nariyaa jpg

কীর্তিনাশা পদ্মার আচরে পড়া ঢেউ আর ভাঙ্গনের শব্দে কেপে ওঠা নাম নড়িয়া উপজেলা। এই অঞ্চলে এককালের সবচেয়ে বড় মৌজা হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত নড়িয়া ১৯৩০ সালে থানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে প্রশাসনিকভাবে যাত্রা শুরু করে, ৫৩ বছর পর ১৯৮৩ সালে ১৫টি ইউনিয়ন নিয়ে উপজেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

পরবর্তী সময়ে ১১ বর্গ কি.মি আয়তনের নড়িয়া ইউনিয়নটি পৌরসভার স্বীকৃতি লাভ করায় বর্তমানে মোট ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে নড়িয়া উপজেলার প্রশাসনিক কর্যাদি পরিচালিত হচ্ছে। তবে কখন, কিভাবে, কবে এই অঞ্চলের নাম নড়িয়া নামে জনশ্রুতি পেয়েছে তার সঠিক ইতিহাস কেউই বলতে পারে না। ধারণা করা হয়, নদী বিধৌত এ অঞ্চলের সীমানা প্রতি বছরই স্থানান্তর হত। এই কথাটিকে আঞ্চলিক ভাবে বলা হত সইরে যেত বা নইরা যেত।

 

 

এই নইরা শব্দটিই উচ্চারণ বিবর্তনে নড়িয়া নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে শুরু হয় ঘোর আতঙ্ক। কখন যে কার পৈতিক ভিটা বিলীন হয়ে যায়! এমন সংসয়েই থাকে নদীর কাছাকাছি বসবাস করা মানুষগুলো।

ভাঙনে পদ্মার গর্ভে চলে যায় গ্রামের পর গ্রাম। গত ২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মানুষের চোখের সামনেই পদ্মায় বিলীন হয়েছে বিশালাকার একটি তিনতলা বাড়ি। ঐ বছরই মাত্র এক সপ্তাহে ২শ বছরের পুরনো মূলফৎগঞ্জ বাজারের ৩ শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। নিস্তার পায়নি বাজারের ৭ শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ উপজলার এক মাত্র ৫০ শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও মসসিদ।

প্রতিবছরই বিলাশ বহুল বাড়ীঘরসহ শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে যাওয়ায় পদ্মার পাড়ে চলে কান্না আহাজারী। রাক্ষুসী পদ্মার হিংস্র থাবায় লন্ডভন্ড হয়ে যায় হাজার হাজার পরিবারের জীবন সংসার। এক সময়ের জমিদার ও সমাজের প্রভাশালীরা রাতারাতি হয়ে পড়ে নিঃস্ব ও ভুমিহীন। প্রতি বছর বরাদ্ধকৃত সরকারের হাজার কোটি টাকার প্রকল্পগুলো কোন কাজেই আসেনা ভাঙ্গন ঠেকাতে। যেন প্রকৃতি তখন বড়ই নির্দয় হয়ে ওঠে। তবে একসময়ের নানা প্রতিকুলতায় জর্জরিত এই উপজেলাতে বতমানে পদ্মা সেতুকে ঘিরে উন্নয়নের মহাকর্মযজ্ঞের প্রভাব বিস্তার ঘটছে। ইতিমধ্যেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ নদী ভাঙ্গন রোধে সরকার ডেল্টাপ্ল্যান ঘোষনা করেছেন। তারই অংশ হিসেবে এ অঞ্চলে ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। যা প্রায় সমাপ্তির পথে।

প্রমত্তা পদ্মার ভাঙ্গা-গড়ার আতঙ্কের এলাকায় ভাঙ্গনরোধ হয়ে এখন সেখানে গড়ে উঠছে সুরম্য অট্টালিকা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা প্রতিষ্ঠান। গত ৫০ বছর যাবত যেখানে পদ্মার ভাঙ্গাগড়ার সঙ্গে মানুষ লড়াই করে কোন রকম টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিল, সেখানে আজ ভাঙ্গনরোধ হওয়ায় মানুষ নিরাপদে বসবাস করছে।

পদ্মা ও পদ্মা থেকে উৎপন্ন কীর্তিনাশা নদী বিস্তৃত নড়িয়া উপজেলার আয়তন ২৪০.০২ বর্গ কি.মি.।  এবং সর্বশেষ সমীক্খা অনুযায়ী জনসংখ্যা ২৩১৬৪৪ জন হলেও বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় তিন লাখে পৌছেছে। ঘন ও সবুজে অরণ্যে নড়িয়ার মানুষের প্রধান জীবিকা মাধ্যম কৃষি। পলি মাটি উর্বর এ অঞ্চলের জলাভুমি ও বিভিন্ন কৃষিজ ভুমি সরাবছরই মৌসুমী সবুজ ফসলে ভরে থাকে। এ উপজেলার অধিকাংশ মানুষই নিম্ন ও মধ্য আয়ের। তবে গত দুই দশকে কিছু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সফলতার ফলে বর্তমানে এ অঞ্চলের মানুষ জীবন মান বহুগুনে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ভোজেশ্বর বাজার ও ঘড়িশারা বাজার নড়িয়া উপজেলার প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এখান থেকে ধান, গম, পাটসহ বিভিন্ন পণ্য বাণিজ্যিকভাবে কলকাতা ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হয়ে থাকে।

