Shibganj Chapainawabganj

বাংলাদেশের সর্ব-পশ্চিমে ভারত সীমান্তবর্তী পদ্মার কোল ঘেঁষে গড়ে উঠা একটি ব্যাতিক্রমী থানা অঞ্চল শিবগঞ্জ। এটি প্রাচীন সভ্যতার সুতিকাগার বরেন্দ্র ভূমিরই একটি অংশ। প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় নগরী আর সুলতানী ও মুঘল আমলের স্মৃতি বিজড়িত এই জনপদটি আদিকাল হতেই ভারতবর্ষে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়ে আসছে।

তবে, শিবগঞ্জের নামকরণে রয়েছে পৌরাণিক ইতিহাস। জানা যায়, সম্রাট শের শাহ্‌’র নামের আদলে এ এলাকার নাম ছিলো শেরগঞ্জ। পরবর্তীতে হিন্দু সম্প্রদায় তাদের অন্যতম দেবতা শিব এর পূজার জন্য বর্তমান শিবগঞ্জ বাজারে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর হতেই এ এলাকায় শিবপুজার ব্যপক প্রচলন শুরু হয়। মানুশজন চাঁপাইনবাবগঞ্জের নানা প্রান্ত থেকে শিবপূজা পালনের উদ্দেশ্যে ভীরতে শুরু করলে এ অঞ্চল শিবগঞ্জ নামে অধিষ্ঠিত হতে থাকে। আরেকটি তথ্যমতে, এ এলাকায় বাস করতেন শিবরঞ্জন মুখোপাধ্যায় নামে এক ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার জৌলুস ও প্রতিপত্তি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে এ অঞ্চলটি শিবগঞ্জ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

 

 

ঢাকা থেকে প্রায় ৩৩০ কিলোমিটার এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর হতে ২২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি প্রশাসনিক এলাকা শিবগঞ্জ। এ থানা অঞ্চলের মোট আয়তন ৫২৫ দশমিক চার দুই বর্গকিলোমিটার এবং সর্বশেষ আদমশুমারী অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা প্রায় ৫ লাখ ৯১ হাজার ১৭৮ জন। শিবগঞ্জ মোট একটি পৌরসভা এবং ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। ইউনিয়ন সমূহ যথাক্রমে; বিনোদপুর, চককির্তী, দাইপুকুরিয়া, ধাইনগর, দুর্লভপুর, ঘোড়াপাখিয়া, মোবারকপুর, মনাকষা, নয়ালাভাঙ্গা, পাঁকা, ছত্রাজিতপুর, শাহবাজপুর, শ্যামপুর, কানসাট এবং উজিরপুর ইউনিয়ন।

শিবগঞ্জ এলাকার পূর্ব দিকে ঘিরে আছে ভোলাহাট, গোমস্তাপুর এবং নাচোল সহ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর, পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরে ভোলাহাট ও ভারত সীমান্ত এবং দক্ষিণে পদ্মা নদী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর এলাকা অবস্থিত।

