Hathazari Upzila

হাটহাজারী উপজেলা! বন্দরনগরী চট্রগ্রামে উত্তরে অবস্থিত পাহাড়বেষ্টিত এ অঞ্চলটি এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অপূর্ব লীলাভূমি। সবুজ বৃক্ষসারি, দিগন্তজোড়া পাহাড় ও উঁচুনিচু বনভূমিতে চড়ে বেড়ানো হরিণ…. যেন প্রকৃতির কোলে গড়ে উঠা এক অপরূপ ও অনন্য নৈস্বর্গের নাম হাটহাজারী।

 

এটি চট্রগ্রামের এক ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক এলাকা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, হাটহাজারীর পূর্ব নাম ছিলো আওরঙ্গবাদ। বর্তমানের হাটহাজারী, উত্তর রাউজান ও ফটিকছড়ি আওরঙ্গবাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। হাটহাজারী নামকরণেও রয়েছে এক বিস্তর ইতিহাস, জানা যায় চট্রগ্রামে মুঘল আমল থেকেই মসনদধারী প্রথা চালু হয়। সেসময় এ অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা এবং শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বারো জন হাজারীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার মুর্শিদাবাদের নবাবের আদেশ অমান্য করে হাজারীগণ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেন এবং নবাবের বিরুদ্ধাচরণ করেন। বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তিসরূপ নবাব তাদের বন্দির আদেশ দিলে ১২ জনের মধ্যে ২ জনকে বধ্যতা স্বীকার করায় ছেড়ে দেয়া হয় এবং ২ জন পালিয়ে যান। মুর্শিদাবাদের নবাব বাকি আটজন হাজারীকে বন্দি করতে সামর্থ্য হন এবং তাদের গঙ্গায় ডুবিয়ে হত্যার আদেশ দেন। বেঁচে যাওয়া হাজারীদের মধ্যে বীরসিংহ হাজারী যে হাট প্রতিষ্ঠা করেন তাকেই আজকের হাটহাজারী বলা হয়।

 

 

ঢাকা থেকে ২৫৯ দশমিক ৬ কিলোমিটার এবং চট্রগ্রাম শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এক প্রশাসনিক জনপদ হাটহাজারী। উঁচুনিচু পাহাড়, সবুজ বনাঞ্চল এবং নৈসর্গিক সৌন্দর্যের উপজেলা প্রাচীনকাল থেকেই প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে ভরপুর। এ উপজেলার উত্তরে ফটিকছড়ি উপজেলা, পূর্বে ফটিকছড়ি ও রাউজান উপজেলা, দক্ষিণে চান্দগাও থানা ও বায়েজিদ বোস্তামি থানা এবং পশ্চিমে সীতাকুন্ড উপজেলা অবস্থিত।

হাটহাজারী থানা হিসেবে গঠিত হয় ১৯২৯ সালে, এবং প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে ১৯৮৩ সালে একে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। বর্তমানে হাটহাজারী থানাকে মডেল থানায় রুপান্তর করা হয়েছে। হাটহাজারী উপজেলায় একটি পৌরসভা এবং ১৪টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত, যা ৫৯ টি গ্রাম ও ৫১টি মৌজায় বিভক্ত। ইউনিয়নসমূহ যথাক্রমে, ফরহাদাবাদ, ধলই, মির্জাপুর, গুমানমর্দন, নাঙ্গলমোড়া, ছিপাতলী, মেখল, গড়দুয়ারা, উত্তর মাদার্শা, ফতেপুর, চিকনদণ্ডী, দক্ষিণ মাদার্শা, শিকারপুর এবং বুড়িশ্চর।

এছাড়াও, চট্রগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ১ নং দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ড এ উপজেলার অন্তর্ভুক্ত এবং সম্পূর্ণ হাটহাজারী উপজেলা হাটহাজারী মডেল থানার আওতাধীন।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে হাটহাজারী থানার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। হাটহাজারী জনপদটি মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিলো। স্বাধীনতাকামী অদম্য সাহসী যুবকদের সংগঠিত করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে প্রেরণের পিছনে এই জনপদের অবদান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। তৎকালীন সময়ে চট্রগ্রাম সেনানিবাস হাটহাজারীতে অবস্থিত থাকায় পাক হানাদার বাহিনী এসব সড়কে চলাফেরা করত। অপরদিকে মুক্তিকামী যুবকরা দলে দলে এসে ধলই এবং ফরহাদবাদে একত্রিত হতে থাকে। হাটহাজারীর মধ্যে ধলই ও ফরহাদাবাদ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্ভেদ্য দুর্গ। তবে, প্রায় সময় রাজাকারদের সহযোগিতায় গ্রামের ভিতর ঢুকে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও অমানষিক করত পাক হানাদার বাহিনী।

পাক বাহিনীর এসব অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ধলই ও ফরহাদাবাদ এলাকার একত্রিত যুবকদের মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠকদের সার্বিক সহযোগিতায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে পাঠানো হয়।

