maxresdefault 4 jpg

ঐতিহাসিক শরীয়তপুর

সোনালী সেতুর শ্যামল ভূমি শরীয়তপুর নামে পরিচিত এ জেলা ঐতিহ্যমন্ডিত গৌরবময় একটি বর্ধিষ্ণু জনপদ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত পূণ্যভূমি শরীয়তপুর। স্বাধীনতার মহান স্হপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী এই মহাপুরুষের জন্ম যে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় তারই একটা অংশ নিয়ে সময়ের পরিক্রমায় গঠিত হয়েছে আজকের এই শরীয়তপুর।

বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ব্রিটিশ বিরোধী তথা ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজীশরীয়তউল্লাহর নামানুসারে নামংকিত মানচিত্রটি ১৯৮৪ সালে জেলা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

 

জেলাটি ইতিহাস খ্যাত বিক্রমপুরের দক্ষিণাঞ্চল আর প্রাচীন বরিশালের অংশ ইদিলপুর পরগনার কিয়দংশ নিয়ে গঠিত। ১৮৬৯ সালের পূর্বাবধি এ অঞ্চল বিক্রমপুরের অংশ হিসাবে শাসিত হয়ে আসছিল। পদ্মার গতি পরিবর্তনের ফলে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বৃটিশ সরকার পদ্মার দক্ষিণাঞ্চল তথা শরীয়তপুর জেলাকে বাকেরগঞ্জ জেলার সাথে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু মাত্র চার বছর পর ১৮৭৩ সালে এ অঞ্চলের জনগণের প্রবল বিরোধিতার প্রেক্ষিতে বৃটিশ সরকার এ অঞ্চলকে ফরিদপুর জেলার সাথে অন্তর্ভুক্ত করে। পরবর্তীতে ১৯১২ সালে প্রশাসনিক সুবিধার্থে মাদারীপুরের বৃহৎ পূর্বাঞ্চল নিয়ে একটি মহকুমা গঠনের প্রস্তাব উপস্থাপিত হয়। এরপর ভারত বিভাজন, পাকিস্তানি শাসন ও সর্বশেষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভের পর ১৯৭৭ সালের ১০ই আগষ্ট রেডিওতে সরকার কর্তৃক ঘোষনার মাধ্যমে মহকুমা গঠন করা হয়। অতপর ৭ই মার্চ ১৯৮৩ সালে রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ সরকারের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের ফলে শরীয়তপুর মহকুমাকে জেলা গঠনের ঘোষণা করা হয় এবং ১৯৮৪ সালের ১লা মার্চ শরীয়তপুর সম্পূর্ণ জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

মোট ৬টি উপজেলা, ৬টি পৌরসভা ও ৭টি থানার সমন্বয়ে গঠিত ১১৮১.৫৩ বর্গ কি.মি. আয়তনের শরীয়তপুর জেলার অসংখ্য নদীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পদ্মা, মেঘনা, দামুদিয়া ও আড়িয়াল খাঁ নদী। পদ্মার পলিতে গড়া, মেঘনার মায়ায় ঘেরা এ জেলাটি মাতৃমমতায় জড়িয়ে রেখেছে সবুজে শ্যামলে ছড়ানো ক্ষেত, গড়ে উঠেছে এক জল-জঙ্গলের কাব্য। এ জেলা আজ বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশীদার।

মুলত শরীয়তপুর জেলাটি ছিলো তুলনামুলকভাবে পিছিয়ে পড়া একটি জনপদ। আদিকাল থেকেই এ অঞ্চলে তেমন কোন শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠেনি। বর্তমানে বেসরকারি শিল্প উদ্যোক্তাদের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে শরীয়তপুর সদরে বিসিক শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে দারিদ্রতা ও বেকারত্বের হার দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে ও নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে।

রূপালি ইলিশের অফুরন্ত উপহার, বৈচিত্রপূর্ণ বনানীর অবাধ উল্লাস, জল-জঙ্গলের বিচিত্র মিলবন্ধন, নরম সোঁদা মাটির বিস্তীর্ণ প্রান্তর, উষ্ণ হৃদয়ের উদ্যমী মানব সম্পদ আর পদ্মা সেতুর সফল সংযোগ পদ্মা-মেঘনার মিলিত স্রোতধারায় সিক্ত, শরীয়তপুর জেলাকে করেছে অপার সম্ভাবনাময়। ফল-ফসলের অবাধ আবাদের সুযোগ, রাজধানীর নৈকট্য, সেতুর পশ্চিম প্রান্তে শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সেতু সংলগ্ন এলাকায় পর্যটন সংশ্লিষ্ট শিল্পের বিকাশ ইত্যাদির মাধ্যমে শরীয়তপুর জেলা জাতীয় অগ্রগতিতে রাখতে পারে অসামান্য অবদান।

