Raipur Thana

“সুপারী-নারিকেল-সয়াবিন-ইলিশে ভরপুর আমাদের রায়পুর।”

নীল আকাশের নিচে মাঠভরা সবুজবীথি, ঘন নারিকেল ও সুপারি গাছের সুবিশাল অরণ্য এবং নয়নাভিরাম মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর বুকে ভেসে চলা নৌকার অবারিত চলাচল.. যেন প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা এক অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি লক্ষ্মীপুরের রায়পুর।

রায়পুর নামকরণে রয়েছে এক প্রাচীন ইতিহাস। জানা যায় ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদারী প্রথায় এ অঞ্চল শাসন করেছিলেন প্রভাবশালী জমিদার রায়বাহাদুর মোহন রায়। তারই নামানুসারে অঞ্চলটির নাম রায়পুর হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়।

বর্তমানে, চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত লক্ষ্মীপুর জেলার একটি বিশেষ থানা অঞ্চল রায়পুর। ১৮৭৭ সালে রায়পুর থানা প্রতিষ্ঠা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৮৩ সালে ১ টি পৌরসভা ও ১০ টি ইউনিয়ন নিয়ে রায়পুর থানা আনুষ্ঠানিকভাবে একটি উপজেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে সম্পূর্ণ এলাকাটি রায়পুর থানার আওতাধীন রয়েছে।

 

 

ঢাকা থেকে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ও লক্ষীপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ২১ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নদী ও দিগন্ত-বিস্তৃত মাঠের সংমিশ্রণে গড়ে উঠা একটি প্রাচীন জনপদ রায়পুর। রায়পুর থানা অঞ্চলের আয়তন প্রায় ১৯৫.৯৮ বর্গকিলোমিটার ও জনসংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ১৫ হাজার। এই জনবহুল অঞ্চলের ১০ টি ইউনিয়ন হলো- উত্তর চর আবাবিল, উত্তর চর বংশী, চর মোহনা, সোনাপুর, চর পাতা, কেরোয়া, বামনী, দক্ষিণ চর বংশী, দক্ষিণ চর আবাবিল ও রায়পুর।

১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে রায়পুরের এক বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রায়পুর আলীয়া মাদ্রাসা ও রায়পুর এলএম উচ্চ বিদ্যালয়ে ছিল রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্প। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল রায়পুরের সাধারণ মানুষ। পরে এই অঞ্চলকে পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত করতে রায়পুরের মুক্তিযোদ্ধারা বীরদর্পে এগিয়ে আসেন। কাফিলাতলী ও কাজির দিঘীর পাড়ে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই সংঘটিত হয়। রায়পুর এলএম উচ্চ বিদ্যালয়ে পাকিস্তানিদের ঘাটিতে আক্রমণ ছিল এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনা। রায়পুরবাসী আজও শহিদদের ইতিহাস ভুলে যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে অম্লান রাখতে রায়পুরের উপজেলা পরিষদের মিলনায়তনে নির্মিত হয়েছে ১ টি স্মৃতিস্তম্ভ; সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন।

স্বাধীনতার এতো বছর পর রায়পুর এখন বেশ স্বনির্ভর জনপদ। এ অঞ্চলের অর্থনীতি অনেকাংশেই কৃষি নির্ভর। এ অঞ্চলের মেঘনা তীরবর্তী ইউনিয়নগুলোতে সুবিশাল মাঠজুড়ে ধানের প্রচুর ফলন হয়। এছাড়াও, এখানে সয়াবিন, পান, গম, পাট, সরিষা ও ভুট্টার মতো অর্থকরী ফসলের চাষও হয়ে থাকে। তাছাড়া, রায়পুরের অধিকাংশ জায়গা সমতল ভূমি হওয়ায় নারিকেল, সুপারি, আম ও কাঁঠাল গাছে ভরপুর থাকে অধিকাংশ গৃহস্থালির উঠান। গৃহপালিত পশু ও হাঁসমুরগির খামার পরিচালনা করেও রায়পুরের জনসাধারণ জীবিকা নির্বাহ করেন। এছাড়াও, এ অঞ্চলে কুটিরশিল্পের ব্যাপক সুনাম রয়েছে। স্থানীয় সহজলভ্য কাঁচামাল দিয়ে দক্ষ হাতের শৈল্পিক ছোঁয়ায় বাঁশ ও বেতের কাজ করে জনপদটির অনেক মানুষের মুখে হাসি ফুটছে।

তাছাড়া, রায়পুরে বেশ কিছু পরিবারে প্রবাসী স্বজনদের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। সারাদেশের ন্যায় রায়পুরের প্রবাসীরাও বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি সচল রাখছেন।  তবে এ অঞ্চলের মানুষের নদীর সঙ্গে নিবিড় সখ্যতা গড়ে ওঠার কারণে অনেকেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। মেঘনা নদীর সন্নিকটে রায়পুরের প্রায় ৬ টি ইউনিয়নজুড়ে অনেক জেলে বসবাস করেন। তাদের প্রায় ৬০ শতাংশ সার্বক্ষণিকভাবে এবং প্রায় ৪০ শতাংশ খণ্ডকালীন সময়ে ইলিশ আহরণ করাসহ এ থানা অঞ্চলের জেলেরা প্রতিবছর আনুমানিক প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ইলিশের উৎপাদন করে থাকেন। রায়পুরের মৎস্য উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য সারাদেশের মাছ চাষকে ক্রমবর্ধমান উন্নতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মাছচাষের সাফল্যকে আরো এগিয়ে নিতে রায়পুরে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্য প্রজনন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও, মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান আইন বাস্তবায়নে অত্যন্ত চৌকস ভূমিকা পালন করছে রায়পুর থানা পুলিশ। মা ইলিশ রক্ষা এবং জাটকা বাজারজাত রোধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এবং আইন অমান্যকারীদের আইনের আওতায় আনাসহ ইলিশ সংরক্ষণের সময়ে কোনো মাছ ধরা নৌযান যাতে নদী বা সাগরে যেতে না পারে; সেজন্য নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ কর্মসূচী পরিচালনা করে থাকেন রায়পুর থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ ইয়াছিন ফারুক মজুমদার।

