Patiya Thana

মুরারি খালে বয়ে চলা কলকল পানির ধ্বনি, দু ধারে সবুজ বৃক্ষরাজি, এবং প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে ভরপুর জনপদটির নাম পটিয়া। কর্ণফুলী নদীর বুকে থরে থরে সাজানো জাহাজ ও  উঁচুনিচু পাহাড় যেন পটিয়া থানার সৌন্দর্য ও মাধুর্যে সাজানো রূপবৈচিত্রের আঁধার।

পটিয়া নামের নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা কল্পকাহিনী। তবে, লোকমুখ থেকে শোনা যায় আগে তৎকালীন সময়ে পটিয়ায় বহুসংখ্যক তাঁতির বসবাস ছিলো, এবং তারা কাপড় বুনন, হস্তশিল্পে অনেক পটু ছিলো। সেই পটু থেকে পটুয়া এবং সে থেকে এ অঞ্চলকে পটিয়া নামেই ডাকা হয়।

পটিয়ার প্রাচীন ইতিহাসও বেশ সমৃদ্ধ। ব্রিটিশ শাসনের আগে এ অঞ্চল আরাকান আমলে চক্রশালা, মোগল আমলে চক্রশালা পরগণা এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে চাকলা নামে পরিচিত ছিল। তবে উনিশ শতকের শেষ দিকে, পটিয়াকে ভেঙে ১৮৯৮ সালে আনোয়ারা, ১৯৩০ সালে বোয়ালখালী ও ১৯৭৬ সালে চন্দনাইশ থানা গঠিত হয়। তন্মধ্যে পাকিস্তান আমলে ১৯৫৮ সালে পটিয়া মহকুমা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সর্বশেষ, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষে ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পটিয়া উপজেলা হিসাবে স্বীকৃতি পায়।

ঢাকা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার এবং চট্রগ্রাম জেলা সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি প্রশাসনিক জনপদ পটিয়া। প্রাচীনকাল থেকেই বহুল সমাদৃত এ অঞ্চলটি চট্রগ্রাম জেলার তৃতীয় বৃহত্তম শহরাঞ্চল। তাই, চট্রগ্রাম নগর মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী পটিয়াকে চট্রগ্রামের স্যাটেলাইট টাউন হিসেবে গন্য করা হয়। পটিয়া থানার পূর্বে চন্দনাইশ ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলা, পশ্চিমে কর্ণফুলী উপজেলা, উত্তরে বোয়ালখালী উপজেলা এবং দক্ষিণে চন্দনাইশ এবং আনোয়ারা উপজেলা অবস্থিত।

 

 

পটিয়া উপজেলার মোট আয়তন ২১১ দশমিক আট পাঁচ বর্গ কিলোমিটার এবং মোট জনসংখ্যা ৪ লক্ষাধিক। পটিয়া উপজেলা ১ টি পৌরসভা, ১৭ টি ইউনিয়ন, ১২৭টি মৌজা এবং ১২৪টি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত। ইউনিয়নগুলো যথাক্রমে, কোলাগাঁও, হাবিলাসদ্বীপ, কুসুমপুরা, জিরি, কাশিয়াইশ, আশিয়া, জঙ্গলখাইন, বড়লিয়া, ধলঘাট, কেলিশহর, হাইদগাঁও, দক্ষিণ ভূর্ষি, ভাটিখাইন, ছনহরা, কচুয়াই, খরনা ও শোভনদন্ডী। তন্মধ্যে কোলাগাঁও ইউনিয়নের প্রশাসনিক কার্যক্রম কর্ণফুলী থানার আওতাধীন এবং বাকি ১৬টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা পটিয়া থানার আওতাধীন।

১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে পটিয়া। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের পরই পটিয়ার সর্বস্তরের মুক্তিকামী জনগন স্বাধীনতা লাভের নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠে। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা ভারতে গিয়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। পটিয়াবাসীর মুক্তিযুদ্ধে দুর্ভেদ্য অবস্থান বুঝতে পেরে প্রথমদিকেই পাকিস্তানী বিমানবাহিনী ১৪ এপ্রিল পটিয়া সদরে ব্যপক বোমাবর্ষণ করে এবং প্রায় অর্ধশতাধিক লোক শহীদ হন। যুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানী বাহিনীর এই বর্বরতা পটিয়াবাসীকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রেরণা জোগায়। পটিয়ার মুক্তিযুদ্ধে মিলিটারী পুলের সম্মুখ যুদ্ধের কথা মনে হলে আজও গা শিউরে উঠে। ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বরে সংঘটিত এ যুদ্ধে, পাক হানাদার বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রের মুখে না পেরে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। যুদ্ধের পর ক্রোধান্বিত হয়ে হাবিলাস দ্বীপ গ্রামের শত শত ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। পটিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ বর্বরতা ও হত্যাকান্ড বেদনার স্মৃতি হিসেবে আজীবন গেঁথে থাকবে মানুষের হৃদয়ে।