৭১ এর রণাঙ্গনে এ এলাকার মানুষের রয়েছে গুরুত্ববহ অবদান। শিবগঞ্জ ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায়, মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে সশস্ত্র প্রশিক্ষনে যাওয়ার জন্য এই পথকেই বেছে নিতো। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিসেনার দল। তেসরা মে পাকবাহিনীরা শিবগঞ্জে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করে। শিবগঞ্জ বাজারে পাকসেনারা ২টি ভাগে বিভক্ত হয়ে একদল মনকষা অভিমুখে আরেকদল কানসাট এলাকায় তান্ডব শুরু করে। অসংখ্য হিন্দু বাড়ি আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় এই ঘাতকেরা। নির্মমভাবে হত্যা করে রাধাকান্তপুর গ্রামের ৪৭ জন লোককে। অত্যাচার আর নিপীড়ন সহ্য না করতে পেরে প্রতিহত করতে পরিকল্পনার ছক আঁকে মুক্তিযোদ্ধারা। বিভিন্ন ছোট-বড় অপারেশন, সম্মুখযুদ্ধসহ গেরিলা আক্রমনে ক্রমশই পিছু হটতে শুরু করে পাক হানাদার বাহিনী। তন্মধ্যে, শিবগঞ্জ পাকসেনা ক্যাম্প আক্রমণ, কানসাট আক্রমণ, কালুপুর যুদ্ধ, তেলকুপি যুদ্ধ, সোনামসজিদ ডিফেন্স যুদ্ধ আজও দাগ কাটে বেঁচে যাওয়া প্রবীনদের। মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহস এবং স্বাধীনতা অর্জনের প্রবল ক্ষুদা আরো তীব্র হতে থাকলে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এভাবেই এ অঞ্চলটি ১৯৭১ সালের ১১ই ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয়। এই শিবগঞ্জেই চির নিদ্রায় শায়িত আছেন অন্যতম বীরশ্রেষ্ট ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। ৭১ এর স্মৃতি আজীবন স্মরণ রাখতে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিফলক সংরক্ষিত আছে বধ্যভূমি ও গণকবর; স্থাপিত হয়েছে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন।

বর্তমানে শিবগঞ্জ থানা অঞ্চল একটি ক্রমবর্ধমান জনপদ। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর প্রধান আয়ের উৎস কৃষি। অর্থকরী ফসল হিসেবে ধান, গম, সরিষা, আলু, চীনাবাদাম ও নানারকম শাকসবজি উৎপাদন হয় এই শিবগঞ্জে। কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত শস্য নিকটস্থ বাজারসহ জেলা শহরে বাজারজাত করে থাকে। তাছাড়া হ্যাচারি, হাস-মুরগি ও গবাদীপশু পালন সহ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে নিয়োজিত আছে শিবগঞ্জের গ্রামীণ জনপদ। অপরদিকে, শহরবাসীদের অধিকাংশই চাকরি, ব্যবসাসহ বিভিন্ন খাতে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তবে, এ এলাকা আম উৎপাদনে দেশ বিখ্যাত। শিবগঞ্জের অর্থনীতির চাকা প্রানবন্ত হয়ে উঠে আম এবং আম বাগানকে কেন্দ্র করে। প্রতি বছর মে হতে জুলাই মাসে আমের মো মো গন্ধে উদ্দিপ্ত হয়ে থাকে গোটা শিবগঞ্জ। কেউ নিজে চাষ করেন আবার কেউ বাগান মালিক হতে লিজ নিয়ে আমের ফলন করেন। কানসাটেই রয়েছে আমের বিখ্যাত বাজার। একে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আম বাজারও বলা হয়ে থাকে। দেশের অধিকাংশ আমের চাহিদা এ বাজার থেকেই পূরন করা হয়। শুধু কানসাটই নয়, সেসময় শিবগঞ্জের প্রায় প্রত্যেক মোড়েই দেখা মিলে আমের আড়ত।

বর্তমানে শিক্ষাখাতে উল্লেখযোগ্য হারে এগিয়েছে শিবগঞ্জবাসী। রয়েছে শিবগঞ্জ কলেজ সহ মোট ১৭টি কলেজ, ৭১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২৩১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৯টি কিন্ডারগার্টেন সহ ৬৪টি মাদ্রাসা।

