received 752356952467681
অবসরে সময়ে শিক্ষার্থীরা যেখানে আড্ডা আর গল্পগুজবে কাটিয়ে দেয় সময়, ঠিক সে সময়টা কাজে লাগিয়ে অনন্য এক কীর্তি গড়লেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (১৪-১৫ ব্যাচ) ফলিত গণিত বিভাগ থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর করা জারিন তাসনিম দিয়া৷ বছর দুয়েক আগে করোনা মহামারীর কারণে যখন বন্ধ হয়ে যায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। লক ডাউনে ঘরবন্দী হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। করোনার লক ডাউনের অবসর সে সময়টি কাজে লাগাতে এবং ধর্মের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা থেকে পবিত্র কুরআন শরিফ হাতে লিখতে শুরু করেন জারিন তাসনিম দিয়া। অল্প কিছুদিন বাদে এক পারা লেখার পর তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, ভাবলেন এতো পৃষ্ঠা লেখে উঠে সম্ভবপর হয়ে উঠবে না; পরবর্তীতে বাবা’র অনুপ্রেরণায় আবার লিখতে শুরু করেন দিয়া। অবশেষে প্রায় দেড় বছরে পবিত্র কুরআন ১১৪টি সূরা লেখা সম্পন্ন করে হাফেজ দ্বারা বানান যাচাই-বাছাইয়ের পর বাঁধাই করে পূর্ণাঙ্গ কুরআন আকারে প্রকাশ করেন। তার হাতের লেখা এতোই চমৎকার হয়েছে যে, প্রথম দেখায় যে-কেউ ভাববেন কম্পিউটারে টাইপ করা।
দিয়ার গ্রামের বাড়ি জামালপুর জেলার সদর উপজেলায়। বাবা সুলতানুল আলম একজন অবসর প্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। যার অনুপ্রেরণা ও উৎসাহেই দিয়া কুরআন লিখতে শুরু করেন। এমন অনন্য কাজ শুরু করা নিয়ে দিয়া বলেন, ‘করোনায় লক ডাউনে যখন ঘরবন্দি হয়ে গেলাম, তখন ভাবলাম কিছু একটা করে অবসর সময়টা পার করি। তখন মাথায় আসল শুরু থেকে একটু একটু করে কুরআন লিখি। আমি যে শেষ করতে পারব এই উদ্দেশ্যে শুরু করিনি। তবে সিরিয়াল ধরে লিখে গেছি, ভাবছি যতটুকু পারি করি। প্রথম একপারা লেখার পর আগ্রহ হারিয়ে ফেলি, ভাবছি আর লেখা সম্ভব না। কিন্তু বাবার উৎসাহে আবার শুরু করলাম। বাবা বলতেন, তুমি চেষ্টা করে যাও, তোমাকে তো আজকেই পুরোটা শেষ করতে হবে এমন নয়, একটু একটু করে লিখো। যতদিন লাগে শেষ হতে, লাগুক। তখন তো লকডাউনে বাইরে যাওয়া হয় না, বসে বসে প্রতিদিন লিখতে থাকি। বলা যায়, এটার প্রতি এক প্রকার নেশা হয়ে গিয়েছিল। আর সবচেয়ে বড়ো অনুপ্রেরণা ছিলো, আমাদের ঘরে হাতে লেখা আয়াতুল কুরসির একটা ওয়ালমার্ট টাঙানো ছিলো, ঐটা দেখেই বাবা-বা অনুপ্রাণিত করতো পুরো কুরআন লেখার।’
দিয়া আরো জানান, ত্রিশ পারা কুরআন লেখাকালিন এই দেড়বছর সময় সব সময় লেখার সরঞ্জাম কাছে রেখেছেন; যাতে লেখা বন্ধ না থাকে। যখনি গ্রামের বাড়ি গেছেন, তখনো সাথে খাতা-কলম-পেন্সিল—সব সাথে করে নিয়ে গেছেন। প্রতিদিন কয়েক পৃষ্ঠা করে লিখে গেছেন। এভাবে দেড় বছর প্রচেষ্টার পর তিনি সম্পূর্ণ কুরআন হাতে লিখতে সক্ষম হন।
