হয় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ এবং গেরিলা ট্রেনিং। ২৮শে এপ্রিল পাকবাহিনী নাচোল থানা আক্রমণ করলে উভয় পক্ষে যুদ্ধ হয়। এটি নাচোল থানা যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর হিংস্রাত্তক আক্রমণে তিনজন বাঙালি সিপাহি শহীদ হন। থানা দখলের পর রাজাকারদের সহায়তায় বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লোটতরাজ সহ অমানুষিক নির্যাতন চালাতো হানাদারেরা। এসব নিসংস্র হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি আজীবন স্মরণ রাখতে নির্মিত হয়েছে নাচোল ডিগ্রি কলেজ স্মৃতিসৌধ এবং নাচোল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় স্মৃতিস্মারক।

বর্তমানে নাচোল একটি স্বনির্ভর থানা অঞ্চল। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী নাচোল থানা অঞ্চলের জনসংখ্যা ১ লক্ষ ৫০ হাজারেরো অধিক। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রধান আয়ের উৎস কৃষি। এ এলাকার মানুষ ধান, আলু, পিয়াজ, রসুন, বিভিন্ন রকমের ডাল এবং শাকসবজির ফলন করে থাকেন। তাছাড়া গবাদিপশু পালন, হ্যাচারী, মৎস্যচাষ, হাঁস-মুরগির খামারে নিয়োজিত হয়ে অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে নাচোলবাসী। এ অঞ্চলের প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠিয়ে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এছাড়াও, নাচোল থানা অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন ব্যবসা, চাকুরি ও শিল্প খাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে ।

নাচোল এর মানুষজন খুবই মিশুক ও শান্তিপরায়ণ। রয়েছে নানা জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলিত বসবাস। অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ব্যতিক্রমি এ অঞ্চলটিতে আদিবাসীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকবৈচিত্র লক্ষ করা যায়। সাঁওতাল ছাড়াও মুন্ডা, ওরাওঁ, মাহালী জনগোষ্ঠীর বসবাস এই নাচোল। অসাম্প্রদায়িক এ অঞ্চলটিতে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্ঠান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা মিলে মিশে বসবাস করেন। তাদের উপাসনার জন্য রয়েছে, ৩৬৭টি মসজিদ এবং ৪টি মন্দির।

নাচোল এখন আগের চেয়ে আরো সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠছে। শিক্ষাখাতে আলোর মুখ দেখছে নাচোলবাসী। বর্তমানে নাচোল থানা অঞ্চলের শিক্ষার হার ৪৯ শতাংশ। এখানেই রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এশিয়ান স্কুল এন্ড কলেজ। রয়েছে নাচোল সরকারী কলেজ সহ মোট ৮টি কলেজ, ২৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ প্রায় ৪৭টিরও বেশী বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। আরো রয়েছে ইলামিত্রের স্মরনে নির্মিত ইলামিত্র গনপাঠাগার ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র।

যোগাযোগখাতেও এসেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। আমনুরা-নাচোল সড়কপথে খুব সহজেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরে যাতায়াত করা যায়। তাছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ হয়ে ঢাকা-রাজশাহী জাতীয় মহাসড়ক দিয়ে এবং রেলপথে সরাসরি ঢাকায় যোগাযোগ করা যায় এ অঞ্চল থেকেই। রয়েছে মোট ১৫১টি সড়কপথ, ১২৬ কিলোমিটার পাকারাস্তা, ৩১৬ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা এবং মোট ১৬ কিলোমিটার আধা-পাকা রাস্তা।

যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় স্বাস্থ্যখাতেও সুফল পাচ্ছে নাচোলবাসী। রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়নভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক সহ ছোট বড় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। এছাড়াও, উপজেলাভিত্তিক বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দাপ্তরিক প্রতিষ্ঠান যেমন উপজেলা পরিষদ, উপজেলা শিক্ষা অফিস, উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়, উপজেলা নির্বাচন অফিসারের কার্যালয়, উপজেলা কৃষি অফিসারের কার্যালয় ও কৃষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ডিজিটাল শিক্ষা ভবন সহ আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে নাচোল থানা অঞ্চলে।

এখানেই রয়েছে প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো তেঁতুল গাছ। নেজামপুর ইউনিয়নের শুড়লা গ্রামে এ তেঁতুল গাছটি আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাজকীয় এ গাছটি যেমন বিশাল ঠিক তেমনই অন্যান্য গাছের তুলনায় এর উচ্চতা অনেক বেশী। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সহ দেশের নানা প্রান্ত এই আশ্চর্য গাছটি দেখতে ভীর করেন অসংখ্য দর্শনার্থী। তাছাড়াও এ অঞ্চলে বিভিন্ন বয়সের বিনোদনপ্রেমী মানুষদের জন্য পার্ক ও খেলাধুলার জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত মাঠ ।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।