maxresdefault 5 jpg

ঐতিহাসিক হরিরামপুর

প্রাচীণ সংস্কৃতি আর মনোরম সৌন্দর্যের বিশাল অরণ্যের জনপদ হরিরামপুর উপজেলা। উপজেলার বুক চিরে বহমান রয়েছে দেশের অন্যতম পদ্মা নদী। পদ্মার দুই পাড়ের ২৪৫.৪২ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়েই হরিরামপুর উপজেলার অবস্থান।

নদীর এ কুল ভাঙ্গে ওকুল গড়ে এইতো নদীর খেলা, বহুল আলোচিত এই গানের কথাগুলো হরিরামপুরবাসীর কাছে একেকটি চিরচেনা শব্দকোষ। প্রতি বছর নদীর ভাঙ্গণে শঙ্কিত থাকে এই জনগোষ্টির নদীর তীরবর্তী মানুষ। এ বছর উপজেলার বরাইদ, তিল্লী, দিঘলীয়া ও হরগজ ইউনিয়নের প্রায় শতাধিক ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভুক্তভোগীদের ভাষায় ধলেশ্বরীতে পানি ওঠা-নামার সময় প্রতিবছরই এসব এলাকায় ভাঙ্গন দেখা দেয়। নদীর এ ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় বসতভিটাসহ আবাদি ফসলী জমি হারিয়ে এখন সর্বশান্ত অঞ্চলের বহু মানুষ। হাজার বছর পূর্বে সৃষ্ট এই বসতি স্থানের রয়েছে এক অন্যরকম ইতিহাস। জানা যায় বাংলার বিখ্যাত চন্দ্ রাজবংশের শাসনামলে অঞ্চলটি চন্দ্র রাজ বংশীয় সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। তখন ঢাকার সাভার হতে ফরিদপুর পর্যন্ত ছিল একটি সমুদ্র ন্যায় বিশাল জলাশয় যা টোল সাগর নামে পরিচিত ছিল। একদা রাতে ঝড়ের মধ্যে এ জলাশয়ের মধ্য দিয়ে দরবেশ ফরিদউদ্দিন নৌকায় ভ্রমণ করছিলেন। তাঁর মহিমায় ঝড় থেমে যায় এবং পানি শুকিয়ে ছোট ছোট ভূখন্ডের সৃষ্টি হয়। এ সকল ভূখন্ডগুলো কালের পরিক্রমায় জনবসতি হিসেবে গড়ে ওঠে।

 

 

প্রচলিত আছে, ততকালিন বর্মন রাজবংশের শাসনামলে রাজা হরিবর্মন এ অঞ্চলটি শাসন করতেন। তাঁরই নামানুসারে এ জনপদের নাম হয় হরিরাম নগর যা কালের বিবতনের হরিরামপুর নামে পরিচিতি লাভ করে।

পরবর্তীকালে বিট্রিশ শাসনামলে তৎকালীন শাসক এ অঞ্চলে ১৮৪৫ সালে একটি থানা প্রতিষ্ঠা করেন। মুলত এই থানা প্রতিষ্টার পরেই হরিরামপুর অঞ্চলটি বঙ্গপ্রদেশের একটি বিশেষ অঞ্চল হিসেবে গুরুত্ব পেতে থাকে। উল্লেখ্য, ১৯৮৩ সালে হরিরামপুর থানা অঞ্চলটি উপজেলার স্বীকৃতি পায় এবং অঞ্চলটি মানিকগঞ্জ জেলার একটি গুরুত্ব থানা নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

পদ্মার উত্তাল ঢেউ আচড়ে পড়া নদী ও ২৪৫.৪২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশাল অরণ্যভুমির এ জনপদের মানুষ তুলনামুলক অধিকতর নিম্ন ও মধ্যবিত্ব আয়ের। নদীর দুই কুলের জনবসতিদের জীবনে কষ্টের ঘ্রান আরেকটি বেশি। দারিদ্রতার নিষ্ঠুরতা, নদীর ভাঙ্গনে আবাদী ফসল নষ্ট, রৌদ্র-বৃষ্টি ও প্রতিকূল আবহাওয়ায় বেঁচে থাকেন নদীর তীরবর্তী মানুষ। তাদের অধিকাংশই মৎস পেশার সাথে জড়িত। অনেকেই ভাসমান ছোট ব্যবসা বা ফেরিওয়ালা হিসেবে কাজ করে।

কৃষিতে হরিরামপুর

তবে হরিরামপুর অঞ্চলটি মুলত কৃষি ভিত্তিক অঞ্চল। এ অঞ্চলের মানুষ অনেক পরিশ্রমী ও সহজসরল। তারা সর্বদা নিজের ভাগ্যের উপর বিশ্বাস করে পদ্মায় বিলীন হওয়া বালুময় জমিতে সবুজ ফসলে ভরে তোলেন। উপজেলার চরাঞ্চলগুলো অধিক পলি সঞ্চিত হওয়ায় এখানে বাদাম, ধান, পাট, ভুট্টা, গম প্রভৃতি খাদ্য শস্য উৎপন্ন হয়। তাছাড়া পেপে, কলা, আঁখ, বেগুন, মরিচ ও পিয়াজসহ আরোও অনেক ধরণের কৃষি চাষ হয়ে থাকে উপজেলার অন্যান্য অঞ্চলজুড়ে। সাচি পান চাষের জন্যে এই উপজেলা বিখ্যাত । এখান পান দেশের গন্ডি পেরিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হয়। আবার এ উপজেলার পদ্মার তীরবর্তী চরাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে জিরার চাষ হয় । কৃষিতে অগ্রগতি বাড়াতে উপজেলার আজিমনগরে গড়ে উঠেছে শিকারপুর হর্টিকালার লি:। এখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায়্যে কৃষিজাত নানাবিধ ফসলের উৎপাদনসহ বিভিন্ন জাতের বিদেশী অর্কিডের চাষ করা হয়। এছাড়াও রয়েছে পাম গাছের বিশাল বাগান। এক কথায় হরিরামপুর উপজেলাটি কৃষি নির্ভর একটি সম্মৃদ্ধ অঞ্চল।

