বাংলাদেশ একটি সবুজ-শ্যামল, অপার লীলাভূমির দেশ। এদেশের পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আসে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও নির্দশণ। সেই ঐতিহ্যকে লালন করে আছে ফরিদপুর জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে  বরশিয়া নদীর তীরে অবস্থিত  বোয়ালমারী। উপজেলাটিকে ঘিরে রয়েছে ফরিদপুর জেলার অন্যন্য উপজেলাগুলো। উত্তরে মধুখালী, দক্ষিণে আলফাডাঙ্গা, পূর্বে ফরিদপুর সদর ও নগরকান্দা উপজেলা অবস্থিত । এক সময় বোয়ালমারী উপজেলাটি প্রাচীন জনপদ ভূষণা থানার অন্তর্ভূক্ত  ছিলো । ১৮১২ সালের দিকে সৈয়দপুর থানার স্থানান্তর হলে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৮১৪ সালের দিকে বোয়ালমারী একটি পূণাঙ্গ থানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সেই সময় ১৯টি ইউনিয়ন নিয়ে বোয়ালমারী থানা গঠিত হলেও পরবর্তীতে বানা ও পাচুড়িয়া ইউনিয়ন দুটি আলফাডাঙ্গা থানার অন্তর্ভূক্ত হয় এবং ১৯৮৩ সালে বোয়ালমারী থানা অঞ্চলটি উপজেলায় পরিণত হয়।

 

 

প্রাচীন প্রশাসনিক অঞ্চল বোয়ালমারীর উৎপত্তি নিয়ে জনশ্রুতি পাওয়া যায়, একসময় উপজেলার বরশিয়া নদীতে প্রচুর পরিমাণে বোয়াল মাছ পাওয়া যেতো। কথিত আছে নদীতে বেশি বোয়ালমাছ থাকায় এলাকার সবাই জড়ো হয়ে বোয়াল মাছ ধরতো। যা বোয়াল মারা উ’সবে পরিনত ছিলো।‍ তখন থেকেই অঞ্চলটির নাম লোকমুখে বোয়ালমারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

বোয়ালমারী আয়তন ও জীবিকা :

২৭২.৩৪ বর্গকিলোমিটার আয়তন বেষ্ঠিত উপজেলাটির জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনলাখ। বর্তমানে ১টি পৌরসভা, ১১টি ইউনিয়ন, ১৭৭টি মৌজা ও ২৬২টি গ্রাম নিয়ে উপজেলাটির সকল দাপ্তরিক কার্যসমুহ পরিচালিত হচ্ছে।

বোয়ালমারী উপজেলার বুক চিরে বয়ে গেছে মধুমতী, বারাশিয়া ও চন্দনা নদী। এছাড়াও রয়েছে হাওড়, বাওড়সহ বিস্তৃত খাল-বিল। এ সকল নদী, হাওড়ে সারা বছর প্রচুর পরিমাণে দেশীয় মাছ ধরা পরে। তবে একটা সময়ে এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বোয়াল মাছ পাওয়া গেলেও কালের বিবর্তনে এখন আর নেই।  আছে রুই, কাতলা, ষোল, শিং, কই, টেংরা-পুটি, বা চিতল মাছ। এই সব মাছ শিকার করেই নদী ও হাওড়ের আশেপাশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।

বোয়ালমারী উপজেলাটিতে শতকরা প্রায় ৬০ থেকে ৭০ জন লোক কৃষির সাথে সম্পৃক্ত। উপজেলাটির প্রধান কৃষিজ ফসল হচেছ ধান, পাট, পেয়াজ  ও খেজুরের গুড়। এ ছাড়াও অনেকে বিভিন্ন ধরনের আগাম ফসল ও সবজি চাষ করে অধিক মুনাফা অর্জন করছেন। আবার কেউ বিভিন্ন ধরনের ঘাস চাষ করেও সফলতার দুয়ারে দাড়িয়েছে। পাকচং, জার্মান, ভুট্টা, নেপিয়ার জাতের ঘাস চাষ করে গবাদি পশুর খামারীরা প্রচুর লাভবান হচ্ছে।

এ উপজেলার মাটি দো’আশ ও উর্বর হওয়ায় প্রচুর পরিমাণে পাট উৎপন্ন হয়। আর এই সোনালী আশের যথাযোগ্য ব্যবহার নিশ্চিত করতে বোয়ালমারি উপজেলায় রয়েছে একটি জুট মিল।

