Sobuj Songket Thumbnail Lohagara jpg

লোহাগাড়া! এ নামের সাথে মিশে আছে মুঘল শাহজাদা শাহ সুজার প্রায় সাড়ে তিনশত বছরের স্মৃতি বিজরিত ইতিহাস। তিনি ১৬৬০ সালে ঘটনাক্রমে মুঘল ভারতের সুবাহ বাংলার সুবাদার মীর জুমলার তাড়া খেয়ে আরাকান রাজ্যে যাওয়ার পথে এখানকার চুনতি গ্রামে কিছুদিন অবস্থান করেন। অতপর তার এ অবস্থান ত্যাগ করার সময় চুনতি গ্রামের এই স্থানে চিহ্নস্বরূপ একটি লোহার খুঁটি গেঁড়ে রাখেন। সেই স্মৃতিকে ধারণ করেই স্থানটি মানুষের মুখে লোহাগড়া নামে পরিচিতি পায়। লোহাগড়া নামে প্রশাসনিক এলাকা সৃষ্টির পূর্বে অঞ্চলটি সাতকানিয়া থানার আওতাধীন ছিলো। পরে ১৯৮১ সালে সাতকানিয়ার ৯টি ইউনিয়ন যথা বড়হাতিয়া, আমিরাবাদ পদুয়া, চরম্বা, কলাউজান, লোহাগাড়া, পুটিবিলা, চুনতি, আধুনগর ইউনিয়নের সমন্বয়য়ে নতুন থানার সৃষ্টি হয় যার নামকরণ করা হয় সেই ঐতিহাসিক লোহাগাড়ার নামে। এর মাত্র ২ বছর পর লোহাগাড়া থানাকে উপজেলায় রুপান্তর হয়।

এটি চট্টগ্রাম ১৫ সংসদীয় আসনের অন্তর্ভূক্ত একটি জনপদ। এর আয়তন ২৫৮.৮৮ বর্গকিমি এবং জনসংখ্যা প্রায় তিন লক্ষ। যা আয়তনের বিচারে চট্টগ্রামে অষ্টমতম এবং জনসংখ্যার দিক থেকে দশমতম একটি বিশেষ থানা অঞ্চল। আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রণ ও জনবাসীর নিরাপত্তার দিক থেকে যথেষ্ঠ সুনাম কুড়িয়েছেন লোহাগাড়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো. রাশেদুল ইসলাম। তিনি চট্টগ্রাম রেঞ্জের সম্মানিত অভিভাবক ডিআইজি নুরে আলম মীনার তত্বাবধানে এবং জেলার মান্যবর পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ’র দিক নির্দেশানায় ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন’ নীতি মাথায় রেখে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, মাদকদ্রব্য জব্দ, সাজাপ্রাপ্ত ও বিভিন্ন ওয়ারেন্টভুক্ত অসংখ্য পলাতক আসামি গ্রেফতার এবং উপজেলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ সার্বিক কাজ অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে পালন করছেন। তাঁর কাজের মূল্যায়নের স্বীকৃতি হিসেবে এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে শ্রেষ্ঠ অফিসার ইন চার্জ হিসেবে পুরস্কৃত করা হয় তাঁকে। লোহাগাড়া থানা পুলিশের এমন বিবিধ কার্যক্রমসহ এ উপজেলার প্রকৃতি, বিশেষ স্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সকল বিষয়াদির বর্তমান হালচাল নিয়েই পজিটিভ থিংকের আজকের সবুজ সংকেত লোহাগাড়া।

 

 

বন্দর নগরী চট্টগ্রাম জেলার সদর থেকে ৬০ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থিত বিশেষ প্রশাসনিক জনপদ লোহাগাড়া। খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত ও নৈসর্গিক শোভামণ্ডিত লোহাগাড়া উপজেলা প্রাচীনকাল থেকেই প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে ভরপুর। একইসাথে অর্থনৈতিক এলাকা হিসেবে এ উপজেলার খ্যাতিও অনেক। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় এ এলাকার অর্থনীতির চাকা ঘুরছে সাবলীলভাবে। বনজসম্পদ ও কৃষিজপণ্য উৎপাদন করে এলাকার অনেক পরিবার স্বাবলম্বী। প্রাণী ও মৎস্য সম্পদের দিক দিয়ে এ উপজেলার ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। লোহাগাড়ায় রয়েছে অসংখ্য মৎস্য চাষী। উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া টংকাবতী, হাঙ্গর ও চাম্বী খালের উপর মির্মিত হয়েছে রাবার ড্যাম। এসব খালে মৌসুমী মৎস্য চাষ হচ্ছে। এছাড়া ছোট-বড় একাধিক মৎস্য খামার গড়ে ওঠেছে চুনতি, বড়হাতিয়া, পুটিবিলা, কলাউজান, আমিরাবাদ. চরম্বা ও পদুয়াসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে। তাছাড়া এ উপজেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম সহায়ক হল পোলট্রি ও ডেইরি ফার্ম। খামারের মালিকরা প্রযুক্তিগতভাবে হাঁস-মুরগি পালন করে প্রচুর লাভবান হচ্ছেন।