হরিরামপুরের জনসংখ্যা

কৃষক, জেলে, চাকুরীজীবি ব্যবসায়ী নানা পেশার মানুষের প্রাণের হরিরামপুরের মোট জন্যসংখা প্রায় তিন লাখ। এই তিন লাখ মানুষের জীবন যাত্রার মান সহজ কল্পে এখানে গড়ে উঠেছে সরকারি-বেসরকারি জনসংশ্লিষ্ট নানা অধিদপ্তর। এসব দপ্তরের মাধ্যমেই উপজেলার মানুষের সকল নাগরিক সুবিধা পরিচালিত হয়। তাছাড়াও রয়েছে আর্থিক সেবাদানকারি একাধিক ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানসহ বেসরকারী নানা এনজিও সংস্থা।

চিকিৎসায় হরিরামপুর

অন্যদিকে অঞ্চলের মানুষের চিকিৎসা সেবায় রয়েছে, একাধিক বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানসহ একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।

শিক্ষায় হরিরামপুর

পাশাপাশি উপজেলার শিক্ষা ব্যবস্থায় যুক্ত রয়েছে শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গত এক দশকের তুলনায় উপজেলার শিক্ষার মান বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমান হার দাড়িয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশে।

পর্যটনে হরিরামপুর

জেলা সদর থেকে প্রায় 35 কিলোমিটার দূরত্বে সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত হরিরামপুর উপজেলাটি পর্যটকদের একটি অন্যতম স্থান। ইছামতি নদীর কোল ঘেঁষে অবস্থিত 19 শতকে স্থাপিত এ উপজেলায় ঐতিহাসিক নিদর্শন ঝিটকা পোদ্দার বাড়ি । তৎকালে প্রতিষ্ঠিত দৃষ্টি নদন এ বাড়িটি ২ দশমিক ৭৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এছাড়াও উপজেলা ঝিটকা ইউনিয়নে সৈয়দ লোকমান হাকিমের মাজার বা লোকমানিয়া দরগাহ। এই মাজারে প্রতিবছর ভক্তদের সেবায় অনুষ্ঠিত হয় বাৎসরিক ওরস মোবারক। মুলত এ মাজারের অভ্যান্তরে শায়িত আছেন হযরত গাউসুল আজম শাহান শাহ সৈয়দ লোকমান হাকিম দরবেশ। হরিরামপুরে রয়েছে পদ্মার পাড়ে অবস্থিত আমাজান খ্যাত গভীর জঙ্গল। প্রতিদিন শত শত মানুষ এই বনে ঘুরতে আসেন। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ঘুরতে আসেন উপজেলার স্বপ্নপুরী পিকনিক স্পটে।

হরিরামপুরের সার্বিক তথ্য

১৩টি ইউনিয়ন, ১৬৩টি মৌজা, ২৫০টি গ্রাম নিয়ে গঠিত হরিরামপুর থানা অঞ্চলে গড়ে উঠেছে প্রায় ১০টি হাট-বাজার। এই বাজার এলাকাগুলোতে এখনো এখনো হকারদের মজমা বসে। যদিও বর্তমানে মানুষ আর তাদের চিকিৎসা পদ্ধতিতে বিশ্বাস করেনা, তবুও তারা কিঞ্চিত আস্থা নিয়ে এখনো ব্যবসা করে যাচ্ছে। তারা সাপ খেলা দেখিয়ে প্রথমে মানুষের মন জয় করে এরপর ঔষধ বা তাবিজ বিক্রি করে তাদের পরিবারের আহার জমায়। সাধারনত এ পেশার সাথে জড়িত থাকে ভাসমান বেদে সম্পদায়। তাদের জীবন চারণের আভ্যান্তরিণ দিকগুলো মানুষের কাছে তেমন পরিচিত নয়। তাদের যাযাবর জীবনটা কখনো কখনো থেমে যায় শহর বা পল্লীর কোন একটি বিচ্ছিন্ন পাড়ায়। কিন্তু এই জীবন যাত্রা পথে যখন তাদের কারো জীবনের সমাপ্তি ঘটে তখন তাদের লাশ নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয় স্বজনদের। হরিরামপুর অঞ্চলের নিভৃত একটি বিচ্ছিন্ন পল্লীতেও রয়েছে এমনই কিছু যাযাবর সম্প্রদায়। তাদের জীবনের সলিল সমাধি ঘটলে যেন আর সেই ভোগান্তি না পোহাতে হয় তাই বাংলাদেশ টুরিষ্ট পুলিশের প্রধান, মানবতাপ্রেমী পুলিশ অফিসার জনাব হাবিবুর রহমান বিপিএম বার, পিপিএম বার। হরিরাম পুরের শান্দার পাড়ায় তাদের জন্য একটি কবরস্থান নির্ধারণ করে জমি দান করেন।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।