Etna
সবুজ, শীতল, নয়নাভিরাম ও অপরুপ বৈচিত্রের হাওর-বাওরে  বিস্তৃত দেশের কিশোরগঞ্জ জেলার  অন্যতম বৃহত্তম একটি উপজেলার নাম ইটনা। নীল আকাশ ঘেরা বিশাল জলরাশি, পাখির কলতানে মুগ্ধ মৃদু বাতাস, নীল বর্ণে সাজিয়ে থাকা খাল বিলের থলথলে জলস্রোতের  শব্দ মুখরিত অঞ্চল, সত্যিই এক অসাধারণ জনপদ।
ইটনা উপজেলার নামকরনের ইতিহাস
ধারণা করা হয় ঐতিহাসিক আমলে এ অঞ্চলের ভুমির জরিপ চলাকালে কর্মচারীগণ জরিপের ইতি ঘোষনা করে। কিন্তু পর মূহুর্তেই দেখা গেল এলাকাটির আয়তন আরও বড়। তাই নিযুক্ত জরিপ অফিসার বলে ঊঠলেন জরিপের কাজ এখনো শেষ হয়নি অর্থাৎ এ অঞ্চলের জরিপ ইতি না!
এই ইতি না শব্দটি মানুষের মূখে ছড়াতে ছড়াতে ইতিনা শব্দের অপভ্রংশ ইটনা শব্দে রুপান্তর হয়। কালক্রমে এই এলাকাটি ইটনা নামেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
ইটনা উপজেলার প্রতিষ্ঠা
জানা যায় বর্তমান ইটনা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার পশ্চিম দিকে বাদলা গ্রামে ১৮৬৪ সনে একটি আউট-পোষ্ট থানা বা পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯০৬ সালের ১৫ই জুন পূর্ববঙ্গ ও আসাম সরকারের ৬৬৭৬ নং গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাদলা পুলিশ ফাঁড়ি বিলুপ্ত গোষনা করে, ইটনায় একটি পূর্নাঙ্গ থানা প্রতিষ্ঠা করে। এবং ১৯১৭ সালে ইটনা থানা অঞ্চলটি ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে উপজেলার স্বীকৃতি লাভ করে। তবে ১৯৮৪ সালে ইটনার অন্তর্ভূক্ত ৩টি ইউনিয়ন অন্য একটি থানার সাথে সংযুক্ত হয়। পরবর্তীতে আরেকটি ইউনিয়নের সংযোজন হওয়ার ফলে ৯টি ইউনিয়নে বর্তমান উপজেলাটি প্রতিষ্ঠা পায়।তবে ইটনা উপজেলাতে নেই কোন পৌরসভা ।
ইটনা উপজেলার অবস্থান
কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলাটি ৫০৩ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে  বাংলাদেশের বৃহত্তম উপজেলা গুলির অন্যতম। যার উত্তরে নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলা ও খালিয়াজুড়ি উপজেলা, দক্ষিণে মিঠামইন উপজেলা এবং করিমগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলা ও সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলা আর পশ্চিমে তাড়াইল উপজেলা ও করিমগঞ্জ উপজেলা।৮৫টি মৌজায় বিভক্ত ১১৭টি গ্রাম নিয়ে গঠিত ইটনা উপজেলাটি ব্যবসা বাণিজ্যে সমৃদ্ধ একটি উপজেলা।

জনসংখ্যা উপাত্ত
২০১১ সালের আদম শুমারি অনুসারে প্রায় ১৩২,৯৪৮ জন জনসংখ্যার বসবাস ইটনা উপজেলাতে ।যা জনঘনত্বে ২৯০ বর্গকিমি।শতকরা ৫২.১৪ পুরুষ এবং শতকরা ৪৭.৮৬ মহিলার মাঝে রয়েছে মুসলিম ৮০%,হিন্দু ১৮%,বৌদ্ধ ০.১২%,খ্রীষ্টান ০.১২ % সহ অন্যান্য ধর্মের রয়েছে  ১.৭৬%
কর্মনির্ভর ইটনা উপজেলার মানুষ
নদী সংলগ্ন এই উপজেলার বেশির ভাগ মানুষ কৃষি নির্ভর। এই এলাকার লোকজন বছরের ছয়মাস কৃষি কাজ করে ,ছয় মাস মাছ চাষ ও নদীতে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত থাকে। এই উপজেলার মাছ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরসহ রাজধানীতে রপ্তনী হয়। বর্তমানে রপ্তানীর কারণে এই এলাকায় মাছের দাম যে কোন জেলা শহর থেকে অনেক বেশি। প্রতি দিন প্রায় ২০ থেকে ২৫ মন মাছ আমদানী রপ্তানী হচ্ছে। কৃষি ছাড়াও চাকুরি,ব্যবসায়ের  সাথে রয়েছে অত্র উপজেলার মানুষ। ইটনা উপজেলা  ব্যবসা বাণিজ্যে সমৃদ্ধ।  মোদির দোকান থেকে শুরু করে কসমেটিক্স, কাচামাল, ওর্য়াকশপ, সব ধরনের ব্যবসা ইটনা উপজেলায় বর্তমান।
শিক্ষার হার
