Mirsharai Thana

বৃহত্তর চট্রগ্রামের প্রবেশদ্বার খ্যাত এক নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের লীলাভূমি মিরসরাই। মায়াময় সবুজে ঘেরা পাহাড়, পাহাড়ের বুক চিড়ে শিতল ঝর্নার রিনিঝিনি ছন্দ, আবার সাগর ও নদীর মোহনায় নয়নাভিরাম দৃশ্য, যেন মায়াময় প্রকৃতির রুপকথার আদলে সাজানো একটি জনপদ।

মিরসরাই এর নামকরনে রয়েছে এক বিস্তর ইতিহাস। জানা যায়, শের শাহ্‌র আমলে সমগ্র ভারতবর্ষে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, ডাক বিভাগ ও সরাইখানা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সাম্রাজ্যের সার্বিক খোঁজখবর নেয়া, দ্রুত সংবাদ আদানপ্রদান ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দৃঢ় করতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে সরাইখানা নির্মাণ করা হতো। তৎকালীন সময়ে মীর নামের এক ব্যক্তি ইসলামাবাদের উত্তর পশ্চিমাংশে নির্মিত সরাইখানার পরিচালক ছিলেন। সেই মীরসাহেবের নামে মীর কা সরাই এবং যা পরবর্তীকালে মীরসরাই নামে উপনীত হয়েছে।

 

 

ঢাকা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং চট্রগ্রাম জেলা শহর হতে প্রায় ৬০ কিলোমিটার উত্তরে অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা একটি প্রাচীন প্রশাসনিক অঞ্চল মিরসরাই। মিরসরাই উপজেলা মোট ২টি পৌরসভা, ২ টি থানা এবং ১৬ টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। উপজেলাটি বারৈয়ারহাট পৌরসভা ও মিরসরাই পৌরসভায় বিভক্ত হয়ে দুটি থানা অর্থাৎ জোরারগঞ্জ ও মিরসরাই থানায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে । তন্মধ্যে মিরসরাই থানাটি মিরসরাই পৌরসভা ও ৮ টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত। ইউনিয়নসমূহ হলো, মীরসরাই, মিঠানালা, মঘাদিয়া, খৈয়াছড়া, মায়ানী, হাইতকান্দি, ওয়াহেদপুর ও সাহেরখালী ইউনিয়ন। মিরসরাই থানা এলাকার পূর্বে সুউচ্চ পাহাড় পর্বতমালা বেষ্টিত ঘন সবুজ বনভূমি, পশ্চিমে ফেনী নদী ঘেরা বিস্তৃত চরাঞ্চল, উত্তরে ফেনী জেলা এবং দক্ষিণে চট্রগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলা অবস্থিত।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মিরসরাইয়ের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভুমিকা। পাক হানাদারদের চট্রগ্রাম অঞ্চলে প্রবেশের একমাত্র স্থলপথ ছিলো মিরসরাই। মুক্তিযোদ্ধারা চট্রগ্রামকে হানাদারমুক্ত রাখতে চট্রগ্রামের প্রবেশপথ শুভপুর ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়। তবে পাক সেনারা অস্থায়ী সেতু নির্মাণ করে এ অঞ্চলে ধাবিত হতে থাকে। পুরো মিরসরাই দখলের লক্ষে পাক হানাদাররা ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় ও নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। হানাদারদের ঠেকাতে, মুক্তিযোদ্ধারা ছোট-বড় বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করেন। তন্মধ্যে ১০ জুন সুফিয়া এলাকায় এবং ১৪ জুলাই আবুতোরাব বাজারে গ্রেনেড চার্জ করে বর্বর হানাদার বাহিনী। অতপর, ১৮ ও ২৩ জুলাই বড়তাকিয়াতে এবং ১১ জুলাই ফেনাপুনী ব্রীজ এলাকায় সম্মুখযুদ্ধ হয়। এছাড়াও পান্থপুকুর পাড়ে পাক পেট্রোল ধ্বংস, করেরহাট যুদ্ধসহ মিরসরাইয়ের ছোট-বড় অনেক যুদ্ধই স্মৃতি হয়ে গেঁথে আছে এ এলাকার প্রবীণদের। ১৯৭১ সালের ৮ই ডিসেম্বর মিরসরাই এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। চারদিক থেকে জয় বাংলা স্লোগান নিয়ে মিরসরাই উচ্চবিদ্যালয় মাঠে সমবেত হয় হাজারো মানুষ । মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া ৪২ জনের আত্মত্যাগের স্মৃতিকে  আজীবন স্মরণ রাখতে নির্মিত হয়েছে বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভ ।