কৃষক, জেলে, খামারী ও ব্যবসায়ীদের হার তুলনামুলক বেশি হলেও, সর্বহারা বা ভূমিহীন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। উপজেলার পৌর অঞ্চলে মোট ৭০ শতাংশ মানুষ শিক্ষার আলোতে থাকলেও গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার একটু নি¤œমুখি। দুই শতাধিক বিভিন্ন মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে এ উপজেলায় মহা বিদ্যালয় রয়েছে ৫টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রায় ১০টি ও প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে মোট ১৭১টি। স্বাস্থ্যসেবার জন্য এখানে গড়ে উঠেছে ১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সহ মোট ৫টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র। মাত্র ২ দশক আগেও এ অঞ্চলটি ছিল সড়ক বিহীন, একটি জরাজীর্ণ জনপদ। কিন্তু বর্তমানে নড়িয়ার সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতই উন্নয়নে এগিয়ে চলছে সমান তালে। উপজেলার মানুষের দৈনন্দিন চলাচল, বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনাসহ সর্বপরি মানুষের জীবনাচারণ প্রকাশে রয়েছে দেশের অগনিত গণমাধ্যমসহ নড়িয়া বার্তা নামে ১টি আঞ্চলিক পত্রিকা।

ভ্রমনপিপাসু মানুষের জন্য এ উপজেলায় রয়েছে নান্দনিক স্থাপত্যশৈলী, আর সুমহান জীবনব্যবস্থা ও কল্যানের আহবানে গড়া চিশতিনগর দরবার শরিফ। রয়েছে শত বছরের পুরোনো রাম সাধুর আশ্রম, রাজা মানসিংহের বাড়ি। এবং শরিয়তপুর জেলার একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মর্ডার্ণ ফ্যান্টাসি কিংডম। নড়িয়া উপজেলায় জন্ম নিয়েছেন, বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহা পুলিশ পরিদর্শক জনাব এ.কে. এম শহিদুল হক, বিপিএম, পিপিএম। তিনি বাংলাদেশ কমিউনিটি পুলিশিং এর অন্যতম প্রবর্তক হিসেবে কমিউনিটি পুলিশকে জনগনের কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন। দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় তার অবদান অনস্বীকার্য।

এছাড়াও উনবিংশ শতাব্দির বৈজ্ঞানিক অম্বিকাচরণ ভট্টাচার্য এর জন্মও এই নড়িয়া উপজেলায়।  ১৪২টি মৌজা, ১৪টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত নড়িয়া উপজেলার মোট ৭০ হাজার পরিবারের সর্বসময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে নড়িয়া থানার একদল চৌকস পুলিশ সদস্য। আর তাদেরকে সর্বক্ষণ সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে থানার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন একজন অফিসার ইনচার্জ জনাব মাহাবুব আলম

মানুষের সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করা এই পুলিশ অফিসার স্ব-গৌরবে তুলে ধরেন তার কর্মজীবনে যোগদানের শুরুর কথাগুলো, সেবার ব্রত নিয়ে মহান এ পেশায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করা অফিসার ইনচার্জ জনাব মাহাবুব আলম নড়িয়াবাসিকে আইনের সঠিক ধারণা দিতে নিয়মিত ভাবে স্থানীয় মসজিদে মুসল্লিদের সাথে আলোচনা করে থাকেন।

মাহাবুব আলম তার বক্তব্যে তুলে ধরেন সমাজের কিছু অসহায় নারীদের কথা। তিনি নিয়মিত ভাবেই স্থানীয় বিভিন্ন মসজিদে ইভটিজিং বন্ধে ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে করণীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচলা করে থাকেন। প্রতিনিয়ত নদী ভাঙ্গনের আতঙ্কে জর্জরিত এই জনপদের মানুষগুলোর মাঝে একটু শান্তি ও শৃংখলা ফিরিয়ে দিতে নড়িয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মাহাবুব আলম এর স্বদিচ্ছার কমতি কোন নেই। কিন্তু কিছু অনাকাংখিত ঘটনায় ক্ষণে ক্ষণে এ জনপদটি ভিবিষিকাময় হয়ে ওঠে। এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধে নড়িয়া থানা পুলিশ কিভাবে কাজ করছে …এ ব্যপারেও  বিস্তারিত আলোকপাত করেন।

থানা অঞ্চলাধীন জনমানুষের মুখে নড়িয়া থানা পুলিশের কাজের কৌশল ও সাহসিকাতা সম্পর্কে উজ্জল প্রশংসা রয়েছে। নড়িয়া থানা পুলিশের সেবামূলক বাস্তবায়িত কাজগুলো নিঃসন্দেহে আগামীদিনের জন্যও উপজেলাবাসির নিকট একটি প্রত্যাশিত সবুজ সংকেত।

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।