চন্দনা – বারাশিয়া, গড়াই – মধুমতি ও পদ্মার বিধৌত পললে খর্জ্জুর,  তাল-তমাল, বনরাজির লীলা নিকেতন, ইতিহাসখ্যাত নীল বিদ্রোহের অগ্নিস্থল, স্বনির্ভর আন্দোলনের পাদপীঠ, ছায়া শ্যামল গ্রাম বাংলার রূপনিকেতন ভুমি আলফাডাঙ্গা থানা অঞ্চল। ঠিক কবে কখন আলফাডাঙ্গার নামকরন হয়েছিল তার সঠিক তথ্য জানা যায় না। তবে স্থানীয় মুরব্বীগণ বলেন মধুমতি নদীর কূলে ‘‘ আলফা’’ নামে এক ধরনের লতানো গাছে সুন্দর ফুল ডাংগায় ফুটতো; সেই আলফা ফুলের নামানুসারে আলফাডাঙ্গার নামকরন হয়। তবে এ কথারও মতবিরোধ রয়েছে অঞ্চলের কারো কারো কাছে। ১৯৬০ সালে আলফাডাঙ্গা থানা প্রতিষ্ঠিত হলে অঞ্চলটিকে ফরিদপুর জেলার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।
পূর্বে এ অঞ্চল ছিল নড়াইল মহাকুমার আওতাধীন। ১৯৮৩ সালের ২৪ মার্চ থানা অঞ্চলটি একটি মানউন্নিত থানায় রুপান্তরিত হয়ে উপজেলার স্বীকৃতি লাভ করে। এ সময় বোয়ালমারী উপজেলার বানা ও পাঁচুড়িয়া ইউনিয়ন দুটিকে আলফাডাঙ্গা উপজেলার সঙ্গে সংযুক্ত করে ০৬টি ইউনিয়ন নিয়ে যাত্রা শুরু করে বর্তমান আলফাডাঙ্গা থানা অঞ্চল।

অপরূপ ভূমি আলফাডাঙ্গা

প্রকৃতির অপরূপ নিদর্শণ, বাংলার নদী রাজ্যের অন্তভূমিতে বহমান, নিষ্ঠুর মধুমতির কবলে ১৩৬ বর্গ কি:মি: আয়তন বিশিষ্ট আলফাডাংগা  উপজেলা  ৮৪ টি মৌজা থেকে বর্তমানে ৬৪ টি মৌজায় এসে দাড়িয়েছে। গত কয়েক দশকে এই নদী ভাঙ্গনে অঞ্চলের বহু মানুষ ঘর-বাড়ি হারিয়ে পথে এসে দাড়িয়েছে। যেন তাদের পৈতৃক ভিটার অস্তিত্ব কোন কালেই ছিলো না। প্রকৃতির এই ভয়ংকর ছোবলে দিশে হারা মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন অনেকেই। আবার অনেকেই সর্বহারা হয়ে পাড়ি জমিয়েছেন দেশের অন্য কোন প্রান্তে।
উল্লেখ, উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের কাতলারসুর গ্রামে মুজিববর্ষে গড়ে তোলা হয়েছে ‘স্বপ্ননগর’ আশ্রয়ণ প্রকল্প। সেখানে ২৮৬ জনের কাছে জমিসহ ঘর হস্তান্তর করা হয়েছিলো ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর। মাত্র দুই বছরে এসব ঘরের বাসিন্দারা এখন পুনরায় নদী ভাঙনে ঘর হারানো আশঙ্কায় শঙ্কিত রয়েছে।
ফরিদপুর জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলফাডাঙ্গা উপজেলা মধুমতি এবং চন্দনা বারাশিয়া নদী বিধৌত অঞ্চল কৃষি ও মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ । শিক্ষা, সংস্কৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রনী ভূমিকা পালন করলেও নদী ভাংগন এবং দারিদ্রের কষাঘাতে স্থানীয় জনগণের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা প্রতিনিয়ত ব্যাহত হচ্ছে। জানা যায়, গত ৩ বছরে এই উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ৬০০ পরিবারের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে মধুমতির নদীগর্ভে। বর্তমানে প্রায় এক হাজার পরিবার ভাঙ্গনের হুমকির মুখে রয়েছে।
গোপালপুর ইউনিয়নের ছাতিয়াগাতি, দিগনগর, খোলাবাড়িয়া, কাতলাসুর ও পগনবেগ এই পাঁচটি গ্রামে মধুমতি নদীর ভাঙনের মাত্রা তীব্র আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় গ্রাম খোলাবাড়িয়া এলাকাটি সম্পূর্ণই বিলিন হয়ে গেছে । এ অবস্থায় নদীর তীর রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সেখানকার বাসিন্দারা মানববন্ধন করেছেন।
স্থানীয় নানান প্রতিকূলতা, একে অন্যের সহানুভবতা, ঘটনা-দুর্ঘটনাসহ এখানে জন্মগ্রহণ করা মানুষের সফল কর্মকাণ্ড গুলো প্রতিনিয়তই প্রকাশিত হচ্ছে জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকা সমূহে। তেমনিভাবে আলফাডাঙ্গা উপজেলার কৃতি সন্তান খান মুহাম্মদ রেজোয়ান এর অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হওয়ার সংবাদটি উঠে আসে ফরিদপুরের জনগণ নামক সামাজিক মাধ্যমে। অসংখ্যা খাল-বিল ও নদী বেষ্টিত সবুজ এ আলফাডাঙ্গা বর্ষার পারম্ভে মায়াময় এক রুপ ধারণ করে। ঐতিহাসিক আলফাডাঙ্গার ভূ-পৃষ্ঠে ইতিহাসের সাক্ষ্যি হয়ে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাড়িয়ে আছে চাঁদড়া জমিদার বাড়ি ইংরেজ শাষকদের প্রতিষ্ঠিত মীরগঞ্জ নীলকুঠি। প্রধান কুঠির পাশে শায়িত আছে অত্যাচারি নীলকর ডানলপ।
