Chandanaish Upzilla

পাহাড়ের নীলে আর দিগন্তের নীলে

শূন্যে আর ধরাতলে মন্ত্র বাধে ছন্দে আর মিলে।

 

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার এই দুটো লাইন যেনো চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার রুপবৈচিত্রের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। সমতল ভূমি ও পাহাড়ের মিতালীতে গড়ে ওঠা চট্টগ্রামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপজেলা চন্দনাইশ। একইসাথে পাহাড় ও সমতলের জীবনধারা আলাদা বৈচিত্রে বিশেষায়িত করে এই উপজেলাকে। বর্তমানে উন্নত নানাবিধ প্রতিষ্ঠান এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার সমন্বয় থাকলেও এই উপজেলাটির রয়েছে হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস। ১৪২৯ সালের পর থেকে অঞ্চলটি আরাকান শাসকের অধীনে ছিল। প্রাচীনকালে চন্দনাইশ উপকূলের সমুদ্র বন্দর দিয়ে আরাকান এবং মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ হতে আগত বণিকেরা এ অঞ্চলে উৎপাদিত সুদৃশ্য ও সুগন্ধী চন্দনের আঁশযুক্ত কাঠের ব্যবসা করতেন। কথিত আছে, চন্দন কাঠের নামানুসারে এ অঞ্চলের নামকরণ করা হয় চন্দনাইশ। একইসাথে চন্দন এবং চন্দনের আঁশ প্রসিদ্ধতা লাভ করায় দুই শব্দের সমন্বয়ে নামটি হয়েছে চন্দনাইশ।

 

 

ঐতিহ্যবাহী এই চন্দনাইশের দোহাজারী ছিল চট্টগ্রামের স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। এখান থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন ও প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে উঠে। উনসত্তরের গণআন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলিতে এই অঞ্চলের সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতা-কর্মীদের জোরালো ভূমিকা ছিল। মাতৃভূমি রক্ষা ও প্রতিরোধ যুদ্ধে বরকল, বরমা, কেশুয়া, কানাইমাদারী এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কথাও জাতির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে চন্দনাইশে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধে পাকবাহিনীর পরাজয় ঘটে। মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষনা যে বেতারকেন্দ্র থেকেই জাতির কানে বেজে উঠেছিলো সেই “স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র” চট্টগ্রাম থেকে চন্দনাইশের দোহাজারীতে স্থানান্তর করা হয়েছিলো।

 

স্বাধীনতা লাভের ৫ বছরের ব্যবধানে ১৯৭৬ সালে পটিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে চন্দনাইশ থানার উদ্ভব হয়। এর আগে চন্দনাইশ ছিল পটিয়া উপজেলার একটি অংশ। পরে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ১৯৮৩ সালের ২ জুলাই চন্দনাইশ থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়।

চন্দনাইশ উপজেলার পূর্ব পাশে বৃক্ষে আচ্ছাদিত পাহাড় ও বনজ প্রকৃতির ধার দিয়ে বয়ে চলা পাহাড়ী সাঙ্গু নদীর সৌন্দর্য বিশেষভাবে আকর্ষিত করে। বার আউলিয়ার পূণ্যভূমি খ্যাত চন্দনাইশ উপজেলার আয়তন ২০১.৯৯ বর্গ কিলোমিটার। ৯টি ইউনিয়ন ও ২ টি পৌরসভা নিয়ে বিভক্ত প্রাকৃতিক রুপে বৈচিত্রপূর্ণ এই উপজেলাটি। বর্তমানে এ অঞ্চলে ২ লাখ ৩৩ হাজার ১৭ জন মানুষের বাস।

পাহাড়ী বনাঞ্চল, সবুজে ঘেরা সমতল, সাপের মতো বয়ে চলা নদী- কী নেই চন্দনাইশ এর প্রকৃতিতে? ধোপাছড়া ইউনিয়নটি পাহাড়ি এলাকায়; পাহাড়ি এবং সমতলের মিশ্রনে রয়েছে দোহাজারী, হাসিমপুর এবং কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়নগুলো। জোয়ারা, বরকল, বরমা, বৈলতলী ও সাতবাড়িয়া ইউনিয়নগুলো সমতলে অবস্থিত।

পাহাড় ও সমতলের সন্নিবেশের কারণে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনধারাও বৈচিত্রময়। জীবিকার তাগিদে একইসাথে কুটির শিল্প এবং মৃৎশিল্পের কারুকাজ চোখে পরে এই অঞ্চলে। সাতবাড়িয়া ও দক্ষিণ জোয়ারায় ‘হাতপাখা’ তৈরির কুটির শিল্প এবং উত্তর জোয়ারার কুমার পল্লীতে উৎপাদিত ‘হাঁড়ি-পাতিল তৈরির মৃৎশিল্প জনজীবনের চাহিদা পূরণে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। উর্বর পাহাড়ী বনাঞ্চলের বনজ সম্পদ এ চন্দনাইশের মানুষদের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে; তা-ই এলাকাজুড়েই গড়ে উঠেছে বেশ কিছু আসবাবপত্র তৈরীর প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করে এ অঞ্চলের মানুষজন সাবলম্বী হয়েছেন।

