Shibaloi

শিবালয় বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলার অন্তর্গত একটি দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজেলা। সবুজ-শ্যামল অরণ্য আর রাজ-রাজাদের ঐতিহ্য বহন করে  কালের বিবর্তনে এখনো এ অঞ্চলে দাড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসের বহু পুরাকৃর্তি।

পড়ন্ত শেষ বিকেল, পশ্চিমাকাশে সূর্যের মায়াময় রূপে জেগে ওঠা পদ্মা-যমুনার নীরব স্রোতের জলকেলী বিশিষ্ট দেশের প্রধান ২টি নদীর তীরে গড়ে ওঠা শিবালয় উপজেলা তখন পাখির কলতান আর ঝি ঝি আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠেছিলো। সময়ের ঘূর্ণয়ণে সূর্য অস্ত যাওয়ার মাধ্যমে শিবালয়ের মানুষের নদী কেন্দ্রীক ব্যস্ততাগুলো ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। মাঝিরাও আধার নামার আগেই তাদের বৈঠা ছেড়ে নিজ ভিটাতে পাড়ি জমায়।তবে নদী জুড়ে তখনো কিছু জাহাজ আর ফেরির চলাচলে ঘাট অঞ্চলগুলো মানুষের কোলাহলে পূর্ণ থাকে।

 

এখানে রয়েছে শতেরো-শ শতকে প্রতিষ্ঠিত দেশের অন্যতম প্রাচীন জমিদারী প্রথার বস্তুনিষ্ঠ উদাহণ হয়ে দন্ডায়মান তেওতা জমিদার বাড়ি। ৭.৩৮ একর জমি নিয়ে স্থাপিত এই জমিদার বাড়ির মূল প্রাসাদের চারপাশে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রচীন স্থাপনা ও একটি বড় পুকুর। জমিদার বাড়ির ভবনের ভেতরে এখনো রক্ষিত আছে জমিদারের প্রতিষ্ঠিত সেই বন্দিশালা বা কারাগার। জানা যায় এখানেই সেসময় অপরাধীদের কারাবন্দি করে রাখা হতো। এ প্রাসাদেই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার সহধর্মীনী প্রমিলা দেবীর প্রেমে পড়েছিলেন আর লিখেছিলেন তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সেকি মোর অপরাধ। কবি ও তার প্রেয়সীর বহু স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে শিবালয়ের এই তেওতা জমিদার বাড়ির অঙ্গন জুড়ে।

শিবালয় থানার উৎপত্তি :

ইতিহাস থেকে জানা যায় ১৮৭৫ সালে তৎকালীন জাফরগঞ্জে থানা প্রতিষ্টিত হলে যমুনার প্রবল ভাংগনে অঞ্চলটি বিলীন হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে  ১৯০০ সালের দিকে  থানার হেডকোয়ার্টার শিবালয়ে স্থানান্তর হয় যা শিবালয় থানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরে ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশ গঠনের ১৩ বছর পর প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে শিবালয় থানাটি উপজেলায় পরিণত হয় ও শিবালয় একটি মানউন্নীত থানা হিসেবে যাত্রা শুরু করে।

শিবালয় উপজেলার নামকরণ :

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পদধূলিতে ধন্য এই শিবালয় উপজেলাটির নামকরণ নিয়ে একাধীক মন্তব্য থাকলেও গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যায় এই যে, মহাদেবের পূজা অর্চনার জন্য অত্র  এলাকায় একটি  শিবের আলয় বা মন্দির অবস্থিত ছিল। কালের বিবর্তনে ঐ  শিবের আলয় বা মন্দিরের নাম অনুসারেই অঞ্চলের নাম হয় শিবালয়।

শিবালয় উপজেলার গঠন

পদ্মা-যমুনা বিধৌত শিবালয় উপজেলাটি মানিকগঞ্জ জেলার সর্ব পশ্চিমে ৭টি ইউনিয়ন দ্বারা গঠিত। মানিকগঞ্জ জেলার অন্যতম উপজেলা শিবালয়র উত্তরে দৌলতপুর, পূর্বে ঘিওর, দক্ষিণে হরিরামপুর, পশ্চিমে রাজবাড়ী  জেলার গোয়ালন্দ ও পাবনার বেড়া উপজেলা অবস্থিত। সবুজ-শ্যামলে ভরা খেত ও পাখির কলকলিতে মুখরিত শিবালয় উপজেলাটির আয়তন ১৯৯.১৮ বর্গকিলোমিটার। আয়তনের দিক থেকে মানিকগঞ্জ জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজেলা শিবালয়। ২০২টি মৌজা ও ২৫৫টি গ্রাম নিয়ে এ উপজেলার সকল প্রশাসনিক দপ্তর পরিচালিত হচ্ছে।

