Ramganj Thana

হলুদ চাদরে মোড়া ফসলি মাঠ ও উঁচুনিচু সবুজ গাছের সারি দিয়ে ঘেরা অপরূপ রূপবৈচিত্রের আঁধার লক্ষ্মীপুর জেলার একটি বিশেষ থানা অঞ্চল রামগঞ্জ। নারিকেল ও সুপারি গাছের আধিক্য এবং তাল-তমালের সমারোহ এ জনপদের সৌন্দর্যে যোগ করেছে এক অনন্য মাত্রা।

রামগঞ্জের প্রাচীন ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, তমাল গাছের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হিন্দু পুরাণের অবতার শ্রীকৃষ্ণের কথা। রামগঞ্জ এলাকাটি একসময় হিন্দু অধ্যুষিত ছিল। ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দশকের গোড়ার দিকে প্রাচীন ভুলুয়া রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বস্বর শুর মুর্শিদাবাদ থেকে চট্টগ্রামে নৌকায় চড়ে চন্দ্রনাথ তীর্থ দর্শনে যাবার পথে এ অঞ্চলে আসেন। তখন এ অঞ্চলে নতুন চর জেগে উঠেছিল। ঐসময় বর্তমান রায়পুর ও রামগঞ্জের উত্তরের কিছু এলাকা প্রাচীন ত্রিপুরা জেলার সাথে সংযুক্ত ছিল। তখন এই এলাকায় বসবাসরত একজন প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা ছিলেন রাম। ইতিহাস লেখক ও স্থানীয় প্রবীণ নাগরিকদের মতে, তাঁর নামানুসারে অঞ্চলটির নামকরণ করা হয়েছে ‘রামগঞ্জ’।

 

 

ঢাকা থেকে প্রায় ১১০ কিলোমিটার এবং লক্ষ্মীপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত রামগঞ্জ উপজেলাটি আয়তনের দিক থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার সর্বকনিষ্ঠ উপজেলা। মাত্র ১৬৯.৩১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রামগঞ্জ থানা অঞ্চলে প্রায় ৩ লাখ ৪২ হাজার ২৭ জন বর্তমানে বাস করেন।

অঞ্চলটি ১৮৯১ সালে রামগঞ্জ থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এটি নোয়াখালী উপজেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে ১৯৮৩ সালের ২৪শে জুলাই প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণকালে এই থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। রামগঞ্জ উপজেলা মোট ১ টি পৌরসভা ও ১০ টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এবং, সম্পূর্ণ উপজেলা অঞ্চলটি রামগঞ্জ থানার আওতাধীন। ইউনিয়নগুলো হলো: কাঞ্চনপুর, নোয়াগাঁও, ভাদুর, ইছাপুর, চণ্ডিপুর, লামচর, দরবেশপুর, করপাড়া, ভোলাকোট ও ভাটরা ইউনিয়ন। রামগঞ্জ থানা অঞ্চলের পূর্ব দিকে চাঁদপুর জেলার শাহারাস্তি ও নোয়াখালী জেলার চাটখিল, পশ্চিমে চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ, উত্তরে চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর এবং দক্ষিণে লক্ষ্মীপুর জেলা সদর অবস্থিত।

রামগঞ্জের রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী এ অঞ্চলে ব্যাপক গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চালিয়েছিল। হানাদারদের ঠেকাতে মুক্তিযোদ্ধারা নানা অভিযান পরিচালনা করেন। পরে এ এলাকার ফতেহপুর দিঘীর পাড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে হানাদারদের এক সংঘর্ষে বহুসংখ্যক পাকসেনা নিহত হয়। পরবর্তীতে ক্রোধের মুখে পাকবাহিনী ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে আটক করে রামগঞ্জ ক্যাম্পে এনে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রামগঞ্জ গোডাউন এলাকা, রামগঞ্জ হাইস্কুল ও ডাক বাংলো ছিল পাকবাহিনী ও রাজাকারদের আতুড়ঘর। সে সময় রামগঞ্জের সাধারণ মানুষ দেশ রক্ষায় দলে দলে একত্র হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দীর্ঘ সময় ধরে চলমান এ যুদ্ধে রামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে অঞ্চলকে হানাদার মুক্ত করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আজীবন স্মরণ রাখতে রামগঞ্জ এম ইউ উচ্চ বিদ্যালয় এবং হাজিরহাট কলাকোপা মাদ্রাসা সংলগ্ন স্থানে রয়েছে একটি বধ্যভূমি ও ৩ টি গণকবর।

এছাড়াও রামগঞ্জ থানা অঞ্চলের রয়েছে এক স্বরনীয় ইতিহাস। দেশভাগের আগে ১৯৪৬ সালের ১০ অক্টোবর রামগঞ্জে ভয়াবহ এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হলে শান্তি ও অহিংসার পরম বাণী নিয়ে দিল্লী থেকে এ এলাকায় ছুটে এসেছিলেন বর্তমান ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী। সেসব ইতিহাসের স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছে রামগঞ্জের জনসাধারণ।