রায়পুর থানা অঞ্চলের উত্তর চর আবাবিল, উত্তর চরবংশী ও দক্ষিণ চরবংশী ৩ টি ইউনিয়ন মেঘনা নদী বিধৌত এলাকা। তবে, প্রতিবছর বর্ষাকালে ঝড়-জলোচ্ছাসে প্রমত্তা মেঘনা নদী রুদ্ররূপ ধারণ করায় নদী সংলগ্ন ইউনিয়নগুলোর অসংখ্য স্থাপনা ও ফসলী জমি বিলীন হয়ে প্রায়ই বদলে যায় রায়পুরের মানচিত্র। ফলে, নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত জেলে ও কৃষক এখানে স্থায়ী ও অস্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ করে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করে থাকেন। স্থানীয় জনসাধারণের নদীভাঙ্গন জনিত ক্ষয়ক্ষতি কমানো গেলে রায়পুরের মতো উন্নয়নশীল অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধি পূর্ণাঙ্গতা পাবে বলে আশা করা যায়৷

রায়পুর থানা অঞ্চলে ঢাকা-লক্ষ্মীপুর এবং চট্টগ্রাম-লক্ষ্মীপুর দুটি মহাসড়ক থাকায় বিভাগীয় শহর ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা সহজ হয়েছে। আর রাজধানী ঢাকার সঙ্গে নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগের সুব্যবস্থার কারণে এ থানা অঞ্চলে বাণিজ্যিক পরিবেশ সমৃদ্ধি পাচ্ছে।তবে, এ অঞ্চলের ইউনিয়নগুলোর অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো ভালো হলে চিকিৎসা সেবার মানে যোগ হবে নতুন মাত্রা। জনগনের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে এ অঞ্চলে ১ টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ২ টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ৭ টি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র ও ৬ টি ক্লিনিক রয়েছে। তাছাড়া, গবাদিপশু সহ যেকোনো প্রানীর স্বাস্থ্যসেবায় রয়েছে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল। এছাড়াও, উপজেলা ভিত্তিক নানা দাপ্তরিক প্রতিষ্ঠান যেমন, সহকারী পুলিশ সুপারের কার্যালয়, নির্বাহী অফিসার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট এর কার্যালয়, উপজেলা নির্বাচন অফিসারের কার্যালয় ও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনসহ বহু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে রায়পুর থানা অঞ্চলে।

শিক্ষার দিক দিয়ে লক্ষ্মীপুরের অন্যান্য উপজেলাগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে রায়পুর। এ অঞ্চলে শিক্ষার হার প্রায় ৫১ দশমিক ১ শতাংশ। রায়পুর সরকারি কলেজসহ এ অঞ্চলে রয়েছে সর্বমোট ৬ টি কলেজ, ১২১ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২১ টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩২ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ২২ টি মাদ্রাসা।

প্রবাহমান কাল থেকে এ জনপদের মুখ উজ্জ্বল করেছেন বহু জ্ঞানী-গুণী। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও নাট্যকার শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী এ এলাকার কৃতী সন্তান। স্বাধীনতা সংগ্রামকালীন অন্যতম একজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ আ স ম আব্দুর রব চৌধুরীও বর্তমান রায়পুরের সন্তান। শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন এবং ইতিহাসবিদ মফিজুল্যাহ কবিরের মতো দেশবরেণ্য ব্যক্তিদেরও জন্মস্থান এ অঞ্চল। এছাড়াও, দিলারা জামান, রামেন্দু মজুমদার ও ফেরদৌসী মজুমদারের মতো বিখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরাও এ অঞ্চলে জন্ম নিয়েছেন। তা-ই এতোযুগ ধরে জ্ঞানীগুণীদের পদচারণা রায়পুর অঞ্চলের জনসাধারণকে আরো জ্ঞান ও প্রজ্ঞা নির্ভর জীবন গঠনে অনুপ্রাণিত করছে।

লক্ষ্মীপুর একসময় হিন্দু অধ্যুষিত হলেও বর্তমানে এ জেলার রায়পুর একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপদ। প্রায় ২শ’ বছর পূর্বে মেঘনা ও খরস্রোতা ডাকাতিয়া নদীর মোহনা রায়পুর ছিল একটি জনমানবহীন চরাঞ্চল। তখন এ অঞ্চলে আগমন ঘটে দেশবিদেশের মহান কিছু ধর্মসাধকের। কথিত আছে, রায়পুর এলাকাকে ঘিরেই বৃহত্তর নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটেছে। বর্তমানে ধর্মীয় উপাসনার জন্য এ অঞ্চলে ৫৫০টি মসজিদ, ২০ টি মন্দির ও ৭ টি এতিমখানা রয়েছে। তন্মধ্যে রায়পুর বড়ো মসজিদ ও মনু মিয়া বাড়ি জামে মসজিদের নান্দনিক স্থাপত্যকীর্তি মুগ্ধ করে। তন্মধ্যে রায়পুর পৌর এলাকায় অবস্থিত ‘জ্বীনের মসজিদ’ বা ‘মসজিদ-ই-আব্দুল্লাহ’ ১৬৮৮ সালে দিল্লী শাহী মসজিদের নির্মাণ শৈলী ও শৈল্পিক অবয়বের আদলে নির্মিত হয়েছে।

 

 

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।