স্বাধীনতার এতো বছর পরও, মিরসরাই এখন একটি সমৃদ্ধ জনপদ। একইসাথে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে সারাদেশে এ এলাকার খ্যাতি রয়েছে। মিরসরাই থানা অঞ্চলের মোট আয়তন ২৪১ বর্গ কিলোমিটার এবং মোট বসবাসকারী জনসংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ। জনগনের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্র এবং ছোটবড় বিভিন্ন ক্লিনিক। তাছাড়া উপজেলা ভিত্তিক বিভিন্ন সরকারি বেসরকারী দপ্তর যেমন, সাব রেজিস্টারের কার্যালয়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কার্যালয়, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন, উপজেলা পরিষদের কার্যালয় সহ বিভিন্ন আর্থিক সেবাদান প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ থানা অঞ্চলে।

শিক্ষাখাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে মিরসরাইবাসী। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ থানা অঞ্চলে শিক্ষার হার ৫৫ দশমিক এক শতাংশ। মিরসরাই থানায় ২টি কলেজ, ১৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ৫১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিভিন্ন মাদ্রাসা এবং অন্যান্য সরকারি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে ঘেরা এ জনপদটির প্রধান আয়ের উৎস কৃষি। কৃষকরা আবাদি জমিতে ধান, আলু, বেগুন সহ নানা ধরনের শাকসবজির চাষ করে থাকেন। এছাড়া আখ ও তরমুজ সহ বিভিন্ন ফলফলাদির চাষ হয়। কৃষিকাজের বাইরে এ অঞ্চলে মৎস্যচাষ, হাঁস-মুরগির খামার, গবাদিপশু পালন করে স্বাবলম্বী হচ্ছে অনেকে। তাছাড়া ও বিভিন্ন ব্যবসা, নির্মাণ ও পরিবহন খাতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে মিরসরাই থানার মানুষ।

মিরসরাই এর ইছাখালীর চরে নির্মিত হয়েছে দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল মিরসরাই ইকোনোমিক জোন। শুধু দেশের নয়, প্রায় ৩৫ হাজার একর জুড়ে এশিয়ার সবচেয়ে বড় আধুনিক ইকোনোমিক জোন নির্মিত হয়েছে এ অঞ্চলে। বাংলাদেশের বৃহত্তম এ অর্থনৈতিক অঞ্চলটিতে নানা দেশী বিদেশী কোম্পানি তাদের উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে। তাই, অর্থনৈতিক ভাবে যেমন বিপুল সম্ভাবনার দোয়ার খুলবে ঠিক তেমনি প্রায় ১৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

মিরসরাই এখন দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় একটি থানা অঞ্চল। শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি ও শিক্ষার মাধ্যমে এ অঞ্চল সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও পর্যটন শিল্পের অন্যতম ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছে মিরসরাই।

মিরসরাইতেই অবস্থিত দেশের ২য় বৃহত্তম কৃত্তিম লেক মহামায়া লেক । প্রায় ১১ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এ লেকটি দেশের অন্যতম পর্যটন স্থান। লেকের চারপাশে পাহাড়, পাখির কিচিরমিচির ও টলটলে পানির স্নিগ্ধতা, , যেন প্রকৃতির কোলে এক অবারিত সৌন্দর্য। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এসে মহামায়া লেক এ কায়াকিং করে উপভোগ করে এর নান্দনিক রূপ। মহামায়া লেকের খানিকটা পূর্বেই পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ঝর্নার শীতল পানির ছোঁয়া এক অন্যরকম অনুভূতি এনে দেয় পর্যটকদের।

মিরসরাইয়ের পাহাড়ি এলাকায় রয়েছে অসংখ্য জলপ্রপাত। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও সুন্দরতম ঝর্ণা খৈয়াছড়া ঝর্ণা এখানেই অবস্থিত। আরো রয়েছে নাপিত্তাছড়া ঝর্না, সোনাইছড়া ঝর্ণা, বাউয়াছড়া সেচ প্রকল্প, সাহেরখালী ইউনিয়নের উপকূলীয় বনাঞ্চল, মঘাদিয়া জমিদার বাড়ি সহ  অসংখ্য পর্যটন কেন্দ্র।

যোগাযোগের দিক দিয়ে মিরসরাই থানা অঞ্চল বেশ এগিয়ে। চট্রগ্রামের প্রবেশপথ মিরসরাই এর বুক চিরে বয়ে গেছে ঢাকা চট্রগ্রাম মহাসড়ক এবং ঢাকা চট্রগ্রাম রেলপথ । তাছাড়াও, এ অঞ্চলে পাকা রাস্তা, আধাপাকা রাস্তা, নৌপথ সব দিকেই যোগাযোগের সুব্যবস্থা থাকায় ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে।

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।