jpg

ক্ষেতলাল উপজেলার ইতিহাস

মাটির দেশ, মাটির গ্রাম, মাটিই আমার ঘর, এই ঘরেতেই থাকে আমার মাটির দেহের প্রাণ।

বর্তমান সময়ের সব আলীশান অট্টালিকার ভিড়ে যদি দেখা মেলে একটি গ্রাম, যার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে মাটির ঘ্রাণ। তবে কতই না ভালো লাগবে। এসব চিত্রায়ন দেখে এক মুহুর্তে আপনি ভেবে নিতে পারেন এটি হয়তো বহুকাল আগের কোন জনপদ।

এর প্রকৃতিগুলো মুগ্ধ করবে আপনার প্রথম পদচারণেই। এইতো কয়দিন আগে কৃষকেরা ফসল কেটে ঘরে তুলেছে। মাঠে পড়ে আছে ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত সেই প্রাচীন সেচ যন্ত্রটি। এই সেচ যন্ত্রটি গ্রামীণ জনপদের মানুষের নিকট পরিচিত মাধ্যম হলেও অনেককেই হয়তো বিস্মিত করবে। শত শত একর বিস্তৃত জমিগুলোর মাঝ দিয়ে থাকে একটি জল প্রবাহিত খাল বা নদী। এই নদী থেকে কৃষকেরা তালগাছের গুড়ি থেকে নির্মিত সেচ যন্ত্রটি দিয়ে তাদের জমিন সেচ দিয়ে থাকে। কালের প্রবাহে প্রাচীন এ মাধ্যমটি বিলিন হলেও এর যথার্থ ব্যবহার এখনো রয়েছে জয়পুরহাট জেলার দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম প্রশাসনিক অঞ্চল ক্ষেতলাল উপজেলায়।

ক্ষেতলাল উপজেলার আয়তন, জনপদ এবং বর্তমান অবস্থা

শীতের সকালের ঘোমটা পড়া এ ভূখন্ডের নামই ক্ষেতলাল। ঐতিহাসিক যুগে এর নাম ছিলো কসবা। সময়ের ঘূর্ণয়ন ও অঞ্চলের বিশেষত্বের উপর গুরত্ব দিয়ে এক সময় কসবা অঞ্চলটি ক্ষেতলাল নামে পরিবর্তিত হয়। ১৮৭৪ সালের ৭ ডিসেম্বর অত্র ক্ষেতলাল অঞ্চলে একটি থানা স্থাপন করা হয়। যদিও আরেকটি সূত্রে বলা হয়েছে যে, ১৭৯৩ সালে ক্ষেতলাল অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার একটি থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। পরে অঞ্চলটি বগুড়া জেলার অধীন জয়পুরহাট মহকুমার একটি থানা ছিলো এবং পার্শবর্তী কালাই অঞ্চলটি এই থানারই অংশ ছিলো। কিন্তু একটি থানা ভবন ও একটি প্রাণী সম্পদ হাসপাতাল ব্যাতিত সকল সরকারী অফিসসমুহের অবস্থান ছিলো কালাই অঞ্চল সীমানাধীন। তাই তৎকালীন কালাই অঞ্চলের মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে দেশে উপজেলা পদ্ধতি চালুর সময় অত্র ক্ষেতলাল থানা অঞ্চলকে ২ ভাগে বিভক্ত করে কালাই নামে আরেকটি নতুন থানার সৃষ্টি হয়। পরে ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে ক্ষেতলাল থানাটি উপজেলার মর্যাদায় আত্মপ্রকাশ করে। পূর্বে ক্ষেতলাল উপজেলার মোট আয়তন ছিলো ৩০৮.৯ বর্গ কি.মি.।  কিন্তু উপজেলাকে ২ ভাগে বিভক্ত করার ফলে এর বর্তমানে আয়তন দাড়ায় মাত্র ১৪২.৬০ বর্গ কি.মি।

ক্ষেতলাল উপজেলা জয়পুরহাট ২ নির্বাচনী এলাকার অন্তর্ভুক্ত। মোট ইউনিয়ন সংখ্যা ৫টি এবং গ্রামের সংখ্যা ১৭০টি। উল্লেখ্য, ক্ষেতলাল উপজেলার সদর ইউনিয়নকে বিলুপ্ত করে ২০১০ সালে ৯টি ওয়ার্ডের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্ষেতলাল পৌরসভা।

১টি পৌর অঞ্চল ও ৫টি ইউনিয়ন মিলিয়ে উপজেলাতে বর্তমানে বাস করে প্রায় ১ লক্ষ ২০জন মানুষ। তন্মধ্যে ভোটাধিকার জনবলের সংখ্যা মোট ৯২,৩৯১ জন।

এ উপজেলার প্রধান জনগোষ্টির মধ্যে রয়েছে মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়। উপজেলা জুড়ে তাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত রয়েছে প্রায় চারশত মসজিদ ও ৪৩টি মন্দির। অঞ্চলটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় বর্তমান সরকার এ উপজেলাতেও নির্মাণ করেছে একটি মডেল মসজিদ। সম্পূর্ণ উন্মুক্ত পরিবেশের অন্তরায় উপজেলায় আঞ্চলিক সড়কের কোল ঘেষে নির্মিত হয়েছে এ মসজিদটি।