অপরদিকে, এ উপজেলার পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্বে রয়েছে গভীর বনাঞ্চল। বনাঞ্চলে রয়েছে প্রচুর মূল্যবান বনজসম্পদ। এর মধ্যে কোনটা সরকারি, আবার কোনটা বেসরকারি বা অংশিদারিত্ব বাগান। উপজেলার প্রায় এলাকার খালের চর বা পাহাড়ি এলাকার সমতল ভূমিতে প্রচুর পরিমাণ তরি-তরকারি ও শাক-সবজি উৎপাদন হচ্ছে। পাশাপাশি পাহাড় বা টিলা জায়গায় প্রচুর পরিমাণ আম, কাঁঠাল, লিচু ও লেবু উৎপাদন হচ্ছে। তবে শিল্প-কারখানার দিক দিয়ে লোহাগাড়া অনগ্রসর। ছোট-খাটো  দু’একটি উৎপাদনমুখী কারখানা রয়েছে। তবু একটি বৃহৎ শিল্পকারখানা এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষদের বহুদিন যাবত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে যাচ্ছে।

লোহাগড়ার এমন কিছু শিল্পকারখানার মধ্যে ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত নোমান গ্রুপ টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক প্রস্তুতকরণ, বিপণন ও বাজারজাত করার মাধ্যমে বাংলাদেশের অন্যতম একটি বস্ত্রশিল্প প্রতিষ্ঠান গ্রুপ হিসেবে দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। উল্লেখ্য যে, নোমান গ্রুপ প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মোঃ নূরুল ইসলামের তত্তাবধায়নে ২ দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের সর্বোচ্চ রপ্তানিকারক হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় নোমান গ্রুপ জাতীয় রপ্তানি ট্রফি, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক শিল্প উন্নয়ন পুরস্কার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রপ্তানি ট্রফি অর্জন করেছে। এ ছাড়াও জাতীয় অর্থনীতিতে অনন্য অবদান রাখায় উক্ত গ্রুপ এর পরিচালকবৃন্দ ২০০৭ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে সিইপি-রপ্তানী নির্বাচিত হয়ে আসছে।

এসব মাইলফলক অর্জন করা নোমান গ্রুপের প্রধান অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সমূহ হলোঃ

Zaber & Zubair Fabrics Limited.

Noman Terry Towel Mills Limited এবং

Nice Synthetic Yarn Mills Limited

Noman Weaving Mills Ltd

এ গ্রুপের অধীনে প্রায় ৩২ টি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ফ্যাক্টরিগুলোতে ৭০ হাজারেরও বেশি কর্মীকে নিয়োগ দিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম স্থান দখল করে আছে তারা।

এতে সাতকানিয়া- লোহাগড়াসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বহু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও উল্লেখ্য, লোহাগড়া উপজেলার জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে দেশের রেমিটেন্স যোদ্ধার ভুমিকা পালন করছেন।

লোহাগাড়া দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় উপজেলা। শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি, শিক্ষা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে এ উপজেলা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও পর্যটন শিল্পের অন্যতম ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছে এই উপজেলা। অফিসার ইন চার্জ মো. রাশেদুল ইসলাম মনে করেন, লোহাগাড়া উপজেলার দুইদিকে দুইটি পর্যটনকেন্দ্র তথা বান্দরবান ও কক্সবাজার থাকায় এ অঞ্চলের গুরুত্ব অনেক বেশি। অর্থ্যাৎ, এলাকাটির ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এটি চট্টগ্রামের অন্যতম ব্যতিক্রমী উপজেলা হিসেবে অবস্থান নিয়েছে।

লোহাগাড়া ঘেষে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চলে গেলেও উপজেলার অভ্যন্তরীন যোগাযোগ তথা প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রাম এলাকাগুলো দুর্গম হওয়ার কারণে এ জনপদের মানুষের পুলিশী সেবা পেতে বেশ বেগ পেতে হয়। এক্ষেত্রে কিছু চিন্তাশীল পদক্ষেপের কথা জানালেন লোহাগাড়া থানার অফিসার ইন চার্জ। বান্দরবান সীমান্ত, লামা সীমান্ত ও আজিজনগর সীমান্ত অত্যন্ত দুর্গম হওয়ার পরেও বিট পুলিশিং সেবা ও কমিউনিটি পুলিশিং সেবা এসব অঞ্চলে সেবা প্রদানে উদ্যোগী থাকেন।

