Dakkhin Rangunia thana

পাহাড় ও নদীর এক প্রাকৃতিক মেলবন্ধনে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিনাংশে অবস্থিত একটি বিশেষ অঞ্চল দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানা। একপাশে সাপের মতো আঁকাবাঁকা কলকল পানির ধ্বনিতে মুখরিত কর্ণফুলী নদী, অপরপাশে উঁচুনিচু গভীর বনাঞ্চল বেষ্টিত পাহাড় যেন এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যে আধার এই দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া।

দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া অঞ্চলটি ২০১৯ এর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রাঙ্গুনিয়া মডেল থানার অধীনে ছিলো। তবে দক্ষিনের এ অংশটি কর্ণফুলী নদীদ্বারা বিভক্ত থাকায়, থানাবাসীকে সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক বিঘ্নতা পরিলক্ষিত হতো। এছাড়াও অপরাধীরা এখানকার পাহাড়ি এলাকায় খুব সহজেই গা ঢাকা দিতে পারতো। স্থানীয়দের দাবি এবং প্রয়োজনীয়তা আমলে নিয়ে ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি (নিকার) রাঙ্গুনিয়া মডেল থানাকে বিভক্ত করে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানা নামে নতুন থানা গঠন করার প্রস্তাব অনুমোদন দেয়। এ কারনে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার আওতাধীন রাঙ্গুনিয়া মডেল থানাকে বিভক্ত করে দুটি থানা যথাক্রমে রাঙ্গুনিয়া মডেল থানা এবং কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণাঞ্চল কে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানায় নামকরণ করা হয়। বর্তমানে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানাটি একটি অস্থায়ী জায়গায় তার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

 

 

চট্রগ্রাম জেলা সদর থেকে প্রায় ৪৩ কিলোমিটার দূরে নদী ও পাহাড়ের সংমিশ্রণে গড়ে উঠা প্রাচীন জনপদ রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত একটি প্রশাসনিক থানা অঞ্চল দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানা। চারটি ইউনিয়ন যথাক্রমে পদুয়া, শিলক, সরফভাটা ও কোদালা। তন্মধ্যে, শিলক এবং কোদালা ইউনিয়ন দুটি কর্ণফুলী নদীবিধৌত অঞ্চল। সরফভাটা ইউনিয়নটি নদী এবং পাহাড়ের সংমিশ্রনে গঠিত এবং পদুয়া ইউনিয়নটি আংশিক পাহাড়ী অঞ্চল। ইতিহাস ঘেটে জানা যায় ১৯৬২ সালের আগে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চল পটিয়া থানার অধীনে ছিলো। অতঃপর ১৯৬২ সালের ২৪ জানুয়ারি, এ অঞ্চল রাঙ্গুনিয়া থানার অধীনে কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালের দিকে শিলক ইউনিয়নকে বিভক্ত করে কোদালা ইউনিয়ন গঠন করা হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির বৈঠকে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ের অঞ্চলের সামাজিক নিরাপত্তা ও আইনি সেবা সুগম করার লক্ষে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। সেসময়, পোমরা উচ্চ বিদ্যালয় ও কর্ণফুলী নদীর তীরে বন বিভাগের সরফভাটার চিরিঙ্গা বন বিট কার্যালয়ে ছিলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাটি। জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধা অশোক মিত্র কারবারির নেতৃত্বে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে কোদালা চা-বাগান, শিলক, পদুয়া ও সরফভাটার পাহাড়ি এলাকায় হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিগুলো লক্ষ্য করে চতুর্দিকে অবস্থান নেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সেদিন রাতেই বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটিগুলোতে চারদিক থেকে একযোগে আক্রমণ চালান। এতে হানাদার বাহিনীর শতাধিক সৈন্য গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় এবং মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর মরদেহ কর্ণফুলী নদীতে ভাসিয়ে দেয়। আক্রমনের মুখে পাকিস্তানি অন্যান্য সৈন্যরা ১৫ ডিসেম্বর ভোরে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। অতঃপর সকালে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া শত্রুমুক্ত হয়। প্রতিবছর স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথা অকপটে স্বীকার করে বর্তমান প্রজন্ম।