দিয়ার লেখা পবিত্র কুরআনের এই পান্ডুলিপি বানান ভুল ত্রুটি যাচাই-বাছাই করার জন্য পর্যায়ক্রমে ত্রিশজন হাফেজকে দিয়ে পাঠ করা হয়েছে এবং হাফেজদের যাচাই-বাছাই শেষে মাদ্রাসার শিক্ষক দ্বারা সম্পাদনা শেষে লেখাগুলো স্ক্যান করে কাগজে বাঁধাই করে পূর্ণাঙ্গ কুরআন আকারে প্রকাশ করা হয়। বানান ভুল ত্রুটি যাচাই-বাছাইকারীদের মধ্যে একজন মাওলানা মাহমুদুল হাসান জালিস। দিয়ার এমন অনন্য কীর্তি প্রসঙ্গে তিনি জানান,‘ আমি তার লেখা কোরআন পুরোটা একাধিকবার পড়েছি। শুরুতে জবর জের পেশের অসংখ্য ভুল ছিল। কারণ; তিনি আরবি ভাষা জানেন না। আরবি সম্পর্কে তার তেমন অভিজ্ঞতাও ছিল না। আমি পড়ে ভুলগুলো পেন্সিল দিয়ে মার্ক করে দেই। তিনি সেগুলো রাবার দিয়ে মুছে ফ্রুট কালির সাহায্যে ঠিক করেন। এভাবে বারবার পড়ে অনেক হাফেজগণ মিলে ভুলগুলো সংশোধন করা হয়। তারপরও মানুষের ভুলের উর্ধ্বে নয়। এতো চেষ্টার পরেও যদি কোনো স্থানে জবর জের পেশ অথবা নুকতার উপর নিচের মিসিং থেকে থাকে তাহলে সেগুলো নজরে এনে দ্রুত ঠিক করে দেওয়া হবে ইনশাআল্লাহ। তার এমন বিস্ময়কর কাজ দেখে আমরা আনন্দিত। তার লেখাও খুবি চমৎকার হয়েছে।’
শিক্ষাজীবনে কখনো মাদ্রাসায় পড়েননি দিয়া। তিনি বলেন, ‘আমি ছোট থেকে ইসলামি পরিবেশে বড় হয়ে উঠিনি। আমি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। আট-দশজন সাধারণ মানুষের মতোই বেড়ে উঠা। আমি এই কাজটি করতে গিয়ে নতুন করে ইসলাম সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি, বুঝেছি অর্থসহ কুরআন খতম করেছি। ইনশাআল্লাহ, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব ইসলামের বিধিনিষেধ মেনে বাকি জীবন কাটাতে। এই কাজ করতে গিয়ে কী পরিমাণ মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, তা হয়ত বলে বুঝানো যাবে না। ’
দিয়ার লেখা এই পবিত্র কুরআন ৫০০ কপি প্রিন্ট করে বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসায় উপহার দিতে চান তিনি। এই নিয়ে তিনি বলেন, ‘লেখার পর যাচাই-বাছাই শেষে প্রথমে আমি এক কপি প্রিন্ট করি। তারপর আরও কয়েক কপি করি, আমার মা-বাবার হাতেও তুলে দিই; যেটি আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। এখন আমার ইচ্ছে এই কুরআনের ৫০০ কপি প্রিন্ট করে মসজিদ-মাদ্রাসায় বিতরণ করা। যাতে মানুষ পাঠ করলে আমারও সওয়ার হয়।’
আমরা জানি, প্রায় সাড়ে ১৪শ’ বছর আগে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ওপর কোরআন নাজিল হওয়ার পর এভাবেই সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন উপাদানে হাতে লিখে পবিত্র বাণী সংরক্ষণ করতেন।
error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।