উপজেলার সাতৈর ইউনিয়নে অবস্থিত দেশের সুনামধন্য রপ্তানীকারক শিল্প প্রতিষ্ঠান জনতা জুট মিলস লিমিটেড-টি বোয়ালমারী উপজেলার অন্যতম একটি শিল্প অর্থনীতি মাধ্যম। যা অঞ্চলের বেকারত্ব নিরেসনেও যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে।

তেমন কোন বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান না থাকলেও, ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পের প্রতিষ্ঠান বোয়ালমারীতে বহু আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

বরর্তমানে স্থানীয় কিছু তরুণরা বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পোল্ট্রি, ম‘স্য ও গবাদি পশুর খামার দিয়ে নিজেদের স্বভলম্ভী হিসেবে গড়ে তুলেছেন।

বোয়ালমারীর  ইতিহাস ঐতিহ্য :

বোয়ালমারী উপজেলা একটি মুসলিম প্রধান অঞ্চল। এখানে রয়েছে  ইসলামী ঐতিহ্যের অন্যতম নির্দশন। প্রায় সাতশত বছরের প্রাচীন সাতৈর শাহী জামে মসজিদটি বোয়ালমারী উপজেলার আওতাধীন। জানা যায়, ৭ শত বছর পূর্বে দিল্লির বাদশা আলাউদ্দীন হুসাইন শাহের আমলে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। যদিও বরর্তমানে মসজিদটির সেই ঐতিহাসিক রূপ আর দেখতে পাওয়া যায়না।

এছাড়াও উপজেলাটির কুমার নদের পাশে অবস্থিত হিন্দু ধর্মালম্বীদের হাজার বছরের পুরাতন ঐতিহাসিক অলৌকিক কীর্তিভরা কয়রা কালী মন্দির। জাগ্রত এই কালী মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে অনেক অলৌকিক কীর্তি, কাহিনী। কালী দেবীর আবির্ভাব ও ভক্তদের মনোবাসনা পূর্ণতার অসংখ্য লীলা লোক মুখে প্রচলিত আছে। এই মন্দিরটি হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম একটি পূন্য তীর্থ ভূমি। প্রতিবছর এখানে মাঘী পূর্ণিমা তীথিতে মেলা বসে। জানা যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এস ভক্তরা এখানে গঙ্গা স্নান করেন।

১৮২৮ সালে মুসলিম নব জাগরনের অগ্রদূত নবাব আব্দুল লতিফ ও বাংলার স্ব-স্বাসিত, মুঘল সাম্রাজ্যের একজন সামন্ত রাজা শীতারাম এর জন্ম ভীটা এই উপজেলাটিই।  যিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে একটি স্বল্পস্থায়ী হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ অঞ্চলে।

নানা কুসংস্কার, ধর্ম পরায়নতা আর রাজনৈতিক প্রপাকান্ড ঘেরা বোয়ালমারী উপজেলাটি শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত সব ধরনের মানুষের বসবাস স্থান। এখানকার মানুষ বেশ সংস্কৃতিমনা এবং অতিথি পরায়ন।

উপজেলার হাসামদিয়ায় রয়েছে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও নয়নাভিরাম দৃশ্য বেষ্টিত গাঁও-গেরাম ভিলেজ পার্ক।  সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পার্কটি বিভিন্ন দর্শনার্থীদের ভীড়ে ভরে ওঠে।

উপজেলাবাসীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় রয়েছে সড়ক ও রেলপথ। বর্তমানে ঢাকার সাথে উপজেলার রেল যোগাযোগ না থাকলেও আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থা মন্দ নয়। উপজেলাবাসী তাদের দৈনন্দিন বিভিন্ন বাজারজাতকরণ পণ্য এই রেলের মাধ্যমে জেলাশহর গুলোতে পরিবহন করে। সাতৈর, ঘোড়াখালী, বোয়ালমারী ও সহস্রাইল এই চারটি রেল স্টেশনই বোয়ালমারী উপজেলাধীন রয়েছে।

উল্লেখ্য, উপজেলার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও গত কয়েকে দশকে বেশ উন্নত চিত্রে পরিণত হয়েছে। উপজেলার পৌর বাসটার্মিনাল থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছেড়ে যায় কিছু আন্তনগর বাস। ফলে এ উপজেলায় আগমন বা উপজেলা থেকে বহিরাগণ করতে পরিবহণ সংক্রান্ত কোন ভোগান্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার শহরাঞ্চল ও বাজার অঞ্চলগুলো সবসময়ই নানা পেশার মানুষের ভীড়ে ব্যস্ত থাকে তবে গ্রীস্মকালে অধীক গরম আবহাওয়ার কারণে অঞ্চলের বাজার ও রাস্তাঘাট জনশূণ্য নগরে পরিণত হয়।