স্বাধীনতার এতো বছর পর দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া এখন একটি স্বনির্ভর অঞ্চল। এ অঞ্চলের অর্থনীতি অধিকাংশই কৃষি নির্ভর। দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার কোদালা ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ মাঠে ধানের প্রচুর ফলন হয়। এছাড়াও এ অঞ্চলে আলু, বেগুন, মরিচ, টমেটো, শিম, করলা এবং বিভিন্ন প্রকারের শাকসবজির চাষ হয়ে থাকে। পাশাপাশি এ এলাকার মানুষ কর্ণফুলী নদীতে মাছ শিকার করে স্থানীয় হাট বাজারে বিক্রি করে থাকেন। এছাড়াও এ অঞ্চলে বিভিন্ন বনজ ও ফলফলাদির বাগান ও গবাদি পশু পালন করে অনেকে স্বাবলম্বী হচ্ছে। সুতরাং বলাই যায়, দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার মানুষ খুবই পরিশ্রমী ও কর্মঠ।

দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ায় রয়েছে বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান “কোদালা চা বাগান” যা কোদালা “টি এস্টেট” নামেও পরিচিত। কর্নফুলী নদীর কোলে সবুজ পাহাড় আর প্রাকৃতিক নৈসর্গ সমৃদ্ধ কোদালা চা বাগানটি দিন দিন দর্শনীয় স্থান হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এটি ১৮৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের সর্বপ্রথম চা বাগান। এলাকায় জনশ্রতি রয়েছে, ব্রিটিশরা কর্ণফুলী নদী দিয়ে আসা যাওয়ার সময় কোদালা এলাকায় বিস্তীর্ণ জায়গা দেখে চা বাগান করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। আর সেই থেকে প্রায় ৪,২০০ একর এলাকা জুড়ে কোদালা চা বাগান গড়ে উঠে। বর্তমানে উৎপাদনের দিক থেকে সারাদেশে ১৬২টি চা বাগানের মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে এই কোদালা চা বাগানটি। এখানে সকালের ঘুম ভাংতেই সারি সারি চা শ্রমিক ছুটে চলে চা পাতা আহরনে। শুধুমাত্র চা বাগান নয়, তন্মধ্যে কিছু জায়গা জুড়ে আছে রাবার বাগান। সবুজ বনায়ন ও চা পাতার গাছে ঘেরা এই কোদালা চা বাগানের অপূর্ব সৌন্দর্য যেকাউকে মুগ্ধ করবে। তাই তো চা বাগানে পাখির কিচিরমিচির শব্দ ও ব্রিটিশ বাংলোর সৌন্দর্য দেখতে প্রতি শীতেই ছুটে চলেন পর্যটকেরা।

চা বাগান ছাড়াও শিলক ইউনিয়নে রয়েছে শিলক ভ্যালি নামের একটি দর্শনীয় স্থান। শিলক রাবার ড্যামের কাছেই এ স্থানটি আজও নানা পর্যটকের অজানা। চারদিকে পাহাড়, সারি সারি বনাঞ্চলের ভিড়ে এক টুকরো উপাত্যকা। যেন সৃষ্টিকর্তার এক অপরূপ সৃষ্টি। শিলক ভ্যালির পাশেই রয়েছে প্যারাডাইস লেক। এসব পর্যটন স্থানগুলো যেমন আকৃষ্ট করছে দেশি বিদেশি পর্যটকদের, ঠিক তেমনি এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে রাখছে বিশেষ অবদান।

দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানা অঞ্চল ঘেঁষে রয়েছে ৭টি থানার সীমানা। থানাটি পাহাড়ী অঞ্চল হওয়ায় অভ্যন্তরীন যোগাযোগ তথা প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রাম এলাকাগুলো দুর্গম হওয়ার কারণে এ জনপদের মানুষের পুলিশী সেবা পেতে বেশ বেগ পেতে হয়। ফলে, প্রায়শই চুরি, ছিনতাই সহ মাদক চোরাকারবারির মতো নানাবিধ অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। বর্তমানে চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক নূরে আলম মীনার তত্তাবধানে ও পুলিশ সুপার এস এম শফিল্লাহ’র নির্দেশনায় অফিসার ইন চার্জ মির্জা মোহাম্মদ হাছান এর নেতৃত্বে ৪ টি বিট এলাকায় ৪ জন এসআই এবং ৫ জন এএসআই সহ সর্বমোট ৫০ জন পুলিশ কর্মকর্তা কাজ করে যাচ্ছেন। থানা অঞ্চলের প্রতিটি দুর্গম জায়গায় সেবা প্রদানের লক্ষে প্রতিটি বিটে ১জন এসআই এবং ১ এএসআই সহ পুলিশ সদস্যরা বিভক্ত হয়ে বিট পুলিশিং সেবা প্রদান করে আসছে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।