Sarail

একদিকে মেঘনা ও অন্যদিকে তিতাস নদীর আবর্তে গড়ে উঠা হাওর-বিল বেষ্টিত একটি জনপদ নাম সরাইল। এ অঞ্চলটির নামকরনের ইতিহাস নিয়ে একাধিক মতবাদ প্রচলিত থাকলেও ধারনা করা হয়, সরাইখানা শব্দ থেকে সরাই এবং ফার্সি শব্দ ইল মিলে সরাইল নামটির উৎপত্তি। আবার অনেকের মতে, সর অর্থ জলাশয় আর আইল অর্থ বাঁধ বা উঁচুভূমি। জানা যায়, এ এলাকায় একসময় বিশাল জলাশয়ের জেগে উঠা আইলে জনবসতি গড়তে শুরু করে। সে থেকেই এ এলাকাটি সরাইল নামে লোকমুখে পরিচিতি হতে থাকে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৮২ সালে সরাইল একটি পৃথক থানা অঞ্চল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে যা ১৯৯০ সালে উপজেলায় উন্নীত হয়।

 

 

অবস্থানঃ

বাংলার বারো ভূইয়াদের স্মৃতি বিজরিত সরাইল ঢাকা থেকে প্রায় ৯৬ কিলোমিটার উত্তর পূর্বাংশে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ২১৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জনপদটিতে বাসবাস করেন ৩ লাখ ১৫ হাজারেরো অধিক মানুষ। সরাইলের পূর্বদিকে নাসিরনগর ও বিজয়নগর উপজেলা, পশ্চিমে আশুগঞ্জ উপজেলা ও মেঘনা নদী, উত্তরে নাসিরনগর এবং দক্ষিণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার অবস্থান। রয়েছে মোট ৯টি ইউনিয়ন যার সম্পূর্ন প্রশাসনিক কার্যক্রম সরাইল থানার অন্তর্ভুক্ত। ইউনিয়ন সমূহ হল অরুয়াইল, পাকশিমুল, চুণ্টা, কালিকচ্ছ, পানিশ্বর, সরাইল সদর, নোয়াগাঁও, শাহজাদাপুর এবং শাহবাজপুর।

মুক্তিযুদ্ধঃ

৭১এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাইলে রচিত হয়েছে গৌরবময় আত্মত্যাগের ইতিহাস। বিটঘর এলাকায় পাকবাহিনী নিরস্ত্র বাঙ্গালিদের উপর নির্বিচার গনহত্যা চালালে শহীদ হন অন্তত ৮০ জন স্থানীয় বাসিন্দা। এছাড়া শাহবাজপুর, কালিকচ্ছ বাজার সহ বেশ কিছু স্থানে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকহানাদারদের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষের পর শত্রুমুক্ত হয় সরাইল। মুক্তিযুদ্ধে এসব আত্মত্যাগের ইতিহাস আজীবন স্মরণ রাখতে নির্মিত হয়েছে ‘বিটঘর গনহত্যায় শহীদের স্মৃতিসৌধ’ ও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সম্বলিত বেদি।

শিক্ষাঃ

স্বাধীনতার পর থেকেই সরাইলে শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশেষ নজর দেয়া হচ্ছে। অঞ্চলটিতে বর্তমান শিক্ষার হার ছাড়িয়েছে ৪০ শতাংশে। রয়েছে সরাইল সরকারি কলেজসহ ২টি কলেজ, ১৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সরকারি বেসরকারি সহ মোট ১২৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৮টি কিন্ডার গার্টেন ও বেশ কিছু মাদ্রাসা।

যোগাযোগঃ

এলাকার সার্বিক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্নত থাকায় সরাইলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে দৃশ্যমান উন্নয়ন। দুরপাল্লার যাতায়াতে এ অঞ্চলের বুক চিরেই বয়ে গেছে ঢাকা– সিলেট মহাসড়ক। এছাড়াও আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সচল রাখতে নির্মিত হয়েছে সরাইল – নাসিরনগর – হবিগঞ্জ সড়ক সহ ৪৮ কিলোমিটার পাকা রাস্তা ও ব্রিজ কালভার্ট। তবে, হাওর বেষ্টিত থানা অঞ্চল হওয়ায় বেশ কিছু এলাকায় এখনও পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকায় নৌ পথে যাতায়াত করতে হয় এ থানা অঞ্চলের জনগনকে। নিয়মিত এ সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে থানা বাসীকে আইনি সেবা প্রদান করে আসছে সরাইল থানা পুলিশ।

অর্থনীতিঃ

গ্রামীণ জনপদই এ অঞ্চলের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এলাকাটিতে প্রচুর পরিমাণ কৃষিজীবী ও মৎস্যজীবী থাকায় সরাইলবাসীর জীবনযাপন মূলত কৃষি নির্ভর। রয়েছে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, বেশ কিছু মৎস্য খামার ও হাওরাঞ্চল। এর পাশাপাশি মোট জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ব্যবসা, চাকরি ও শিল্পখাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাছাড়া নদীমাতৃক এলাকা হওয়ায় গড়ে উঠেছে ট্রলার-কার্গো ও জাহাজ নির্মাণের জন্য ডকইয়ার্ড।

স্বাস্থ্য

থানাবাসীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে রয়েছে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৫টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ১৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক সহ ১০টি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র। পশুপাখির স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে রয়েছে উপজেলা প্রানিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল।

দর্শনীয় স্থানঃ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সুসজ্জিত এ থানা অঞ্চলটি দর্শনীয় স্থানে ভরপুর। এখানেই রয়েছে প্রায় ৪০০ বছর পুরনো মোগল আমলের অপরূপ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত আরিফাইল শাহী মসজিদ। দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদটির ৩ গম্বুজ ও দেয়ালে টেরাকোটা বিভিন্ন প্রাচীন নকশাগুলো মুগ্ধ করে দেশের বিভিন্ন স্থান হতে আগত মুসুল্লিদের। আরও রয়েছে সেন জমিদারদের স্মৃতি বিজড়িত দানবীর জমিদার অবিনাশ চন্দ্র সেনের বাড়ি। রয়েছে বেশ কিছু সুপ্রাচীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেমন বিকাল বাজার শাহী মসজিদ, শ্রী শ্রী আনন্দময়ী কালীবাড়ি, শ্রী শ্রী কালাচাঁন বাবাজীর আশ্রম, আয়াত উল্লাহ শাহের মাজার, গায়েবি মাজার ও মসজিদ।

কৃতী সন্তান:

এখানেই জন্মগ্রহন করেন বাংলার বার ভূইয়া সর্দারদের অন্যতম ঈসা খাঁ। ভাষা সংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু হামেদের জন্মস্থানও এই সরাইল। জন্মগ্রহন করেন একুশে পদক প্রাপ্ত সাহিত্যিক কবি ও গবেষক আহমদ রফিক সহ বহু কৃতী সন্তান।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।