Boalkhali Upzila

ওগো ও কর্ণফুলী,

তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কানফুল খুলি।

উজাড় করিয়া দিনু তব জলে আমার অশ্রুগুলি।

 

কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভ্রমণের একটি অন্যতম প্রিয় স্থান ছিল কর্ণফুলী নদী। প্রকৃতির মায়ায় জড়ানো অবারিত সৌন্দর্যের স্রোতধারায় বহমান কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ-পূর্ব তীর ঘেষে জেগে ওঠা প্রাচ্যের রাণী খ্যাত চট্টগ্রামের বোয়ালখালী শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ভরপুর একটি উপজেলা। বোয়ালখালীর পশ্চিমে দেশের অন্যতম বন্দর নগরী চট্টগ্রাম, পূর্বে নৈসর্গিক রূপবৈচিত্রের আঁধার করলডেঙ্গা পাহাড়, দক্ষিণে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক মাষ্টারদা সূর্যসেনের জন্মভূমি পটিয়া এবং উত্তর-পূর্ব দিকে রয়েছে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও বান্দরবান অঞ্চল।

জনশ্রুতিতে জানা যায়, এ অঞ্চলের নামকরণ হয়েছে একজন মুসলিম সুফি সাধকের নামে। চিশতিয়া ঘরানার এই সাধকের নাম শেখ শরফুদ্দিন বু আলী কালান্দার। অঞ্চলের নামটি একজন মুসলিম মনীষীর নামে হলেও হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধসহ বহু ধর্মের মানুষের বসবাস এখানে।

 

 

ধর্মীয়ভাবে অসাম্প্রদায়িক এই অঞ্চলটি বেশ ক্ষুদ্র। এখানে কেবলমাত্র ১৩৭.২৭ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে প্রায় ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৮৩ জন বসবাস করছেন।

চট্টগ্রাম জেলা সদর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত একটি বিশেষ উপজেলা বোয়ালখালী। বোয়ালখালী এলাকাটি ৯ টি ইউনিয়ন, ১ টি পৌরসভা, ৩৪ টি গ্রাম ও ৩২টি মৌজা নিয়ে গঠিত। অঞ্চলটিতে যাতায়াত ব্যবস্থা বেশ উন্নত। এখানে ৯৫ কিলোমিটার পাঁকা রাস্তা ও ২০০ কিলোমিটার আঁধা-পাকা রাস্তা রয়েছে। আর বর্তমানে কালুরঘাট সেতুর ওপর রেলপথ নির্মাণের কাজ চলমান থাকায় এ অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থা আরও সুগম হবে বলে আশা করা যায়।

দেশের লাইফলাইন খ্যাত কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোকে ঘিরে বাংলাদেশের অর্থনীতির জীবনরেখা চালিত হচ্ছে অনেক যুগ ধরে। বোয়ালখালীও তার ব্যতিক্রম নয়। চট্টগ্রাম শহরতলীর খুব কাছে ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে জনপদটি একটি জনপ্রিয় বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে সকলের কাছে পরিচিতি পাচ্ছে। এখানে এদিক-ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা ছোট ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। উপজেলাটির পশ্চিম গোমদন্দী নদীর পূর্ব দিকে কালুরঘাট চর খিজিরপুরে ছোট বড় নানাবিধ শিল্প প্রতিষ্ঠান সহ নতুন অনেকগুলো কারখানাও গড়ে উঠছে এখানে। নদীর তীর ঘেষে পেপার মিলস, ডক ইয়ার্ড ও সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজগুলো বেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে দেশের অর্থনীতিতে। এছাড়াও জাহাজ শিল্পও পিছিয়ে নেই এখানে। কর্ণফুলীর বুকে থরে থরে সাজানো জাহাজের মেলা প্রকৃতির মিশেলে সভ্যতার উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি হয়ে ফুটে থাকা এ অঞ্চলের রোজকার দৃশ্য। এছাড়াও এখানে সুতাকল, লবণশিল্প ও বরফকল নির্মাণ কারখানাও রয়েছে। এমন হরেক রকম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।

 

ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯১০ সালে বোয়ালখালীকে থানা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষে অঞ্চলটিকে ১৯৮৩ সালে বোয়ালখালী উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়৷ এর আগে একে পটিয়া মহকুমার অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হতো।

এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষেরা বেশ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে দিন যাপন করছেন। স্বাধীন ও নিরাপদে এ অঞ্চলে উপজেলা পল্লী উন্নয়ন অফিসের কার্যালয় থেকে গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখা হয়। বোয়ালখালীতে মোট ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার ৯২০ একর। ধান, আলু ও পাট এ উপজেলার প্রধান কৃষি ফসল। পেয়ারা ও তালের ফলনও এ অঞ্চলে খুব ভালো হয়৷ একসময় এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে আখচাষ করা হতো। কালের বিবর্তনে ও শোকাবহ ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, দেশ গঠনের আগে পূর্ব পাকিস্তানের প্রচুর পরিমাণে পাট পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করা হতো। সে সূত্র ধরে বাংলাদেশের সোনালী আঁশ খ্যাত পাট ধীরে ধীরে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বোয়ালখালীও এ দুর্ভাগ্য থেকে পরিত্রাণ পায়নি।

তবে বর্তমানে এ অঞ্চলের প্রায় ১৮ দশমিক ০৬ শতাংশ মানুষ বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে কৃষিকাজ করছেন। যদিও এ অঞ্চলে কৃষির ওপর নেই অধিক নির্ভরশীলতা, ব্যবসা ও চাকরি খাতই বর্তমানে এ অঞ্চলের সর্বোচ্চ আয়ের উৎস। এছাড়াও রেমিট্যান্স সেবা থেকে শুরু করে নির্মাণ ও পরিবহন শিল্পেও নিয়োজিত আছেন অনেক শ্রমজীবী।

তবে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মিশেলে টিকে থাকা চট্টগ্রামের এই জনপদটিতে এতোকাল ধরে সার্বিক অগ্রগতির পেছনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে শিক্ষা। সময় যতোই এগিয়েছে, এ অঞ্চলের নারী-পুরুষ উভয়ই ধীরে ধীরে শিক্ষিত হয়ে উঠেছে। বর্তমানে এ অঞ্চলে পুরুষদের শিক্ষার হার ৬০ দশমিক ২ শতাংশ ও নারীদের শিক্ষার হার ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে এ অঞ্চলের শিক্ষার প্রভাব সে ব্রিটিশ আমল থেকেই শুরু হয়েছিল। বোয়ালখালী অঞ্চলের নামকরা কয়েকজন বিশেষ ব্যক্তি তখন উপমহাদেশে বাংলার নামকে সমুন্নত করেছিলেন। মুক্তকেশী দেবী রত্নগর্ভা উপাধিতে খ্যাতি পেয়েছিলেন। কারণ ড. বিভূতিভূষণসহ তাঁর ৫ সন্তানই ব্রিটিশ সরকারের আমলে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তাছাড়া কবিয়াল রমেশ চন্দ্র শীল, বিনয় বাঁশি জলদাশ, আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষ ও চলচ্চিত্র শিল্পী কবরী সারোয়ারের মতো প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদেরও জন্মস্থান বোয়ালখালী। উপমহাদেশের প্রথিতযশা চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. এ কি. এম হারুনুর রশিদ এবং সাহিত্যিক এম.এন হক ছিলেন বোয়ালখালী উপজেলার সন্তান।

বোয়ালখালী উপজেলা সদর, গোমদণ্ডী ও শাকপুরা ইউনিয়ন এবং কানুনগো পাড়া অঞ্চল উপজেলাটির ব্যবসায়িক মূল প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক খাতের সুযোগ তৈরি হওয়ায় এখানে বাইরের এলাকা থেকে আসা ব্যবসায়ীদের যাতায়াত বেড়েছে। উপজেলার প্রধান সড়ক বিশেষত কানুনগোপাড়া-হাওলা ডিসি সড়ক, শরতসেন সড়কও কালুরঘাট-ভান্ডালঝুড়ি সড়ক বাইরের এলাকাগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। এছাড়াও অবাধ যাতায়াতের জন্য কর্ণফুলী নদীর বুকে ফেরি চলাচল এতোদিন বেশ সুনাম রেখে আসছিল। স্রোতের খুবই কাছে ফেরি চলাচলের এই অপরূপ দৃশ্যও ছিল বড়োই মনোহর। তবে সময়ের পরিক্রমায় প্রযুক্তির বিকাশ আরো দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মানবসভ্যতাকে। সে-ই ধারাবাহিকতায় কালুরঘাট সেতুর বুকে নির্মাণাধীন রেলপথ আশা জোগাচ্ছে বোয়ালখালী অঞ্চলকে ঘিরে বেঁচে থাকা জনমানুষদের।

 

এ উপজেলার করলডেঙ্গা, জৈষ্ঠ্যপুরা ও আমুচিয়ায় সবুজাভ পাহাড়ের সমারোহ ও কর্ণফুলী বেষ্টিত মনোরম সৌন্দর্য পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। তা-ই এখানে বেশ নিরাপদে গড়ে উঠছে সরকারি ও বেসরকারী উদ্যোগে বহু পর্যটন শিল্প। সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষদের জন্য এ অঞ্চল হয়ে উঠেছে এক বিশেষ স্থান।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।