Joypurhat SP jpg

ঐতিহাসিক জয়পুরহাট

টাটকা সবজির ঘ্রাণ! ফুল, ফল, আর আমিষের মহাভান্ডার। একদিকে বিশাল অট্টালিকার শহর আরেক দিকে বিস্তৃর্ণ ফসলের মাঠ। প্রকৃতির মুগ্ধতায় পাখির কলরব আর শত পেশার লাখো মানুষের চারণভূমি । হাজার বছরের স্মৃতি ধন্য ঐতিহাসিক স্থাপনা ও বহুজাতিক মানুষের ভালোবাসায় আগলে থাকা ভূখন্ড যার নাম জয়পুরহাট। ৫টি উপজেলা শহর ও ৯৮৮টি গ্রামের সমষ্ঠিতে গড়া দেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী ঐতিহাসিক এ জেলাটির নামই জয়পুরহাট। এ জেলার অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তবে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীসহ কিছু আদিবাসী তথা সাঁওতাল, ওরাও, মুন্ডা, মাহালি, বুনা, রাজবংশী, পাহান ইত্যাদি জনগোষ্টির বসবাস রয়েছে এ জেলাতেই। নানা জাতের মানুষের বসবাসরত এ ভূমি মানচিত্রের নাম ইতিহাসের পাতায় কিভাবে জয়পুরহাট নামে লিপিবদ্ধ হলো সে খবর হয়তো অনেকেরই অজানা।

জয়পুরহাটের সকাল

আযানের ধ্বনীর মাধ্যমে আবারো আলোকিত হতে থাকে জয়পুরহাটের আকাশ। পথ-ঘাট আবারো ব্যস্ততায় ভরে ওঠে। কেউ মাঠে, কেউ ঘাটে আবার কেউবা বের হয় অজানা কোন গন্তব্যে। একটু পরেই পূর্ণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে জয়পুরহাট জেলার প্রতিটি অফিস, কল-কারখানা, বাজার-ঘাট ও কৃষি ক্ষেত। এটাই জয়পুরহাট জেলার দৈনন্দিন চিত্র।

 

 

জয়পুরহাট জেলার ইতিহাস

এ জয়পুরহাটের ভৌগলিক ইতিহাস হয়তো হাজার বছরের। তবে ইতিহাসের পাতায় জয়পুরহাটের পরিচিতি মাত্র দেড়শ বছরের। তারপূর্ব সময়ে এর নাম ছিলো গোপেন্দ্রগোঞ্জ। জানা যায়, ১৮৮৪ সালে কলকাতা হতে জলপাইগুড়ি পর্যন্ত ২৯৬ মাইল রেলপথ বসানো কাজ শেষ হলে লোকজনের উঠানামা ও মালামাল আমদানি রপ্তানির সুবিধার জন্য ৪-৭ মাইল পর পর একটি করে রেলস্টেশন স্থাপন করা হয়। সেসময় তৎকালিন তিলকপুর, আক্কেলপুর, জামালগঞ্জ এবং বাঘবাড়ীতে স্টেশন স্থাপিত হয়। বাঘবাড়ি রেলস্টেশনকে জয়পুর গভর্ণমেন্ট ক্রাউনের নাম অনুসারে রাখা হয় জয়পুর রেলস্টেশন। কিন্তু পার্শবর্তী ভারতের রাজস্থানে জয়পুর নামে অন্য একটি রেল স্টেশন থাকায় এ জয়পুর অঞ্চলের হাটের প্রসিদ্ধতার পরিচয়ে রেল স্টেশন এর নাম করণ করা হয় জয়পুরহাট। পরবর্তীতে এ রেল স্টেশনের নাম নাম থেকেই এলাকার নামকরণ হয় জয়পুরহাট। অন্যদিকে ১৯০৭ সালে বাঘবাড়ীতে একটি থানা প্রতিষ্ঠিত হয় কিন্তু জয়পুরহাট নামটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হওয়ায় বাঘবাড়ি থানাটি জয়পুরহাট থানা নামে পরিচিতি পায়। সে সময় জয়পুরহাট অঞ্চল বগুড়া জেলার অংশ ছিলো। কালপরিক্রমায় ১৯৭১ সালে ১লা জানুয়ারি জয়পুরহাট মহকুমার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। এবং ১৯৮৪ সালে জয়পুরহাট মহকুমা থেকে জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

জয়পুরহাট জেলার সার্বিক তথ্য

বর্তমানে এ জেলার আয়তন ৯৬৫.৪৪ বর্গ কি.মি.। যা মোট ৫টি উপজেলায় বিভক্ত রয়েছে।

মোট ৫টি পৌরসভা ও ৩২টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত জয়পুরহাটের মোট গ্রামের সংখ্যা ৯৮৮টি।

