maxresdefault 3 jpg

গ্রাম বাংলার মানুষের ঠোটে লিপ্ত বাংলার জনপ্রিয় গান! “মাঝি বাইয়া যাও রে, অকুল দরিয়ার মাঝে আমার ভাঙ্গা নাওরে মাঝি… বাইয়া যাও রে”

মন মাতানো এ সুরের সাথে দোল খায় পদ্মার ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা। বিকেলে পরন্ত সূর্যের লাল আভা আরো মুগ্ধ করে প্রকৃতি প্রেমিদের। এ সময়টিতে নদী জুড়ে বিচরন করে কিছু জেলে বা মাছ শিকারী। তারা প্রতিদিন গভীর রাত অবধি নদীতে অবস্থান করে। কখনো পূর্নিমার আলোতে তারা ভেসে বেড়ায়, কখনো নদীর উথাল-পাথাল শব্দে কাটে অন্ধকার রাত। তারপর ভোর আগমনের পূর্বেই তারা নদী ত্যাগ করে ফিরে আসে আপন ঘরে বা ব্যবসা কেন্দ্রে। এমন সহস্র মাছ শিকারী পেশার মানুষের বসবাসরত উপজেলার নাম মুন্সীগঞ্জ সদর।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, গ্রামবাংলার প্রাচীন স্থাপনা, রাজা-বাদশা-সূফিদের চারণভূমি, পদ্মা-মেঘনা-ধলেশ্বরীর অববাহিকায় অবস্থিত, হিন্দু-মুসলিম মিশ্র সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ একটি প্রাচীন জনপদের নাম মুন্সীগঞ্জ। মুন্সীগঞ্জ থানা সদরের উত্তরে ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে প্রমত্তা পদ্মা ও শরীয়তপুর জেলা, পশ্চিমে টংগিবাড়ী এবং পূর্বে মেঘনা নদী ও গজারিয়া থানা অবস্থিত। ১৮৪৫ সালে বৃটিশ ভারতের সুবিধার্থে মুন্সীগঞ্জে থানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অঞ্চলটি মহকুমা নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ১৯৮২ সালে উপজেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। যা আজকের মুন্সীগঞ্জ সদর থানা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত

 

 

মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা প্রাচীন বাংলার গৌরবময় স্থান। যা এক সময়ের বিক্রমপুরের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলো। সে সময়ে বিক্রমপুরে একটি গ্রাম ছিল, যার পূর্বের নাম ছিল ইদ্রাকপুর। জনশ্রুতি আছে যে, মোঘল শাসন আমলে এই ইদ্রাকপুর গ্রামে মুন্সী হায়দার হোসেন নামে একব্যাক্তি বাস করতেন। তিনি মোঘল শাসকদের মাধ্যমে এ অঞ্চলের ফৌজদার নিযুক্ত ছিলেন। অত্যন্ত সজ্জ্বন ও জনহিতৈষী মুন্সী হায়দার হোসেনের নাম অনুসারে প্রাচীন ইদ্রাকপুরের নামকরণ করা হয় মুন্সীগঞ্জ।

সবুজ শস্য-শ্যামল প্রান্তর, রাশিরাশি বৃক্ষরাজি আর দূর দিগন্তে দৃষ্টির সীমানায় আকাশের নীলিমার সখ্যতা বিস্তৃত মাঠ, আধুনিক দালানকোঠা বিস্তৃত মুন্সীগঞ্জ সদর থানাটির আয়তন ১৬০.৭৯ বর্গকিলোমিটার। সদর থানাটি ১টি পৌরসভা, ৯টি ইউনিয়ন, ৯৪ টি মৌজা ও প্রায় ১৮৭টি গ্রাম নিয়ে গঠিত রয়েছে।

এ অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম পদ্মা, মেঘনা ও ধলেশ্বরী নদী। প্রাচীনকালে এ অঞ্চলের মানুষ নদী নির্ভর জীবন যাপন করলেও এখন তাদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম সড়কপথ। তবে অঞ্চলের ব্যবসায়ীগণ নদী দিয়ে ঢাকা থেকে মালামাল আনা-নেয়া করেন।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলাটি পলি ও দোআঁশ মাটি বিধৌত হওয়ায় ভূ-প্রকৃতির গঠন প্রধানত কৃষিসহায়ক। এ অঞ্চলের কৃষিই ছিল শতকরা প্রায় ৬০ জন মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম অবলম্বন। এ অঞ্চলের প্রধান ফসল হচ্ছে ধান, গম, সরিষা, আলু ও পাট। এ উপজেলার অন্যতম চালতা বা মিষ্টি পান সারাদেশের জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