 শিবালয়ের প্রামাণ্যচিত্র দেখুন নিচের ভিডিও থেকে

 

 

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে রাজধানীর বন্ধনে শিবালয় উপজেলা

ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা সবুজ শ্যামল এই উপজেলার উপর দিয়ে চলে গেছে ঢাকা আরিচা মহাসড়ক। রাজধানী ঢাকার সাথে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগের সেতু বন্ধন আরিচা ও পাটুরিয়া ঘাটটি দেশের অন্যতম আলোচিত ফেরিঘাট। যা পদ্মা ও যমুনার এপাড় ওপাড় পারাপারে একই সাথে গৌরব ও ভোগান্তির শেষ অধ্যয়। সকাল থেকে সন্ধা, রাত থেকে মধ্যরাত এই ঘাট থেকে ফেরিপাড়ের অপেক্ষায় প্রতিদিন শত শত যান ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকে।একসময় আরিচা ফেরিঘাটটি ছিলো উত্তর পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চল এর মানুষের রাজধানী ঢাকার সাথে যোগাযোগের একমাত্র একমাত্র নৌবন্দর। ১৯৯৭ সালে যমুনা সেতু উদ্ভোধন এর মাধ্যমে আরিচাঘাটের ব্যস্ততা অনেকাংশে কমে যায় এবং ২০০২ সালে ৯ কিলোমিটার ভাটিতে পাটুরিয়া ঘাটে প্লাটুন স্থানান্তরের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পাটুরিয়া ঘাটটি গুরুত্বপূর্ণ নৌবন্দর হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।পদ্মা ও যমুনার পললে গড়া  শিবালয় এর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্ব বহণ করে  আরিচা ও পাটুরিয়া ঘাট।

এলাকার মানুষের আয়ের উৎস :

এ অঞ্চলের মানুষ স্বাধারণত ব্যবসা কেন্দ্রিক জীবন নির্বাহ করলেও চাকুরী ও কৃষিতে তাদের যথেষ্ঠ সুনাম রয়েছে। এছাড়াও মাছ শিকারী পেশাতে শিবালয়ের মানুষের রয়েছে প্রাচীন অভিজ্ঞতা।  তবে কাচা মরিচের চাষ ও রপ্তানী বাণিজ্যে শিবালয়ের রয়েছে বিশ্বব্যাপী সুনাম। উপজেলার বরংগাইল হাটের মরিচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে।উল্লেখ্য, উপজেলার আওতাধীন যমুনা নদী বেষ্টিত আলোকদিয়া চরের চাষীদের জন্য নির্মিত হয়েছে মুজিব কেল্লা। যেখানে কৃষকরা নিরাপদে থাকতে ও তাদের চাষকৃত ফসলাদি রাখতে পারে। বর্ষায় সময় নদীর দু’কূল ছাপিয়ে উপজেলা জুড়ে থাকে জল আর জল । আর বর্ষার শেষে যমুনার জলে ভেসে আসা বেলে-দোআঁশ মাটিতে নতুন স্বপ্ন বুনে কৃষকরা। সদ্য জেগে ওঠা এক একটি বালুচর যেন এক একটি আশার মুখ। এসব চরগুলোতে বাদাম চাষে কৃষকেরা বেশ লাভবান হতে পারে। ধান, পাট, গম, সরিষা ও বাদাম এখানকার অন্যতম কৃষিজ ফসল।

শিবালয়ের শিল্প কারখানা :

শিবালয়  যমুনা ও পদ্মার তীরবর্তী হওয়ায় তেমন বেশি শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেনি এখানে । তবে গ্যাস চালিত পরিবেশ বান্ধব একটি ব্রিকস কারখানা গড়ে উঠেছে এ শিবালয়ে । রয়েছে ফিড কারখানাসহ বিশেষাতি কয়েকটি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প।

প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে দেখা মিলবে অঞ্চলের সাড়ি সাড়ি তালগাছের বাবুই পাখির বাসা। মহাসড়কের কোল ঘেষে গড়ে ওঠা একেকটি ঘর আর ফসলের মাঠ যেন প্রকৃতির সুরে কাছে টানবে প্রকৃতি পেমিদের।তাছাড়াও উপজেলার পরতে পরতে কবি নজরুলের পদধূলির সেই স্মৃতিচিহ্নগুলো নজরুল প্রেমিদের কাছে টানে। এখানেই তিনি রচনা করেছেন- ‘আমার কোন কূলে আজ ভিরলো তরী, এ কোন সোনার গাঁয়।” আবার লিচু চোর এর মত বিখ্যাত ছড়াও তিনি এখানে বসেই রচনা করেছিলেন।

শিবালয় উপজেলার বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ :

কিরন শংকর রায় (১৮৯১-১৯৪৯)