কিন্তু দু:খের বিষয়, ২০০০ সালের দিকে কোন লোভী ব্যাক্তি রাতারাতি দলবল নিয়ে সমাধিটি ভেঙ্গে ফেলে এই আশায় যে এখানে অনেক ধন-সম্পত্তি পাওয়া যাবে। সমাধির সেই ধংসাবশেষ এখনো রয়ে গেছে আলফাডাঙ্গার মীরগঞ্জে। যা পর্যটকদের কাছে অভিন্ন প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আলফাডাঙ্গা উপজেলার মধুমতী নদীর বাওরের উপর নির্মিত সাড়ে ৮০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ ফুট প্রস্থ্য টিটা ভাসমান সেতুটি এখন পর্যটকদের সবচেয়ে বড় মিলন মেলা। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধার সূর্যের লাল আভা থাকা অবধি এ তেতুটি মানুষের ভীরে আনন্দ সমুদ্রে পরিণত হয়। ৮৫২ টি পাষ্টিকের ড্রামের ওপর ৬০ টন লোহার ফ্রেম দিয়ে তৈরি ভাসমান সেতুটি ২০২০ সালের ২৮ মার্চ উদ্বোধন করা হয়। জানা যায় টগরবন্ধ ইউনিয়নের ৭০ জন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ৭০ লাখ টাকা দিয়ে তহবিল গঠন করে এই স্বপ্নময় সেতুটি নির্মাণ করে। যা প্রমাণ করে দেয় যে মানুষের মনোবল আর ইচ্ছাশক্তি থাকলে অনেক অসম্ভবকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে।
তাছাড়াও এ অঞ্চলের মানুষ একটু বেশিই বিনোদন প্রিয়। শিল্প সাংস্কৃতি যেন তাদের রক্তে বহমান। আন্তর্জাতিক বা জাতীয় দিবসগুলোতে তাদের উপস্থিাতি লক্ষনীয়। ক্রীড়াঙ্গণে তাড়া আরো বেশি মেতে ওঠে। বিভিন্ন সময় তারা উজ্জাপন করেন বাতসরিক নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা। নদীর কূলে বা বর্ষার পানিতে জমে ওঠে সাতার প্রতিযোগিতা, খোলা প্রান্তরে আয়োজন হয় ঘোরদৌড়। এসব আয়োজনগুলোতে মানুষ মুখের ফুঠে ওঠা হাসিই বলে দেয় তাড়া কতটা বিনোদন প্রিয়।
প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটতেই অঞ্চলের কৃষক, জেলে, ব্যবসায়ী ও খামারীরা তাদের নিয়মিত কাজে যোগদান করার মাধ্যমে দিন শুরু করে। অন্যদিকে দিন মজুর, চাকুরীজীবি বা শিক্ষার্থীরাও তাদের নির্ধারিত গন্তব্যে যাত্রা শুরু করে। এখানে রয়েছে শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ তিনটি মহাবিদ্যালয়। একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ নানা শ্রেণির স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান অঞ্চলের চিকি’সা সেবায় ভূমিকা রাখছে। তবে এ অঞ্চলের রোগিরা উন্নত চিকি’সার জন্য সাধারণত জেলা সদরে গমন করে থাকেন। একসময় অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ মাধ্যমটির ব্যহাল দশা থাকলেও বর্তমানে ভোগান্তি কমেছে। অঞ্চলের মানুষের ধর্ম-কর্ম পালনে একে অপরের সৌহার্দপূর্ণ আচরণ উপজেলাবাসি মুগ্ধ করে। পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের ভাষ্যমতে আলফাডাঙ্গা এলাকার মানুষ সভাবতভাবেই শান্তিপ্রিয়।
তবে, নিকট আত্বীয়দের সাথে বা প্রতিবেশির সাথে জমি সংক্রান্ত বিরোধে একটু বেশিই অস্থিরতা দেখা যায়।অনেক সময় রাজনৈতিক কারণেও বিরোধী সংগঠনের লোকদের সাথে সামাজিক মতবিরোধ সৃষ্টি হয় যা অন্যান্য অঞ্চলের মতই একটি সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ। তাছাড়াও নৈমিত্তিক কিছু ঘটনার কারণে আলফাডাঙ্গা থানা অঞ্চলাধীন মানুষ অনেক সময় দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকে। এ সমস্ত সামাজিক অবক্ষয় রোধ ও বিভিন্ন অনাকাঙ্খিত ঘটনার পুনরোত্থাপন বন্ধ করতে আলফাডাঙ্গা থানার একদল প্রশিক্ষিত সেবক সর্বদাই জনসাধারণের পাশে রয়েছেন। ৯ জন সাব-ইন্সপেক্টর ও ৯ জন এসিন্টেন্ট সাব ইন্সপেক্টরসহ মোট ৫৪ জন জনবল নিয়ে গড়া তার অধিনস্ত প্রশিক্ষিত এ বাহিনী আলফাডাঙ্গা বাসিকে সুরক্ষিত রাখতে, দিনে বা রাতে রাস্তা-ঘাটে, বাজার-মহল্লায় বিভিন্ন ভাবে দায়িত্বপালন করছেন। এর মাঝেও কিছু ঘটনা মাথা নাড়া ওঠে এ থানা অঞ্চলে।
error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।