Sitakunda - Positive Think

একাধারে পাহাড় ও প্রকৃতির সুন্দরতম গিরিপথ অন্যদিকে উপকূলীয় বনাঞ্চল এবং বিস্তীর্ণ সমুদ্রসৈকত; যেন প্রকৃতির এক অপরূপ মেলবন্ধন এই সীতাকুন্ড।

সীতাকুন্ডের নামকরনে রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ও ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, এক কালে এখানে মহামুনি ভার্‌গব বসবাস করতেন। অযোদ্ধার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্র তার বনবাস কাটিয়েছিলে এ অঞ্চলে। রামচন্দ্র আসবেন জেনে সেই মহামুনি রামচন্দ্র ও তার স্ত্রী সীতার স্নানের জন্য তিনটি কুন্ড সৃষ্টি করেন। মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুসারীরা মনে করেন, রামায়ণে বর্ণিত সীতা এই এলাকায় আগমন করেন এবং কুন্ডে স্নান করেন। সেকারনেই এ এলাকার নাম বিবৃত হয়ে সীতাকুন্ড হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

 

 

ঐতিহাসিক ভাবেও সীতাকুন্ডের গুরুত্ব অপরিসীম। জানা যায়, ৬ষ্ট ও ৭ম শতাব্দীতে সম্পূর্ণ চট্রগ্রাম অঞ্চল আরাকান রাজ্যের অধীনে ছিলো। পরবর্তীতে এ অঞ্চলটি সুলতানী শাসনে অধিগৃহীত হলেও শের শাহ্‌ সুরি, বাংলার শেষ সুলতান গিয়াস উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ্‌ কে পরাজিত করে আবার এ এলাকাকে আরাকান রাজ্যে অধিষ্টিত করে। তবে, পর্তুগীজরা এসে আরাকানীদের শাসন কার্যে ভাগ বসালে ১৫৩৮ হতে ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চল পর্তুগীজ ও আরাকানী বংশধররা একসাথে শাসন করে। অতঃপর, সে সময় মুঘল সেনাপতি উম্মেদ খান আরাকানী ও পর্তুগীজদের উচ্ছেদ করে এ অঞ্চল দখল করে নেন। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দোল্লা পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হলে এ এলাকাটি ইংরেজদের দখলে যায়। পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এ অঞ্চল স্বদেশীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে।

ঢাকা থেকে প্রায় ২১৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং চট্রগ্রাম জেলা শহরের অদূরে মাত্র ৯ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল সীতাকুন্ড। সীতাকুন্ড উপজেলা একটি পৌরসভা এবং ৯ টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। ইউনিয়নগুলো হলো: সৈয়দপুর, বারৈয়াঢালা, মুরাদপুর, বাড়বকুন্ড, বাশবাড়িয়া, কুমিরা, সোনাইছড়ি, ভাটিয়ারী এবং সলিমপুর। তন্মধ্যে সলিমপুর ইউনিয়নের উত্তরাংশ সীতাকুণ্ড মডেল থানার অধীনে এবং দক্ষিণভাগের অংশবিশেষ চট্রগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আকবর শাহ্‌ থানার আওতাধীন রয়েছে।

সীতাকুন্ড থানা অঞ্চলের পূর্ব দিকে সবুজে ঘেরা পাহাড়ী এলাকা এবং ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী উপজেলা, পশ্চিমে সন্দ্বীপ চ্যানেল এবং বঙ্গোপসাগর সহ উপকূলীয় বনাঞ্চল, উত্তরে মীরসরাই ও ফটিকছড়ী উপজেলা এবং দক্ষিণে চট্রগ্রাম জেলা শহর অবস্থিত।

৭১ এর রণাঙ্গনে সীতাকুন্ডের রয়েছে বর্বরোচিত ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধে সীতাকুন্ডবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহন করে। ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ডাকে সীতাকুন্ড থানা এলাকার দক্ষিণের ওভারব্রিজ থেকে কুমিরা এলাকা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতাকামী জনতা একত্রিত হয়ে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঘাটি গড়ে তোলেন। হানাদার বাহিনীর বিস্তৃতি ঠেকাতে নিরস্ত্র জনতা গাছের গুড়ি ও বাঁশ ফেলে মহাসড়ক, ব্রিজ কালভার্‌ট গুলোতে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। বিজয়ের প্রহর গুনতে থাকা মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর উপর সেসময় হামলা চালায় পাক বাহিনী। ১২ ডিসেম্বর সীতাকুণ্ড উপজেলার ছোট দারোগারহাট হতে কুমিরা পর্যন্ত সড়কের প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থান নেয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা। বিকেলে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকিস্তানিরা পিছু হটতে থাকে। ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতেই সীতাকুণ্ড সদর হানাদারমুক্ত হয় । তবে, সীতাকুন্ডের অন্যান্য অঞ্চলে ছোট-খাটো যুদ্ধ চলতে থাকে। ১৬ই ডিসেম্বর পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের খবর পেয়ে বিজয় উল্লাস করতে থাকলে অপ্রস্তুত অবস্থায় ভারতীয় সেনা ও মুক্তিবাহিনীদের উপর কাপুরুষোচিত হামলা চালায় পাক হানাদারেরা। ফলে সীতাকুন্ডে আবার যুদ্ধ শুরু হয় এবং ঘুরে দাঁড়ায় মিত্রবাহিনী। রাত পর্যন্ত চলা এ যুদ্ধে ক্রমশ পিছু হটতে শুরু করে পাকিস্তানী হানাদাররা। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এ যুদ্ধে প্রান হারান শতাধিক ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধারা। ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশে বিজয় উদজাপিত হলেও সীতাকুন্ড সম্পূর্ণ  শত্রুমুক্ত হয় ১৯৭১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর। মুক্তিযুদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর এ আত্মত্যাগ আজীবন স্মরণ রাখতে নির্মিত হয়েছে মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র সহ কয়েকটি স্মৃতিস্তম্ভ ও বধ্যভূমি।

