Ramgati Thana

মেঘনা নদীর অববাহিকা আর বঙ্গোপসাগরের মিলনস্থলে গড়ে উঠা একটি প্রাচীন জনপদের নাম রামগতি। রামগতি অঞ্চলের নামকরনে রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস। প্রবীণদের মুখ থেকে জানা যায়, এ অঞ্চলটিতে এক সময় রামকৃষ্ণ নামক ব্যক্তি ব্যবসা করতেন। সেই রামকৃষ্ণের আড়ত বা গদির পরিপ্রেক্ষিতে এ এলাকা রামের গদি নামে প্রচলিত হতে থাকে। পরবর্তীতে কালের বিবর্তনে এ জনপদটি রামগদি অতপর রামগতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

আবার, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সানা উল্লাহ চৌধুরী তার ত্রিদ্বীপের কাহিনী প্রবন্ধে রামগতির নামকরনের প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, ত্রিপুরার সামন্তরাজা “রাম” তার দলবল নিয়ে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দেয়ার সময় দিক ভূলে দিশেহারা হয়ে যান। পরবর্তীতে, যে জায়গায় নাবিকেরা গতি ফিরে পায় সে জায়গাটির নাম ছিলো পানিচর। সেই রাম রাজার গতি ফিরে পাওয়ার কারনে পানিচরের নাম পরিবর্তন করে রামগতি রাখা হয়।

রামগতি থানাটি ১৮৬২ সালে বড়খেরী ইউনিয়নে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করলেও, নদীভাঙ্গনের ফলে ১৯৮২ সালে বর্তমান জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৮৩ সালে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরনের লক্ষে একে উপজেলায় উন্নীত করা হয়।

 

 

ঢাকা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার এবং লক্ষ্মীপুর জেলা সদর হতে ৪২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত একটি প্রশাসনিক অঞ্চল রামগতি। এ থানা অঞ্চলের মোট আয়তন প্রায় ৩৪৭ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ ৮০ হাজার। রামগতি থানা অঞ্চলের পূর্ব দিকে নোয়াখালী সদর এবং সুবর্ণচর উপজেলা, পশ্চিমে দৌলতখাঁ, ভোলা এবং মেঘনা নদী এবং উত্তরে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর এবং দক্ষিনাংশে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা অবস্থিত। নোয়াখালীর কাছাকাছি এলাকা হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষ নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায়ই কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। রামগতি উপজেলাটি একটি পৌরসভা, ৮ টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত। ইউনিয়নসমূহ হলোঃ চর বাদাম, চর পোড়াগাছা, চড় আলেকজান্ডার, চর আবদুল্লাহ, চর আলগী, চর রমিজ, বড়খেরী এবং চর গাজী। এবং সম্পূর্ণ উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম রামগতি থানার আওতাধীন।

৭১ এর রণাঙ্গনে রামগতির রয়েছে গৌরবান্বিত ইতিহাস। সেসময় এপ্রিলের শেষদিকে লক্ষ্মীপুর অঞ্চলে প্রবেশ করে পাক হানাদার বাহিনী। তবে তাদের আতংকের বিষয় ছিলো মুক্তিযুদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ। তখন জমিদার হাটের বাকে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ লড়াইয়ে কয়েকজন রাজাকার সহ মোট ১৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। এছাড়াও রামগতি সড়কে চর কলাকোপার দক্ষিণে, আলেকজান্ডার এবং রামগতি থানা ও ওয়াপদা বিল্ডিং এলাকাসহ নানা জায়গায় অনেক ছোট বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আগ্রাসী আক্রমণের মুখে চারই ডিসেম্বর রামগতি অঞ্চলসহ পুরো লক্ষ্মীপুর জেলা হানাদার ও রাজাকার মুক্ত হয়। মুক্তিকামী জনতা উল্লাসে মেতে ওঠে। পরের দিন তথা ৭১ এর ৫ ডিসেম্বর এক নতুন সূর্য উদিত হয় রামগতির আকাশে।