প্রশিক্ষণ শেষে নরঘাতক পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে হাটহাজারী এলাকা শত্রুমুক্ত করতে চালানো হয় বিভিন্ন অপারেশন। হাটহাজারীতে মুক্তিযোদ্ধাদের বহু ছোট-বড় অপারেশনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কাটিরহাট-ধলই অপারেশন। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৩ই ডিসেম্বরে সংগঠিত হাটহাজারী থানার গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধের সমন্বয়ে ভয়াবহতম সম্মুখযুদ্ধ ছিল এ অপারেশনটি । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে পাকসেনারা সন্ধ্যার মধ্যে কাটিরহাট ঘাঁটি ও উদালিয়া চা বাগান ত্যাগ করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে চলে যায়। এ দিনেই উত্তর হাটহাজারী পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকার মুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসিক ভুমিকা আজীবন স্মরণ রাখতে নির্মিত হয়েছে ১টি বধ্যভূমি ও ১টি গণকবর।

স্বাধীনতা এতো বছর পর হাটহাজারি এলাকা এখন প্রাচুর্যে ভরপুর একটি জনপদ। হাটহাজারী উপজেলার মোট জনসংখ্যা ৪ লক্ষ একত্রিশ হাজার সাতশ ৪৮ জন। এ জনগোষ্ঠীর প্রধান আয়ের উৎস কৃষি এবং মোট ফসলী জমি পরিমাণ ১৯ হাজার ৭৮০ হেক্টর। ধান, আলু, বেগুন, টমেটো, বাদাম, সরিষা, মিষ্টি আলু, ও নানা ধরনের শাক সবজি উৎপন্ন হয় যা তাদের খাদ্যচাহিদা পূরণ করে এবং দেশের নানা প্রান্তে বাজারজাত করে থাকে। এছাড়াও গবাদিপশু পালন, হ্যাচারি ও মৎস্য চাষে রয়েছে এ অঞ্চলের ব্যপক পরিচিতি। এ উপজেলায় রয়েছে কৃষি গবেষণা কেন্দ্র পাশাপাশি হটিকালচার সেন্টার, কৃষি ইন্সটিটিউট এবং এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। হালদা বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী, যেখান থেকে প্রতিবছর বিপুল হারে রুইজাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। হালদা নদীর পাশেই ৩,০৪৪ একর পাহাড়ি টিলা ও সমতল ভূমিতে গড়ে উঠেছে ২০০ বছরের প্রাচীন উদলিয়া চা বাগান।

শিক্ষার দিক দিয়েও এগিয়ে আছে হাটহাজারী উপজেলা। এ অঞ্চলে শিক্ষার হার ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এখানেই রয়েছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; যা প্রকৃতি আর মানব প্রাণের মেলবন্ধন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের আনাগোনা ঘটে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। রয়েছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও প্রাচীনতম কওমি মাদ্রাসা আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা বা হাটহাজারী মাদ্রাসা। এছাড়াও হাটহাজারীতে রয়েছে সর্বমোট ৭ টি কলেজ, ৫২ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৫৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৯ টিরও বেশী কিন্ডারগার্টেন, ১৭ টি মাদ্রাসা এবং ২০টি এতিমখানা।

শিক্ষানুরাগ এ হাটহাজারী উপজেলা সংস্কৃতিতেও অনন্য। ১৯৮০ খ্রিঃ পর্যন্ত হাটহাজারীতে গরুর লড়াই চালু ছিল। এ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে মাঘ ফাল্গুন থেকে চৈত্র বৈশাখ মাস পর্যন্ত গরুর লড়াইয়ের মেলা বসত। তখন এ অঞ্চলে ছিলো বর্তমান বিলুপ্তপ্রায় সনাতন পালকি, গরুর গাড়ি ও ঘোড়ার গাড়ি। এছাড়াও হাঠহাজারী মৃৎশিল্পের জন্য বহুল সমাদৃত ছিল। কুমারগণ মাটির তৈরী পানির কলস, সরা, মাটির হাড়ি, পাতিল, ইত্যাদি তৈরি ও বিক্রি করতো। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এ অঞ্চলে কুমারদের মৃৎশিল্প এখন প্রায় বিলুপ্ত।

বর্তমানে হাটহাজারী উপজেলার রাস্তা-ঘাট আগের থেকে ব্যপকহারে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এ উপজেলা দিয়েই বয়ে গেছে প্রধান ২ টি মহাসড়ক যথাক্রমে চট্রগ্রাম- রাঙ্গামাটি মহাসড়ক এবং চট্রগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক। এছাড়াও এ উপজেলায় ১৪৫ কিলোমিটার পাকারাস্তা, ৫৪৩ কিলোমিটার কাঁচারাস্তা, ৩১ কিলোমিটার রেলপথ ও ১৪ নটিক্যাল মাইল নৌপথ রয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও হয়েছে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। এ উপজেলায় রয়েছে ১টি হাসপাতাল, ১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপে­ক্স, ৫টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমিউনিটি সেন্টার, ৮টি পরিবার স্বাস্থ্য কল্যাণ কেন্দ্র, ১টি মাতৃকল্যাণ কেন্দ্র ও ২৩টি ক্লিনিক।

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।