এ জেলার জনসংখ্যা ১২ লাখ। জয়পুরহাট জেলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক নান্দনিক ও ঐতিহাসিক স্থান।

এ জেলার সদর উপজেলার বেল আমলা গ্রামে রয়েছে সেন আমলে প্রতিষ্ঠিত বার শিবালয় মন্দির।

আক্কেলপুর উপজেলায় রয়েছে দেশের প্রাচীন প্রত্নতত্ব নিদর্শন গোপীনাথপুর মন্দির।

ক্ষেতলাল উপজেলায় রয়েছে ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের ছোয়ায় নির্মিত ও অন্যতম নিদর্শন হিন্দা-কসবা শাহী জামে মসজিদ।

একই উপজেলার পৌর অঞ্চলের ইটাখোলা গ্রামে রয়েছে ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের আরেক অন্যতম নিদর্শন, আনুমানিক ২০০ বছরের পুরোনা কাজীপাড়া মসজিদ।

জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলায় রয়েছে ১৬১০ সালে খননকৃত প্রায় ১ কি.মি. আয়তনে বিস্তৃত নান্দাইল দিঘী।

এবং পাঁচবিবি উপজেলায় রয়েছে প্রায় ৫শত বছরের পুরোনো তিন একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর জমিদারের ধ্বংসাবশেষ নিদর্শন লকমা_জমিদার_বাড়ি। এছাড়াও রয়েছে শত বছরের পুরোনো একাধীক মাজার, নানা উদ্যান, পার্কসহ প্রভৃতি বিনোদন কেন্দ্র।

এ জেলার দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ফসলের মাঠ যে কোন ভ্রমণ পিপাসুকেই মুগ্ধ করবে । শতশত একর বিস্তৃত আলুর ক্ষেত, কচু ক্ষেত ও শরিষার হলুদপূর্ণ ফসলগুলো প্রকৃতি প্রেমিদের মনের অজান্তেই কাছে টানে।

কৃষিতে জয়পুরহাট

উত্তরাঞ্চলের শস্যভান্ডার খ্যাত জয়পুরহাট জেলার ভুপৃষ্টে আকাশ থেকে চোখ মিললে প্রকৃতির রঙ সাজে নতুন ভাবে। বির্স্তির্ণ ফসলের মাঠে মধ্যভাগ দিয়ে বয়ে গেছে অত্যান্ত সরু ছোট ছোট নদী। ছোট যমুনা, তুলসী গঙ্গা, চিরি ও হারাবতি নদীগুলোই জয়পুরহাটের প্রকৃতির প্রাণ। নদীর দুই ধারে গড়ে উঠেছে শতশত বসতি ও বাণিজ্যিক স্থাপনা। যা জয়পুরহাটের অর্থনীতিকে সঠিক ভারসাম্যে ধরে রাখে। অবশ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবে প্রাচীনকাল থেকেই জয়পুরহাটে তেমন কোন শিল্প কারখানা গড়ে উঠেনি।  ১৯৬৮ সালে জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে কয়লা এবং জয়পুরহাট সদর উপজেলায় চুনা পাথরের খনি  আবিস্কৃত হওয়ার পর এ অঞ্চলে শিল্পায়নে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দেয় । কিস্তু  পরবর্তীতে বিভিন্ন কারনে উক্ত কয়লা ও চুনাপাথর উত্তোলন ও শিল্পায়নের তেমন কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। জয়পুরহাট জেলাসহ অন্যান্য জেলার উৎপাদিত আখ থেকে চিনি তৈরী করার লক্ষ্যে ১৯৬০ সালের মে মাসে জয়পুরহাট সদরে ১৮৮.৮৭ একর জমিতে একটি সুগারমিল স্থাপিত হয়। বর্তমানে জয়পুরহাট সুগারমিলে বাৎসরিক চিনি উৎপাদনের ক্ষমতা- ২০,৩২০ মেঃ টন। তাছাড়া জয়পুরহাট শহরের দক্ষিণে  জয়পুরহাট জামালগঞ্জ সড়কের পূর্ব পার্শ্বে ১৯৯১ সালে ১৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে জয়পুরহাট শিল্প নগরীর কাজ শুরু হয়। বর্তমানে জয়পুরহাট বিসিক শিল্পনগরীর প্লট সংকট থাকায় নতুন আরেকটি শিল্প নগরী গড়ে তোলার দাবি জানাচ্ছে নতুন উদ্যোক্তারা।