স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরে এ অঞ্চলে আঘাত হানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রানঘাতী ঝড় “সাইক্লোন ভোলা”। ভোলা সাইক্লোনের তাণ্ডবে মেঘনা উপকূলীয় রামগতি ও কমলনগর এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। ৮ থেকে ১০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায় মেঘনা ও ভুলুয়া নদীর উপকূলীয় চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা। স্রোতে ভেসে যায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ অসংখ্য মানুষ। মানব-ইতিহাসের বিশ্বের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড়টির স্মৃতি আজও বয়ে বেড়ান এ অঞ্চলের বেঁচে যাওয়া প্রবীণেরা।

বর্তমানে ক্রমশ সমৃদ্ধির পথে এগোচ্ছে রামগতিবাসী। নতুন উদ্যোমে এগোচ্ছে অর্থনীতির চাকা। এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের আয়ের উৎস কৃষি। প্রায় ৬৬ ভাগ মানুষ কৃষিকাজের সাথে সম্পৃক্ত। রামগতির বিস্তীর্ণ ফসলী মাঠে আবাদ হয় ধান। সয়াবিন, নারিকেল ও সুপারি চাষের জন্য বিখ্যাত এ অঞ্চল। সর্বপ্রথম ১৯৮২ সালে রামগতি উপজেলায় মাত্র ১ হেক্টর জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে সয়াবিনের চাষ করা হয়। তারপর হতেই সয়াবিন উৎপাদনে রামগতি দেশের উল্লেখযোগ্য চাহিদা পূরন করে আসছে। এছাড়াও কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত নানা শাকসবজি, মরিচ, পেঁয়াজ সহ বিভিন্ন ফল ফলাদি স্থানীয় বাজার সহ জেলা শহরে বাজারজাত করে থাকে। তাছাড়া, ব্যবসা, চাকরি, রেমিটেন্স সহ নানা খাতে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে রামগতিবাসী।

বর্তমানে শিক্ষাখাতে সাফল্যের ছোঁয়া পেতে যাচ্ছে রামগতিবাসী। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ অঞ্চলের শিক্ষার হার ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ। রয়েছে মোট ৪ টি কলেজ, ২৭টি মাধ্যমিক বিদ্য্যালয় সহ, প্রায় ১৪৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৪৬টি মাদ্রাসা। এছাড়াও যোগাযোগখাতেও ক্রমান্বয়ে উন্নতি সাধিত হচ্ছে। নির্মিত হয়েছে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৫২ কিলোমিটার আধাপাকা রাস্তা, ৩০১ কিলোমিটার কাঁচারাস্তা এবং ২৪ কিলোমিটার নৌপথ।

স্বাস্থ্যখাতেও এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। যাতায়াতের সুব্যবস্থা থাকায়, এলাকাবাসী সহজেই নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা গ্রহন করতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল সহ ইউনিয়নভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক।

এছাড়াও এখানে উপজেলা ভিত্তিক বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পরিদপ্তর রয়েছে। উপজেলা পরিষদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, উপজেলা নির্বাচন অফিস, ভূমি অফিস, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন সহ বিভিন্ন আর্থিক সেবাদান প্রতিষ্ঠান রয়েছে রামগতি থানা অঞ্চলে।

অসাম্প্রদায়িক এ অঞ্চলটি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সম্মিলিত বসবাস। তবে এটি একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। এখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক যুগে চোখ ধাঁধানো স্থাপত্যের জটিল সংমিশ্রণ আর দৃষ্টিনন্দন এক অনন্য স্থাপনা আস-সালাম জামে মসজিদ ও ঈদগাহ সোসাইটি। এ মসজিদটি বাংলাদেশের স্থাপত্য শিল্পের এক বিরল নিদর্শন। জানা যায়,  প্রায় ১০ হাজার ৮শ বর্গফুটের দোতলা এ মসজিদটিতে নেই কোনো জানালা। শুধুমাত্র মুসুল্লিদের প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য দুটি দরজা রয়েছে। তবুও, প্রাকৃতিক আলোয় সর্বদা উজ্জ্বল হয়ে থাকে মসজিদটির ভিতরের পরিবেশ। রামগতি থানা অঞ্চলে রয়েছে আস-সালাম জামে মসজিদ সহ মোট ১০৫টি মসজিদ ১০টি মন্দির এবং ১টি মঠ।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।