সবুজের সমারোহে জড়ানো রামগঞ্জ অঞ্চলের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি। এ জনপদের প্রধান কৃষি ফসল ধান, গম, আলু, ডাল ও পাট। রামগঞ্জ নিয়ে কথিত আছে, নারিকেল সুপারি আর লেবুর সমাহার, রামগঞ্জের অহংকার। অর্থাৎ, প্রচুর পরিমাণে লেবু, নারিকেল ও সুপারির উৎপাদন হয় এই অঞ্চলে। গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নে নারিকেল আর সুপারির চাষ জীবনযাত্রার মানে যেমন গতি এনেছে ঠিক তেমনি কর্মসংস্থানসহ জীবিকা নির্বাহে ভূমিকা রাখছে। রামগঞ্জের প্রায় প্রতিটি বাড়ির বাগানে সারি সারি গাছ ছাড়াও আঙ্গিনা কিংবা বসতঘরের আশেপাশে দেশীয় জাতের নারিকেল, লেবু ও সুপাড়ি গাছ দেখা যায়। তাছাড়া, হেমন্তে রামগঞ্জের ফসলি জমিগুলো দেখলে মনে হয় কেউ যেন হলুদ চাদর বিছিয়ে রেখেছে। কৃষি নির্ভর এই অঞ্চলে কোনো শিল্পকারখানা না থাকায় এখানকার বেশিরভাগ মানুষ জমির ফসল ও বাড়ির আশেপাশে উৎপাদিত অর্থকরী ফসলের ওপর নির্ভরশীল।

এছাড়াও, এ অঞ্চলে তেমন কোনো নদ-নদী না থাকলেও স্থানীয় দিঘী, বিল ও পুকুরগুলোতে অনেকেই মৎস্যচাষ করে থাকেন। রামগঞ্জ অঞ্চলের হ্যাচারি শিল্পও ক্রমেই সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছে। তাছাড়া, গবাদিপশু পালন ও হাঁস-মুরগির খামার করে রামগঞ্জের অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছেন। শীতলপাটি বুনন, লোহার তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র, তাঁত, বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি পণ্য বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে এ অঞ্চলের মানুষ।

শিক্ষাখাতে বেশ এগিয়েছে রামগঞ্জবাসী। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ থানা অঞ্চলে শিক্ষার হার ৬৪ দশমিক ২ শতাংশ। রামগঞ্জ থানায় ৪ টি কলেজ, ৩২ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ১৬৩ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়াও এখানে স্বনামধন্য রাব্বানিয়া কামিল মাদ্রাসাসহ ছোটো-বড় ৩৭ টি মাদ্রাসা রয়েছে। এছাড়া ধর্মীয় উপাসনার জন্য রয়েছে সোনাপুর বড় মসজিদ, কাঞ্চনপুর দরগা মসজিদ, চণ্ডীপুর মনষা কালী মন্দির, সোনাপুর কালী মন্দিরসহ ৪৩২ টি মসজিদ, ৪৩ টি মন্দির ও ৯ টি মঠ।

রামগঞ্জ উপজেলা অনেক কৃতী সন্তানদের জন্মভূমি। রামগঞ্জেই জন্মগ্রহণ করেন প্রয়াত বরেণ্য অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান, মাহফুজ আহমেদের মতো প্রখ্যাত অভিনেতারা। এছাড়াও, দেশের প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী নারী নিশাত এ অঞ্চলেরই সন্তান।

রামগঞ্জ অঞ্চলের যোগাযোগ খাত ধীরে ধীরে সমৃদ্ধির দিকে এগোচ্ছে। লক্ষ্মীপুর সদরের সাথে রামগঞ্জ উপজেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা হতে যাত্রা শুরু করে এশিয়ান হাইওয়ে অতিক্রম করে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার মধ্যে দিয়ে সহজেই রামগঞ্জ উপজেলায় পৌছানো যায়। অর্থাৎ, যাতায়াতের ক্ষেত্রে বেশ উন্নতির ছোঁয়া পাচ্ছে রামগঞ্জবাসী। এছাড়াও প্রায় ৩৭৪ কিলোমিটার পাকারাস্তা এ অঞ্চলে জনসাধারণের চলাচলের পথকে সুগম করেছে। এছাড়া রামগঞ্জ অঞ্চলে উল্লেখ্যযোগ্য তেমন কোনো নদ-নদী না থাকলেও মেঘনা নদীর শাখা নদী ফ্রিদারের অল্প কিছু অংশবিশেষ ছাড়াও আশেপাশের বিভিন্ন খাল-বিলসহ প্রায় ১১২ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে নৌপথও রয়েছে। যোগাযোগ খাতের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নে ধীরে ধীরে রামগঞ্জে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া সহজ হয়েছে। তাছাড়া, সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণের হয়েছে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এছাড়াও রয়েছে প্রায় ১০ টি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। এমনকি, পশু-পাখিদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে রামগঞ্জে নির্মিত হয়েছে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল। তাছাড়া জনসেবা নিশ্চিতে সড়ক বিভাগ কার্যালয়, সড়ক উপ-বিভাগ কার্যালয়, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন, পৌরসভা কার্যালয়সহ বিভিন্ন আর্থিক সেবাদান প্রতিষ্ঠান রয়েছে রামগঞ্জ থানা অঞ্চলে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।