তবে এ জেলার পদ্মার চরাঞ্চলগুলোতে প্রতিবছর নদী ভাঙ্গনের ফলে বসবাসরত মানুষের ব্যাপক ক্ষতির শিকার হতে হয়। গত ২০১৮ সালে সর্বকালের ভয়াবহ নদী ভাঙ্গন হয়েছিল এ জেলার নাড়িয়া উপজেলায়। তাছাড়াও শরীয়তপুর ভেদরগঞ্জের উত্তর তারাবুনিয়ায় কীর্তিনাশার ভাঙনের শব্দের সাথে নড়িয়া এলাকার শতশত নারী পুরুষের কান্নার চাপা শব্দ মিলায়ে রয়েছে। ভয়ংকর কালো মেঘ আকাশে ভাসার সাথে সাথেই নড়িয়ার কীর্তিনাশা হয়ে ওঠে সর্বনাশার মহাপ্রলয়।

পদ্মা নদীর করাল স্রোতে প্রতিবছরই ভেসে যাচ্ছে শরীয়তপুরের প্রায় ৪০০ বছরের দৃশ্যমান সভ্যতা। নদীপাড়ের গাছপালা, কৃষিজমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদীর খরস্রোতা জলে। আর জলের গভীর থেকে মাটির তলদেশের ভাঙ্গনে খসে পড়ছে সবুজ-সুন্দর গ্রাম।
মসজিদ, মন্দির, স্কুল-মাদ্রাসা, বসতবাড়ি ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর মত মজবুত কংক্রিটের স্থাপনাও ধীরে ধীরে জলের অতলে ডুবে যাওয়ার সেই ভয়াল দৃশ্যগুলো দেখলে আঁতকে উঠবে যে কেউ।

গত কয়েক দশকে বছরে নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে নদী তীরবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দাদের ঘরবাড়িসহ শতশত বিঘা জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে প্রতিবছরই বাড়ছে সর্বহারা, অসহায় মানুষদের সংখ্যা। তবে আশার বানী এই যে, শরীয়তপুর জেলার নদীভাঙ্গন রোধ ও জেলার বিবিধ উন্নয়ন কল্পে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ইতমধ্যেই কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে। তাই বলা যায়, শরীয়তপুর জেলা এখন উন্নয়নের মহাযজ্ঞে পরিণত হয়েছে।

শরীয়তপুরের ঐতিহ্য

আবহমান বাংলার ঐতিহ্যে লালিত একটি প্রতিযোগিতা প্রতিবছরেই এখানে পরিদৃষ্ট হয়, আর তা হলো বর্ষা মৌসুমের নৌকা বাইচ। অসংখ্য খাল-বিলের টলটলে পানি আর ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকার সেই ভাসমান দৃশ্য সত্যিই অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি করে।

বর্ষার পানি শুকিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই জেগে ওঠা কর্দমাক্ত মাঠ, তখন কৃষকের স্বপ্ন বুননে উম্মাদ থাকে। পলি বিধৌত দোআঁশ মাটির ভুখন্ডগুলো তখন খন্ড-খন্ড ভুমিতে সোনার ফসলে ভরে ওঠে। আলু চাষ, ধান চাষ, গম চাষসহ শতশত ফসলের সমাহারে সবুজ ও সোনালী বর্ণ ধারণ করে পুরো শরীয়তপুর অঞ্চল।

উল্লেখ্য যে, শরীয়তপুরের প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষই কৃষিজীবি। আছে ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসায়ী, জেলে, তাঁতী, কামার-কুমারসহ নানা পেশার মানুষ। ভাষা সৈনিক, সাধু-সন্নাসী, মুক্তিযোদ্ধা, সংগ্রামী নেতা, চিত্রশিল্পী,উপন্যাসিক, খেলোয়াড়, বৈজ্ঞানিক, গায়ক-গায়িকা ও রাজনীতিবিদ সহ অসংখ্যা গুণী মানুষের এই জেলায় রয়েছে একাধিক পুরাকৃর্তি স্থান। রয়েছে ঐতিহ্যবাহী মসজিদ, দুর্গ, আশ্রম ও মঠ।

শরীয়তপুর উপজেলায় বসবাসরত প্রায় ১৩ লাখ মানুষের দৈনন্দিন চলাচল, জীবন ধরণ এখন শতস্পূর্ত ও উদ্যোমী। একসময় ৩০ শতাংশের নীচের অবস্থানে থাকা শিক্ষার মান এখন প্রায় ৭০ শতাংশে উপনীত হয়েছে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।