স্থানীয়দের মতে ক্ষেতলাল উপজেলা সম্পূর্নই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গামুক্ত একটি জনপদ। এ জনপদের রাজনৈতিক ময়দানেও তেমন কোন কলঙ্ক নেই। তবে কতিপয় কিছু লোভী ব্যক্তিদের কারণে এ অঞ্চলে বেশকিছু অসঙ্গতির জন্ম হয়। জানা যায়, উপজেলার ইটাখোলা উচ্চবিদ্যালয়ের নতুন একটি একাডেমিক ভবনের নির্মাণকাজ দেড় বছর ধরে বন্ধ আছে। শিক্ষকেরা বলেন, কাজ বন্ধ করে ঠিকাদার চলে গেছেন। এদিকে কাজের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে।

অন্যদিকে মৃত্যুর ১১ বছর পর ‘জীবিত হয়ে’ ঋণ নেওয়ার খবর তোলপাড় হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। একটি ব্যাংকের নথি বলছে, মৃত্যুর ১১ বছর পর পরেশ চন্দ্র আবার জীবিত হয়েছিলেন। তিনি জীবিত হয়ে নিজের বাড়িতে যাননি। পরিবারের সদস্য কিংবা গ্রামের মানুষও তাঁকে দেখেননি। পরেশ চন্দ্র শুধু গিয়েছিলেন উক্ত ব্যাংকে। ওই দিন তিনি ঋণ ডকুমেন্টে স্বাক্ষর করে ১০ হাজার টাকা ঋণও গ্রহণ করেছিলেন।

স্থানীয়রা জানান ঐসব লোভী কতিপয় ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী ছাড়া ক্ষেতলাল উপজেলার মানুষ নিঃসন্দেহে জয়পুরহাট জেলার আদর্শ নাগরিক। কারণ এ জনপদের রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহাসিক গৌরব। যুগের পর যুগ ক্ষেতলালের মানুষ সেইসব গৌরবকেই তাদের অন্তরে ধারণ করতে চায়। ক্ষেতলাল উপজেলার বড়াইল ইউনিয়নের হিন্দা গ্রামে অবস্থিত রয়েছে প্রাচীন ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের ছোয়ায় নির্মিত হিন্দা-কসবা শাহী জামে মসজিদ।

১৩৬৫ বঙ্গাব্দে বাগমারী পীর হিসাবে পরিচিত চিশতিয়া তরিকার অন্যতম পীর হযরত আব্দুল গফুর চিশতী রহমতুল্লাহের নির্দেশে মাওলানা আব্দুল খালেক চিশতির তত্ত্বাবধানে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। মসজিদটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর অবকাঠামো। এই মসজিদের বাইরের আস্তরণে কাঁচ ও চিনামাটির টুকরার সমন্বয়ে বিভিন্ন নকশা থাকায় সূর্যের আলো পড়তেই ঝলমলে ও নজরকাড়া রূপে জেগে ওঠে। মসজিদের কক্ষের দৈর্ঘ্য ৪৯.৫০ ফুট ও প্রস্থ ২২.৫০ ফুট। মাঝের ১টি বড় গম্বুজ ও চারপাশের ৪টি ছোট গম্বুজ রড ছাড়াই তৈরি হয়েছে। মসজিদের পূর্ব পাশে রয়েছে হযরত শাহ্‌ সুলতান বখতির ৪জন শিষ্যের মাজার।

১৯৭১ এর রণাঙ্গণে ক্ষেতলাল উপজেলার বীর সন্তানদের অবদান কখনোই ভুলবে না বাঙ্গালী জাতি। তাদের স্মরণে ১৭ মার্চ ২০২০ সালে উপজেলায় স্থাপিত হয়েছে উপজেলার ৫৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের নাম ফলক। তাছাড়া উপজেলা পরিষদ প্রান্তরে রয়েছে একটি বধ্যভূমি।

স্বাধীনতা পরবর্তী আশির দশক অবদি ক্ষেতলাল অঞ্চলে তেমন কোন সরকারি অবকাঠামো ছিলো না। পরে ধীরে ধীরে অবকাঠামোগত নানান উন্নয়নের জোয়ার ঘটে। বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রায় সকল দপ্তরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ব্যাংক, বীমা, এনজিও, ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশন, ভূমি অফিস, কৃষি অফিসসহ উপজেলার মানুষের প্রয়োজনীয় প্রায় সব কিছুই গড়ে উঠেছে এ নগরে। রয়েছে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বেশ কিছু উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়।

উপজেলার শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে রয়েছে সর্বমোট ৫টি মহাবিদ্যালয়, ৪৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৩৬টি বিভিন্ন বিভাগীয় মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

ক্ষেতলাল উপজেলায় উন্নয়ন অতীব জরুরী

ক্ষেতলাল উপজেলার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস কৃষি। তন্মধ্যে ধান, শরিষা ও আলু উপজেলার প্রধান অর্থকরী ফসল। শীত মৌসুমে উপজেলার কৃষিক্ষেতগুলো আলু চাষে ভরপুর হয়ে ওঠে। সারা বাংলাদেশের প্রায় ২৫ শতাংশ আলুর চাহিদা এখান থেকে যোগান দেওয়া হয়।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো এ উপজেলার সাথে নেই কোন হাইওয়ে সংযোগ, নেই কোন রেলসংযোগ। এবং নেই কোনো ভালো বাস টার্মিনাল ও যাত্রী সেবায় ভালো মানের চেয়ার কোচ সার্ভিস।

সর্বপরি বলা যায়, ক্ষেতলাল উপজেলার অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধি কৃষিখাত ব্যতীত অন্যান্য খাতে এখনো নিম্নমুখী। তাই অঞ্চলের মানুষের চাহিদা পূরণে উপজেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা অতীব জরুরী।

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।