তবে এসব পুলিশী সেবা প্রদানে এক বিশাল পুলিশ ইউনিট থাকা দরকার। চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক নূরে আলম মীনার তত্তাবধানে ও পুলিশ সুপার এস এম শফিল্লাহ’র নির্দেশনায় অফিসার ইন চার্জ মো. রাশেদুল ইসলামের নেতৃত্বে লোহাগাড়া থানা ও চুনোতি পুলিশ ফাঁড়ি পরিচালিত হয়ে থাকে। এ থানায় ৯টি বিট এলাকার জন্য সর্বমোট ৬৪ জন কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন। তন্মধ্যে ২ জন ইন্সপেক্টর, ১০ জন সাব-ইন্সপেক্টর, ৮ জন এসিসট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর ও ২৯ জন কন্সটেবল এবং ফাঁড়িতে ২ জন সাব-ইন্সপেক্টর, ২ জন এসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর ও ১১ জন কনস্টেবল কর্মরত আছেন।

তবে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে জনসাধারণ যেমন লাভবান হয়েছে, তেমনি তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষতির দিকগুলো কম আঘাত করেনি তাদের। আর আধুনিক যুগে অপরাধের ধরণগুলোও বেশ আলাদা। ইদানীং সামাজিক মাধ্যমগুলোতে গুজবের কারণে কাদা-ছোড়াছোড়ির ঘটনা অনেকাংশে দেখা যায়। এসব ঘটনার বিরুদ্ধে সাইবার পেট্রোলিং এর নতুন কার্যবিধির কথা জানালেন লোহাগাড়া থানার অফিসার ইন চার্জ।

এভাবে তথ্যপ্রযুক্তির বিপুল বিকাশে প্রান্তিক অঞ্চলগুলোর সামষ্টিক উন্নয়ন হয়েছে, সভ্যতাও তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় ইতিহাসের শিকড়কে ভুলে যাওয়া ঠিক নয়। তা-ই অন্যান্য অঞ্চলগুলোর মতোই এ থানার ইতিহাস সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

লোহাগাড়ার ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রামের লোহাগাড়া একসময় আরাকান, ত্রিপুরা, মোঘল, আরমেনীয়, পর্তুগীজ ও ইংরেজসহ বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর শাসনে ছিল। এখানে আগমন ঘটেছে বহু সুফী-সাধকের। হিন্দু ঋষি-সাধুদেরও যাতায়াত হয়েছে এখানে। এভাবে বিচিত্র সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে এ অঞ্চলে।

তবে কালের পরিক্রমায় আমাদের কাছ থেকে ইতিহাসের অনেককিছুই হারিয়ে যেতে বসেছে। তবুও যতটুকু এখনো বিদ্যমান রয়েছে, সে থেকে জানা যায়, লোহাগাড়ার একটি প্রাচীনতম ও ঐতিহাসিক জনপদের নাম গৌরস্থান। এটি উপজেলার পুটিবালা ইউনিয়নে অবস্থিত গৌড় রাজ্যের সামন্ত রাজা নরমিখলার রাজত্ব এলাকা। ১৪৪১ সালে এখানে সামন্ত রাজ্যের নিরাপত্তা জন্য একটি দূর্গ নির্মাণ করা হয়েছিলো। দূর্গটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও দুর্গের সাক্ষী হয়ে শত শত বছর ধরে জিইয়ে রয়েছে সে সময় খনন করা একটি পুকুর। এই শত বছরের পুকুর বেষ্টিত গৌরস্থানকে লোহাগাড়া উপজেলা দর্শনীয় স্থানের মধ্যে প্রকৃতির সৌন্দর্যের অন্যতম স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়াও প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদের মধ্যে রয়েছে ৩ শত বছরের প্রাচীন গুপ্ত জমিদার বাড়ি, চেঁদিরপুনি বৌদ্ধ মন্দির ও রাজস্থাপত্য, আধুনগর বৌদ্ধ মন্দির, মগদীঘি মগদেশ্বরী মন্দির, চুনতি খান মসজিদ, সাতগড় মাওলানা শাহ আতাউল্লাহ হোসাইনী (রহ.) এর মাজার, মোহাম্মদ খান সিদ্দিকী (রহ) নায়েবে উজির মাজার ও মসজিদসহ অনেকগুলো মাজার, মসজিদ, মাদ্রাসা মন্দির ও পরিত্যাক্ত প্রাচীন বাড়ী।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।