শিবালয় উপজেলার প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে কিরন শংকর রায় অন্যতম। তিনি মানিকগঞ্জ জেলাধীন শিবালয় উপজেলার তেওতা রাজ পরিবারের তরুন বংশধর ছিলেন। তাঁর বাবার নাম হরশংকর রায় চৌধুরী। তিনি তেওতা একাডেমী হতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং কোলকাতা হিন্দু স্কুল থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ১৯৩৭ সালে বিধানসভার নেতা নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি বিধানসভার সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ১৯৪৮ সালের ৪ মার্চ ডা: বি,সি রয় এর পশ্চিমবঙ্গ মন্ত্রীসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যোগদান করেন।  একজন রাজনীতিবিদ হয়েও বাংলা সাহিত্যে কিরন শংকর রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছন। তিনি প্রমথ চৌধুরী কর্তৃক পরিচালিত ‘সবুজপত্র’ জোট ও সুকুমার রয় এর ‘মানডে ক্লাব’ এর বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন। তিনি সপ্তপর্ণা নামে ছোটগল্পসমগ্র প্রকাশ করেন। কিরন শংকর রায় ১৯৪৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী দেহত্যাগ করেন।

প্রমীলা নজরুল (১৯০৮-১৯৬২)

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর সহধর্মীনী প্রমীলা নজরুল। বাবা-মায়ের দেওয়া নাম আশালতা সেন, ডাক নাম দোলনা বা দুলি। বসন্ত কুমার ও গিরিবালা দম্পতির কন্যা প্রমীলার জন্ম ১৯০৮ সালের ১০ মে শিবালয় উপজেলার তেওতা গ্রামে। প্রমীলা ১২/১৩ বছর বয়সে বাবা বসন্ত কুমার মারা গেলে মা গিরিবালা প্রমীলাকে নিয়ে তার ছোট কাকা ইন্দ্র কুমার সেনের কাছে কুমিল্লা চলে যান। কুমিল্লাতেই নজরুলের সাথে প্রমীলার ২৫ এপ্রিল, ১৯২৪ সালে বিয়ে হয়। সহধর্মীনী প্রমীলার প্রেম ও সান্নিধ্য নজরুলের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। নজরুল প্রেমের কবি, তারুন্যের কবি, গানের কবি, নারীমুক্তি ও নারী-পুরুষ সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার কবি যার মূলে রয়েছে প্রমীলার সাথে তাঁর প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা, সুখ-দু:খ, সংকট-সংগ্রাম এবং বিদ্রোহ বিপ্লবের উপখ্যান। প্রমীলা ১৯৬২ সালে মৃত্যু বরন করেন।

তাছাড়াও শিক্ষা,সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ শিবালয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন, গবেষণাধর্মী প্রবন্ধের  লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ, রাজনীতিবিদ  ও দক্ষ সৈনিক ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীসহ অনেক কৃতিমান পুরুষ।

শিবালয় থানার চিকিৎসা সেবা :

শিবালয়ের উথুলীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাজার ভক্তদের নির্মিত বাবা ফজর পাগলার মাজার ও রওজা শরীফ। ধর্মান্ধ ও কুসংস্কারের ভীরে উপজেলার মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থায় রয়েছে ৩১ শয্যা বিশিষ্ট একমাত্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও একাধিক  বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র সহ নানান বেসরকারী চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান। জানা যায় খুব শিঘ্রই উপজেলার মানুষের উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদাণের লক্ষ্যে নির্মিত হতে যাচ্ছে বেশকিছু আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র।

উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা :

উপজেলার মানুষের শিক্ষার হার বেশ উন্নত। উপজেলার মহাদেবপুর ইউনিয়ন সরকারি কলেজ, সদরপুর ডিগ্রি কলেজ,  উপজেলা কেন্দ্রীয় আব্দুল গণি সরকার উচ্চ বিদ্যালয়, শিবালয় টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ, অক্সফোর্ড একাডেমী, বরাংগাইল গোপাল চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় ও ১৮৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত তেওতা একাডেমীসহ প্রায় শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উপজেলার মানুষের শিক্ষার মান এগিয়ে চলেছে।

শিবালয় উপজেলাধীন দেশের অন্যতম দুটি নদীবন্দর থাকায় সাধারণ ভাবেই মানুষের মধ্যে কিছু অপরাধ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে চলেছেন আরিচাঘাট থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে  অবস্থিত শিবালয় থানা পুলিশ। স্থায়ী বসবাসকারী প্রায় আড়াই লক্ষাধিক মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ উপজেলার নদী কেন্দ্রিক ব্যবসায় জরিত ভাসমান বিশাল জনগোষ্ঠির মধ্যে আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে শিবালয় থানা পুলিশ ২৪ ঘন্টাই নিয়োজিত রয়েছে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।