স্বাধীনতার পর বর্তমানে এ অঞ্চলের যোগাযোগ খাতে এসেছে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। চট্রগ্রাম সমুদ্রবন্দরের প্রবেশদ্বার সীতাকুন্ড দিয়েই বয়ে গেছে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক এবং ঢাকা-চট্রগ্রাম রেলপথ। এ থানা অঞ্চলে মোট ১১২ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ২৫৬ কিলোমিটার কাঁচারাস্তা সহ ৩৭ কিলোমিটার রেলপথ এবং ৬ টি রেলস্টেশন রয়েছে।

এ জনগোষ্ঠির প্রধান আয়ের উৎস কৃষি। কৃষকেরা আবাদী জমিতে ধান, ডাল, আলু, বেগুনসহ বিভিন্ন মশলা ও শাকসবজির চাষ করে থাকেন। এছাড়াও আখ, আনারস, তরমুজসহ বিভিন্ন ফলফলাদির চাষ হয় এ অঞ্চলে। কৃষিকাজ ছাড়াও এ অঞ্চলের মানুষ মৎস্যচাষ, হাঁস মুরগীর খামার ও গবাদীপশু পালন করে স্বাবলম্বী হচ্ছে।

শিক্ষাখাতেও উন্নয়নের ছোঁয়া পাচ্ছে সীতাকুণ্ডবাসী। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ অঞ্চলের শিক্ষার হার ৫৯ দশমিক ২ শতাংশ। রয়েছে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, ৬ টি কলেজ, ১৫টি মাদ্রাসা, ৩০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৮২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২১টি কিন্ডারগার্টেন সহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাছাড়া স্বাস্থ্যখাতেও এসেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বেশ কয়েকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সহ প্রতিটি ইউনিয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে এ থানা অঞ্চলে। তাছাড়া, ওয়ার্ডভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে খুব সহজেই এলাকাবাসী তাদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করে যাচ্ছে ।

সীতাকুন্ড থানা অঞ্চল ক্রমান্বয়ে শিল্পোন্নত নগরী হয়ে উঠছে। বিশ্বের বৃহত্তম পুরাতন জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প তথা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে সীতাকুন্ডে। এই জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্ক্রাপ ব্যবসা, লৌহ- ইস্পাত ব্যবসা, রি-রোলিং মিল, ফার্নিচার, মেশিনারি তৈরির নানা প্রতিষ্ঠান। জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ সরাসরি সম্পৃক্ত এবং এ শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এতে, যেমন এ এলাকার প্রায় সকল শ্রেনীর মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনার দোয়ার খুলতে শুরু করেছে।

নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই সীতাকুণ্ড। এখানেই আছে পাহাড় ও সমুদ্রের এক অমায়িক মেলবন্ধন। একদিকে পাহাড় থেকে ঝড়ে পড়া ঝর্নার শীতল স্নিগ্ধতা, অন্যদিকে সমুদ্রের সূর্যস্নান; যেন এক অপরূপ সৃষ্টি দিয়ে সাজানো একটি জনপদ। সীতাকুন্ডের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ও পর্যটন কেন্দ্র গুলো দেখতে ভীর করেন দেশ বিদেশ থেকে আগত নানা পর্যটক। সীতাকুন্ডের সর্বোচ্চ পাহাড় চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চুড়ায় রয়েছে চন্দ্রনাথ মন্দির। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র তীর্থস্থান খ্যাত এই মন্দিরটিতে প্রতিবছর প্রায় ১০-১২ লাখ তীর্থযাত্রীর সমাগম হয়। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশেই রয়েছে প্রায় ২০০০ একর জুড়ে বিস্তৃত বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক। এছাড়াও সমুদ্রতীরে সবুজ গালিচার বিস্তীর্ণ ঘাসে সাজানো গুলিয়াখালী সি বিচের নান্দনিক রূপ দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসে ভ্রমণপিপাসুরা। তাছাড়া পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা সুপ্তধারা ও সহস্রধারা ঝর্নার কোমলতা স্পর্শ করতেও ভীর জমান পর্যটকেরা।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।