বোয়ালমারী উপজেলা পরিষদের উত্তরে মাত্র ৫০০ মিটার দুরত্বে অবস্থিত রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তার প্রায় ১.৬ কি.মি. দক্ষিণে বোয়ালমারী-আলফাডাঙ্গা সড়কের কোল ঘেষে স্থাপিত রয়েছে বোয়ালমালী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ষ্টোশন। উপজেলায় সংঘটিত দূর্ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের গতি ও ত্যাগের মহিমা সর্বদাই প্রশংসিত।

সবুজ গাছ আর ফসলের মাঠ জুড়ে উপজেলার পরতে পরতে গড়ে উঠেছে একেকটি ঘর ও দালান-বাড়ি। রয়েছে সরকারি বেসরকারি নানাবিধ প্রতিষ্ঠান। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গড়ে ওঠা একাধিক ব্যাংক-বীমা ও এনজিও সহ অঞ্চল জুড়েই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষার পাশাপাশি বেকার যুবকদের বিবিধ কর্ম প্রশিক্ষণের জন্যও রয়েছে একাধিক প্রশিক্ষণালয়।

উপজেলাবাসীর আবেগ-অনুভূতি ও বিভিন্ন তথ্য জানাতে এ অঞলে রয়েছে একাধীক আঞ্চলিক সংবাদ পত্র। দৈনিক নবচেতনা, বাঙ্গালী খবর সহ  সাপ্তাহিক বোয়ালমারী বার্তা, সাপ্তাহিক চন্দনা ও পাক্ষিক নজীর বাংলা, পত্রিকাগুলো বেশ সমাদৃত রয়েছে উপজেলা জুড়ে।

ফরিদপুর জেলাসদর থেকে দুরে ও চন্দনা, মধুমতি অববাহিকায় গড়ে উঠা এ উপজেলায় বাস করে প্রায় ৬০ হাজার পরিবার। তাদের দৈনন্দিন চাহিদা, পাওয়া না পাওয়া, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব এবং অন্যন্য নানা বিষয় নিয়ে প্রতিদিনই বিরাজ করে একেকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।

এসব ঘটনাকে দমিয়ে সামাজিক ভারসাম্য রোধে অঞ্চলবাসির সার্বিক নিরাপত্তা ও সেবায় ব্রত নিয়ে সর্বসময় দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন বোয়ালমারী থানার একদল তরুণ, চৌকস পুলিশ সদস্যসহ থানার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান অবিভাবক জানাব মুহাম্মদ আব্দুল ওহাব।

তিনি ২৪ মে ২০২২ বোয়ালমারী থানায় যোগদানের মাধ্যমে এলাকাবাসীর প্রতি নির্ভয়ে, নি:সঙ্কচে থানার সেবা নিতে সদয় আহবান করেন।

অফিসার ইনচার্জ জনাব আব্দুল ওহাব একজন বিচুক্ষণ ও প্রশিক্ষিত পুলিশ অফিসার। তিনি ২০১৭ সালে আইপিও হিসেবে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে সুদানের দারফুরে গমন করে ২০১৮ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা পদক লাভ করেন। অপরাধ ও সমাজের শৃংখলা রক্ষায় তার রয়েছে সুনিপুন অভিজ্ঞতা।

তিনি তার থানার নথীভূক্ত মামলার পরিসংখ্যান ও স্থানীয় মানুষের মধ্যকার অপরাধ প্রবণতা সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্য তুলে ধরেন চ্যানেল আই পজিটিভ থিংক এর ক্যামেরায়।

বোয়ালমারী থানা অঞ্চলকে অপরাধমুক্ত রাখতে অফিসার ইনচার্জ কিভাবে কাজ করে যাচ্ছেন সে সম্পর্কেও আলোচনা করেন জনাব আব্দুল ওহাব।

স্থানীয়দের সম্পর্কে থানার অফিসার ইনচার্জ এর এমন পজিটিভ ধারণা নি:সন্দেহে উপজেলাবাসির জন্য উজ্জল সম্ভাবনাই বলা যায়। তবে এই পরিবর্তনের মুলে প্রাধান্য পায় ঢাকা রেঞ্জের প্রতিটি থানা অঞ্চলে পুলিশ অফিসার কর্তৃক মসজিদ ভিত্তিক আলোচনা। যা স্থানীয় মুসল্লীদের মাঝে আইনের সঠিক ধারণার প্রতিফলন।

স্পষ্টভাষী এ পুলিশ অফিসার বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ একটি মানবপ্রেমি পেশার নাম। হয়তো সবাই সেই যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনা। তবে আমি আমৃত মানুষের কাছে থেকে তাদের সেবা করতে চাই।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।