উল্লেখ্য যে, শিক্ষার দিক থেকে বেশ এগিয়ে রয়েছে এই উপজেলাটি। সর্বশেষ পরিসংখান অনুযায়ী ইটনা উপজেলার প্রায় ৬৫ শতাংশই শিক্ষিত। রয়েছে একটি মহাবিদ্যালয়সহ ৮টি উচ্চ বিদ্যালয় ৬৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২১ মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সারা বছরই ইটনার হাওড় গুলোতে কম-বেশি পানি থাকলেও বর্ষাকালে হাওরগুলো যেন শৈল্পিক রূপ লাভ করে। তখন দুচোখে শুধু দিগন্তজোড়া সাগরসম অথৈ পানির বিস্তৃতি আর কোথাও কোথাও মাথা চারা দিয়ে উঠে সবুজ বৃক্ষ, দ্বীপের মত ভাসমান একগুচ্ছ বসতবাড়ি। হাওরে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য আর চোখে পড়বে নানান প্রজাতির পাখি। আর হাওরের বুকে সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য দেখার মুগ্ধতা যেকোন পর্যটককে ধওে রাখবে ইটনার হাওর অঞ্চলে। বর্ষা মৌসুম শেষ হলে হাওড়ের বুক চিড়ে দৃশ্যমান হয় ছোট-বড় অসংখ্য নদী-খাল। উপজেলার অন্যতম নদী মেঘনা, ধনু, ঘোড়াউত্রার প্রবাহমান জলধারায় দেখা মিলবে শিশুদের জলশাতার ও বিভিন্ন খেলা-ধুলা।
ইটনা উপজেলার দর্শনীয় স্থান
আনন্দমোহন বসুর ভিটা
ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা, শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক আনন্দমোহন বসুর জন্মভিটা কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা থানার জয়সিদ্ধি গ্রামে অবস্থিত ।
গুরুদয়াল সরকারের বাড়ি
কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের কাঠৈর গ্রামের কৃতী সন্তান দানবীর গুরুদয়াল সরকার। তৎকালীন একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ও পশ্চাৎপদ জনপদের অধিবাসী হয়েও তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি আলোকময় সমাজের। এর জন্য তিনি শিক্ষার মশাল জ্বালাতে প্রচণ্ড সাহসে সুদীপ্ত ও সুদৃঢ় চিত্তে দান করেছিলেন তাঁরই উপার্জিত ধন-সম্পদ। এই দানবীরের বদান্যতায় এবং তাঁরই হাত ধরে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আজকের সুপ্রতিষ্ঠিত গুরুদয়াল সরকারি কলেজ।
ইটনা মধ্যগ্রাম জামে মসজিদ
ইটনা শাহী জামে মসজিদ ইটনা উপজেলায় অবস্থিত ।মোঘল স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত আই মসজিদটি একটি বেদির উপর স্থাপিত।ইতিহাস থেকে জানা যায় যে,৪২৫ বছর আগে এই মসজিদটি বারো ভুইয়ার প্রধান ঈসা খাঁর সভাসদ মজলিস দেলোয়ার নির্মান করেন।কেউ কেউ এটাকে গায়েবি মসজিদ আবার তিন গম্বুজ মসজিদ বলে থাকে ।
কিশোরগঞ্জ এর বৃহত্তম এ উপজেলায় বসবাসকারি প্রায় ২ লক্ষ মানুষের স্বাস্থ্য সেবায় রয়েছে ১ টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র – ০৫টি, কমিউনিটি ক্লিনিক – ২০টি  সহ আরও নানান বিভাগীয় স্বাস্থ্যসেবার সরকারি বেসরকারি  প্রতিষ্ঠান।
এ উপজেলাটি হাওর অধ্যুষিত জনপদ হলেও এখানকার মানুষ খুবই পরিশ্রমী। কৃষি, ব্যবসা, উদ্যোক্তাসহ প্রায় সব ধরনের পেশার সাথেই যুক্ত থাকে এ অঞ্চলের মানুষ।প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পরিবেশে বেড়ে ওটা এখানকার মানুষের আচরণগত সৌন্দর্য খুবই প্রসংশনীয়।
তবে ক্ষনে ক্ষনে ঘটে কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা উপজেলাবাসীকে ব্যথিত করে। যদিও এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন একদল প্রশিক্ষিত পুলিশ সদস্য ও তাদের দিক নির্দেশক ইটনা থানার একজন অফিসার ইনচার্জ সহ অত্র উপজেলার আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান সমূহ।
error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।