সময়ের ঘূর্ণয়নে জয়পুরহাট এখন পল্ট্রি শিল্পের এক অনন্য ভান্ডার। জেলার তরুণ উদ্যোক্তারা এখন পল্ট্রী ব্যবসার মাধমে যেমনি জেলার অর্থনীতিকে উচ্চ মানদণ্ডে ভূষিত করছে তেমনিভাবে তারা নিজেরাও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাচ্ছে। জেলার প্রত্যান্ত গ্রাম অঞ্চলসহ প্রায় সবখানেই দেখা মিলবে ছোট-বড় অনেক পোল্ট্রী খামার।

জয়পুরহাট জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা

ঢাকা থেকে ২৮০ কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত জয়পুরহাট জেলা সদরের সাথে বর্তমানে সড়ক ও রেল যোগাযোগ খুবই ভালো। সমগ্র জেলা জুড়ে জয়পুরহাটের মোট পাকা রাস্তার পরিমাণ প্রায় ৪শ কি.মি। আর রেলপথ রয়েছে মোট প্রায় ৪০ কি.মি.। তবে একটি বিশেষ ব্যপার হলো জয়পুরহাট জেলার অভ্যান্তরীন রয়েছে মোট ৭টি রেল স্টেশন। যা জেলার ছোট-বড় বাস টার্মিনাল সংখ্যার চেয়েও বেশি।

জয়পুরহাট জেলার অর্থনৈতিক স্থাপনাসমূহ

জয়পুরহাট জেলা এক সময় দাপ্তরিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে থাকলেও এখন আর সে অবস্থায় নেই।

যেহুতু দেশের বৃহত্তম কয়লা খনি এ জেলাতেই অবস্থিত তাই এ জেলাতেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ কয়লা খনিজ ও ধাতব গবেষণা ইন্সটিটিউট।

রয়েছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের যুব ভবন, প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট তথা পিটিআই, আধুনিক জেলা হাসপাতাল, জেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর,  ভূমি অধিদপ্তর, মৎস অধিদপ্তর, সমাজ সেবা অধিদপ্তরসহ প্রয়োজনীয় সকল সরকারি স্থাপনা।

তাছাড়া যেহুতু জয়পুরহাট একটি বর্ডার সীমান্ত এলাকা তাই এ জেলায় রয়েছে বর্ডার-গার্ড-বাংলাদেশ-জয়পুরহাট-ব্যাটালিয়ন-২০।

শিক্ষায় জয়পুরহাট

দেশের ক্যাডেট কলেজ সমুহের ১২তম তথা সর্বশেষ প্রতিষ্ঠিত জয়পুরহাট গার্লস ক্যাডেট কলেজ এর অবস্থান এ জেলাতেই।

সে হিসেবে জেলার শিক্ষার মান যথেষ্ঠ উন্নতই বলা যায়। তবে পরিসংখ্যান মতে জয়পুরহাটের শিক্ষার মান ৭৫.৭% শতাংশ। এ জেলাতে রয়েছে ৩টি সরকারি কলেজ ও ৩৯টি বেসরকারি কলেজসহ মোট হাজার অধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

গুণী মানুষের জন্মভূমী জয়পুরহাট 

তাছাড়া জয়পুরহাট জেলা অনেক গুনী মানুষের জন্মভুমি হওয়ায় এর খ্যাতি ছড়িয়ে আছে দেশ জুড়ে। তন্মধ্যে অন্যতম কবি আতাউর রহমান, কণ্ঠশিল্পী খুরশীদ আলম, দিলরুবা খানম, একুশে পদক জয়ী অধ্যাপক মজিবর রহমান দেবদাস, সাবেক বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলাম, কৃষক নেতা মীর শহীদ মণ্ডল, বর্তমান বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদ ও মাওলানা ভাসানীর স্ত্রী জনাবা আলেমা খাতুন ভাসানী।

উল্লেখ্য, জয়পুরহাট মাওলানা ভাষানীর স্মৃতি বিজরিত একটি জেলা। ১৯৭১ সালের রণাঙ্গণে এ জেলার অকুতভয় অসংখ্য বীর সৈনিকেরা তাদের জীবনবাজি রেখে সেদিন এনে দিয়েছিলো একটি পতাকা। লাল সবুজের এই মানচিত্র অঙ্কণে সেদিন প্রাণ দিয়েছিলো জয়পুরহাটের অগনিত সাধারণ মানুষও। পাকবাহিনীর সেই নির্মমতার সাক্ষ্যি হিসেবে জেলার বিভিন্ন প্রান্তরে নির্মাণ করা হয়েছে একেকটি স্মৃতিসৌধ, বধ্যভূমি, ও ভাষ্কর্যসহ অসংখ্য স্মৃতি স্থাপনা।

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।