চট্রগ্রাম শহরের অদূরে পটিয়া থানাটি এখন একটি সমৃদ্ধ জনপদ। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে পটিয়াবাসী। উপজেলা জুড়ে বিভিন্ন শিল্পকারখানা সৃষ্টি হওয়ায় পটিয়া ক্রমশ বানিজ্যিক নগরী হয়ে উঠছে। কর্ণফুলী নদীতীরে গড়ে উঠেছে ছোট বড় জাহাজ নির্মাণ কারখানা ও শিকলবাহায় গড়ে উঠেছে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। পটিয়ার কচুয়াই ইউনিয়নের পাশেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা – বিসিক শিল্প নগরী। এছাড়া উপজেলার পশ্চিমে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্টিলমিল, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, ও টেক্সটাইল মিলসহ নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান। তবে, এ জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষের আয়ের উৎস কৃষি। জমি উর্বর থাকায় এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ ধান,পাট, আলু, আদা, পান এবং নানা ধরনের শাকসবজি উৎপন্ন হয়। মৎস্য চাষ ও  পশুপালনেও রয়েছে পটিয়ার সুখ্যাতি। প্রায় ১৫ টি মৎস্য খামার, ৭৫টি গবাদিপশুর খামার, ১২৫টিরও বেশি নার্সারি এবং নয় শতাধিক হাঁস-মুরগির খামার রয়েছে এ অঞ্চলে। নানা ধরনের কৃষিজ পন্য নিয়ে থানাহাট, সফর আলি মুন্সির হাট, মুন্সেফ বাজার সহ ৪৫টিরও বেশী হাটবাজার বসে। এছাড়াও ব্যবসা, চাকরি, রেমিটেন্স, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে পটিয়া থানার মানুষজন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।

কৃতী সন্তানদের জন্মভূমি পটিয়া। দেশবরেণ্য উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ জন্মগ্রহন করেছেন এ অঞ্চলে। পটিয়াতেই জন্মগ্রহন করেন ব্যান্ডসংগীতের কিংবদন্তি, বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ট সংগীত শিল্পী রুপালী গীটারের যাদুকর আইয়ুব বাচ্চু। জন্মগ্রহন করেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তারই বীরত্বের স্মরনে স্থাপিত হয়েছে বীরকন্যা প্রীতিলতা সাংস্কৃতিক ভবন এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আবক্ষ মূর্তি।

স্বাস্থখাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে পটিয়া উপজেলার। রয়েছে একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ১৫টি পরিবার কল্যান কেন্দ্র, ৭ টি ইউনিয়নে স্বাস্থ্য ক্লিনিক, একটি মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্র। রয়েছে সড়ক ভবন, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন ও বন বিভাগ রেঞ্জ এর কার্যালয় সহ উপজেলা ভিত্তিক নানা সরকারী দাপ্তরিক প্রতিষ্ঠান। পটিয়ার কর্ণফুলী নদী তীরবর্তী এলাকায় গড়ে উঠছে শিল্পপ্রতিষ্ঠান।

শিক্ষাখাতে এগিয়ে যাচ্ছে পটিয়াবাসী। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ অঞ্চলে শিক্ষার হার ৫৬ দশমিক এক চার শতাংশ। পটিয়া উপজেলায় ৭টি কলেজ, ৪৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ১৭৯ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিভিন্ন মাদ্রাসা সহ তিন শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ।

পটিয়া থানা অঞ্চল একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপদ। তবে, অসাম্প্রদায়িক এ অঞ্চলটিতে হিন্দু,মুসলিম,বুদ্ধ ও খ্রিস্টান সকলে মিলে মিশে বসবাস করেন। ধর্মীয় উপাসনার জন্য রয়েছে প্রায় ৪৮৬ টি মসজিদ, ৩৭টি মন্দির, ২২টি বিহার ও ২টি গির্জা।

পটিয়া থানা অঞ্চল চট্রগ্রাম জেলা শহরের নিকটবর্তী হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। এ উপজেলা দিয়েই বয়ে গেছে চট্রগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। তাছাড়াও চট্রগ্রাম জেলা শহরের সাথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগে নির্মিত হয়েছে শাহ আমানত সেতু যা থানার এলাকার শিল্প উন্নয়নের পথ আরও সুগম করে তুলেছে। পটিয়া থানার মধ্যভাগ দিয়ে বয়ে যাওয়া মুরারী খালের উপর নতুন করে নির্মিত হয়েছে কালারপুল সেতু যা যোগাযোগ খাতে পটিয়াবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পটিয়ায় সর্বমোট ২৬ কিলোমিটার হাইওয়ে, ৪১৮ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৬৭৩ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা এবং একটি রেল স্টেশন সহ ১৬ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।