এভাবেই বৈচিত্রপূর্ণ জীবনযাপনের মাঝে বেড়ে ওঠা চন্দনাইশ উপজেলার মানুষের যোগাযোগের জন্য বেশ সুবিধাজনক ব্যবস্থা রয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারগামী মহাসড়কটি আঁকাবাঁকা হয়ে বয়ে গেছে এই এলাকার ওপর দিয়ে। তাছাড়া দোহাজারী, হাশিমপুর, গাছবাড়িয়া খান হাট নামক তিনটি রেলস্টেশন রয়েছে চন্দনাইশে। এছাড়াও এখানে ৮১কিমি পাকা রাস্তা, ১৪১ কিমি আধা-পাকা রাস্তা, ২০২ কিমি কাচারাস্তার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। সাঙ্গু নদীকে ঘিরে রয়েছে ৫কিমি নৌপথ এবং তিন স্টেশনের সমন্বয়ে ২০কিমি রেলপথে সাজানো এ অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা।

ঐতিহ্যবাহী চন্দনাইশ উপজেলা দেশবরেন্য ব্যক্তিত্ব, কবি, লেখক এবং ধর্মীয় সাধকদের জন্মসূত্রে জ্ঞানীগুনী মানুষদের জন্য বেশ প্রসিদ্ধ অঞ্চল। বাংলা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক আহমদ ছফার জন্মস্থান এই চন্দনাইশ। মহান  মুক্তিযুদ্ধে অগ্রগণ্য  অবদান রাখায় বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত দুজন মুক্তিযোদ্ধা অলি আহমেদ এবং আব্দুল করিমের জন্মস্থান এই অঞ্চল। এছাড়াও ভাষা সৈনিক আবুল কাসেম, জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নুরুল ইসলাম, ভাষাসৈনিক অধ্যাপক সোলায়মান খান, বঙ্গবন্ধুর সহচর এ কে এম আব্দুল মান্নান প্রমুখ ব্যক্তিদের নাম এবং অবদান চন্দনাইশের ইতিহাসে সমুজ্জল। অখণ্ড ভারতবর্ষের প্রথম সাড়ির দুইজন কংগ্রেস নেতা যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এবং যাত্রামোহন সেন জন্ম এ অঞ্চলেই। এছাড়াও চন্দনাইশে জন্ম নিয়েছেন আরো অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব।

বর্তমানে সাঙ্গু নদীকে কেন্দ্র করে চন্দনাইশ অঞ্চলে কৃষিকাজই মূল পেশা হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির ঢেলে দেয়া সবুজকে আরো সাজিয়ে তোলে কৃষকের আবাদী জমিগুলো। কৃষিকাজ করে এ অঞ্চলের ৩৬.৪১ শতাংশ মানুষ আয় করে থাকেন। পাহাড়, জনপদ আর সমতলের মাঝে আবাদী জমিগুলো সেজে ওঠে ধান, গম, আখ, আলু, মরিচ, সরিষা এবং নানান পদের শাকসবজি চাষে।

এছাড়াও কাঞ্চননগরের পেয়ারার কারণে সারাদেশে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে চন্দনাইশ। অঞ্চলটির হাশিমপুর এবং কাঞ্চননগর গ্রামে রয়েছে প্রায় ২০০০ পেয়ারা বাগান। যেখানে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকার পেয়ারা বানিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। পেয়ারা ছাড়াও আরও চাষ হয় আনারস এবং লেবু। অর্থাৎ শস্য,শাকসবজি,ফলফলাদি সবকিছুরই জোগান দিয়ে চলেছে চন্দনাইশের কৃষকদের পরিশ্রমী হাতগুলো।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইসলাম ধর্মের অনেক সুফী সাধকদের পদচারণা ছিলো এই চন্দনাইশ উপজেলাতে। ইসলাম প্রচার এবং প্রচারে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখায় যাদের নাম স্থান পেয়েছে ইতিহাসে; রয়েছে তাদের স্মৃতিবিজরিত অনেক স্থাপনাও। উল্লেখযোগ্য ইসলামী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন, হযরত মোহছেন শাহ আরবী, হযরত মোস্তান আলী শাহ (রহ), মনিরুজ্জামান ইসলামীবাদী, শাহ সূফি মাওলানা আমিনুল্লাহ শাহ, মাওলানা জালাল আহমেদ সহ আরো অনেক ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাবিদ। তবে চন্দনাইশ উপজেলায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা বেশি হলেও এখানে রয়েছে সব ধর্মেরই ধর্মীয় উপসানালয়। উপজেলাটিতে  মসজিদ রয়েছে ২৭৫টি, মন্দির ৭০টি, বিহার ১১টি, মাযার ২০টি, তীর্থস্থান ১টি । মোট জনসংখ্যার ৮৪ শতাংশ মুসলিম, ১৩শতাংশ হিন্দু এবং ৩শতাংশ বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী্র সম্মিলিত বসবাস এই এলাকাতে।

পুরো চন্দনাইশ থানা অঞ্চলে পুলিশের সেবা মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌছে দিতে দোহাজারি এবং ধোপাছড়িতে রয়েছে দুইটি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র। এছাড়াও দুটি পৌরসভা এলাকাতে ৩টি করে ৬টি এবং প্রতিটি ইউনিয়ন এলাকাতে ১টি করে মোট ১৪টি বিটে বিট পুলিশিং কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।