যোগাযোগ খাতেও এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। শিবগঞ্জ থেকে সরাসরি নওয়াবগঞ্জ-শিবগঞ্জ রোডে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর হয়ে ঢাকা সহ সারাদেশে যাতায়াত করা যায়। রয়েছে মোট ৩৭২ কিলোমিটার পাকারাস্তা, ৫৩ কিলোমিটার আশাপাকা রাস্তা, ৮৬৯ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা সহ ২০ কিলোমিটার নৌপথ। তাছাড়া শিবগঞ্জের শাহাবাজপুর ইউনিয়নে রয়েছে বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম স্থলবন্দর সোনামসজিদ স্থলবন্দর। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে সারা বছর ফলমূল, কয়লা, পাথর, মসলা সহ নানাবিধ কৃষি দ্রব্যাদি সড়কপথে এ বন্দরে আমদানী হয় যা সারাদেশে বাজারজাত করা হয়ে থাকে। ফলে, যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন শিবগঞ্জের অর্থনীতিতেও সমানতালে গুরুত্ব পাচ্ছে।

স্বাস্থ্যখাতেও এসেছে উল্লেখ্যযোগ্য পরিবর্তন। শিবগঞ্জবাসীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়নভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক সহ ছোটবড় ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। গবাদিপশুর স্বাস্থ্যসেবায় নির্মিত হয়েছে উপজেলা প্রাণীসম্পদ ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল। শিবগঞ্জ থানা অঞ্চলের নাগরিকের নানাবিধ সেবাদানে রয়েছে উপজেলাভিত্তিক বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দাপ্তরিক প্রতিষ্ঠান। উপজেলা পরিষদ, শেখ মুজিব ডিজিটাল শিক্ষা ভবন, জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর, ইউনিয়নভিত্তিক ভূমি অফিস, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনসহ নানা আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে শিবগঞ্জে। তাছাড়া খেলাধুলার জন্য নির্মিত হয়েছে শিবগঞ্জ উপজেলা স্টেডিয়াম। শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশে রয়েছে শিল্পকলা একাডেমি।

শিবগঞ্জের কৃতী সন্তান হয়ে আছেন বাংলাদেশ পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক সৈয়দ নুরুল ইসলাম। জন্মগ্রহন করেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা কার্টুনিস্ট ও টোকাই চরিত্রের স্রষ্টা রফিকুন নবী। দেশের ১২তম বিচারপতি মাইনুর রেজা চৌধুরীর জন্মস্থানও এই শিবগঞ্জেই।

এ এলাকা তাঁতশিল্পের জন্য দেশবিখ্যাত। নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়নের হরিনগর গ্রাম রেশম সিল্কের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে বেশ প্রসিদ্ধ। রয়েছে প্রায় ২০০ তাঁতঘর। এ তাঁতপল্লীতে সারাবছর শ্রমিকগণ কর্মব্যস্ততায় মুখরিত থাকে। এখানকার রেশম সিল্কের তৈরি মুসলিম শাড়ির গুনগত মান অতুলনীয়। তাঁতিদের জীবনধারা ও তাদের উৎপাদিত রেশম পন্য আকৃষ্ট করে ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের।

শিবগঞ্জ থানা অঞ্চল মুগল ও সুলতানি স্থাপত্যশিল্পের এক অন্যন্য রত্ন। এখানেই রয়েছে সুলতানী স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম নিদর্শন ছোট সোনা মসজিদ। ১৬শ শতাব্দির শুরুর দিকে হোসেন-শাহ্‌ স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত এ মসজিদটির পাথরে খোদাই মিহি কারুকাজ দেখতে ছুটে আসে নানা পর্যটক। এর পাশেই রয়েছে মোঘল আমলে নির্মিত শাহ্‌ নেয়ামতউল্লাহর মাজার ও শাহ্‌ সুজার তাহখানা কমপ্লেক্স এবং ৩ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। এখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে পঞ্চদশ শতকে নির্মিত গৌড়ের প্রাচীন কৃতীগুলোর অন্যতম খনিয়াদিঘি মসজিদ; যা স্থানীয়ভাবে চামচিকা মসজিদ ও রাজবিবি মসজিদ নামেও পরিচিত। রয়েছে বাংলার প্রথম যুগের মুসলিম স্থাপত্য কীর্তির এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন দারাসবাড়ি মসজিদ।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।