অন্যদিকে উপজেলাটি বর্তমানে শিল্প উন্নয়ন সম্মৃদ্ধ একটি জনপদ। এ উপজেলায় রয়েছে বেশ কয়েকটি শিল্প-কারখানা। রয়েছে ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্পের বৃহত্তম সমাহার। সেই সাথে বাড়ছে বিভিন্ন উদ্যোক্তা তথা পশুপালন, মৎস্যচাষ, পোল্ট্রি খামারীসহ বিভিন্ন খামারী ব্যবসা।

অর্থনৈতিক দিক থেকে দেশের উন্নয়নের গতিধারায় মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলাটি সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে চলেছে উপজেলার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন। রয়েছে, প্রায় ১৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৭টি মাদ্রাসা ও শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। এবং রয়েছে সর্বমোট ৪টি মহাবিদ্যালয়। অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যঝুকি এড়াতে ও গুরুত্ব বিবেচনা করে এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট একটি আধুনিক হাসপাতাল ও প্রায় ৫০টি কমিউনিটি ক্লিনিক। রয়েছে একাধিক প্রাইভেট চিকিৎসা কেন্দ্র।

মুন্সীগঞ্জ সদর অঞ্চলটি আয়তনের দিক বিচারে অধিক ঘনবসতিপূর্ণ একটি জনপদ। ছোট এ নগরের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ। এই বৃহৎ জনগোষ্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রায় প্রধানত মুসলিম সম্প্রদায় এবং তার পরেই সনাতন ধর্মের অবস্থান। রয়েছে অন্যান্য ধর্মালম্বী কিছু মানুষের বসবাস। এ উপজেলার মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না থাকলেও রয়েছে রাজনৈতিক মতবিরোধ। এই মতবিরোধের জের ধরে প্রায়াশই ঘটে নানান বিশৃংখলা। যা নিয়মিত প্রকাশ পাচ্ছে দৈনিক জাতীয় গণমাধ্যমসহ স্থানীয় বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক গণমাধ্যমে।

মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা নদী বিধৌত হলেও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে তারা পিছিয়ে নেই । এখানে মুন্সীগঞ্জ সদরের জ্ঞান সম্পন্ন, কৃষি ও নদী বিধৌত মানুষের আবেগ-অনুভূতি বিভিন্ন তথ্য জানাতে, বাংলা সাপ্তাহিক মুন্সীগঞ্জে বাণী, সত্যপ্রকাশ, মুন্সীগঞ্জ সংবাদ, দৈনিক মুন্সীগঞ্জের কাগজসহ বেশ কিছু অনলাইন মাধ্যম,পত্রিকা-সাময়িকী, নিয়মিত-অনিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে।

মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলাটি প্রাচীন বাংলার একটি অন্যতম ঐতিহাসিক ভূ-খন্ড। এ অঞ্চলের অন্যতম ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান, ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুবাদার ও সেনাপতি মীর জুমলা কর্তৃক ইছামতি নদীর পশ্চিম তীরে নির্মিত মোগল স্থাপত্য ইদ্রাকপুর কেল্লা। যা বাংলার ইতিহাসের একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। অন্যদিকে প্রাচীনবাংলার অন্যতম স্থাপনা বিক্রমপুর বিহার উপজেলাটির আরেকটি ঐতিহাসিক স্থান। জানা যায়, আনুমানিক ৮২০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত মহারাজ ধর্মপালের শাসনামলের ৩০টি উল্লেখযোগ্য বিহারের মধ্যে অন্যতম এই বিক্রমপুর বিহার। এখান থেকে প্রায় শতাধিক মূল্যবান মূর্তি ও ভাস্কর্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। যা জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

মুন্সীগঞ্জ সদর থানায় জন্মগ্রহণ করেছেন, পণ্ডিত শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপংকর, কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, ভাষা সৈনিক আবুল ফজল, কবি গীতিকার, নাট্যকর হাসান ফকরী ও রাজনীতিবিদ সিদ্দিকুর রহমানসহ অনেকে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।