Debidwar

গোমতী নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠা একটি গ্রামীণ জনপদ দেবিদ্বার। বিস্তৃত ফসলী মাঠ, হলুদ সরষে ফুলে চাদরে ঘেরা মায়াময় প্রকৃতি যেন দেবিদ্বারের গ্রামীণ জনজীবনের শাশ্বত রূপ।

এ অঞ্চলের নামকরন নিয়ে লোকমুখে নানা মত প্রচলিত আছে। তবে ধারণা করা হয়, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে দেবীকোটের বানরাজা এ অঞ্চলে জমিদারি শুরু করেন। অষ্টদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, ব্রিটিশ শাসনামলে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন জন ডেভিড নৌবহর নিয়ে গোমতী নদীপথে ঢাকার উদ্যেশ্যে রওনা দেন। তবে এ অঞ্চল দিয়ে যাওয়ার সময় ভিংলাবাড়ি এলাকায় বানরাজার সৈন্যদের সাথে ব্রিটিশ সৈন্যদের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এ যুদ্ধের নাম ডেভিড ওয়্যার নামে পরিচিতি লাভ করে। সেই ডেভিড ওয়্যার থেকে বিবর্তিত হয়ে এ অঞ্চল আজকের দেবিদ্বার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক জনাব নুরেআলম মিনার একনিষ্ঠ কর্মদক্ষতা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে;  কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত আছেন আব্দুল মান্নান বিপিএম বার। তিনি তাঁর কর্মপরায়ণতায় অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে তাঁর যোগ্যতা, নিষ্ঠা ও নৈতিকতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরই নিবিড় তত্ত্বাবধানে দেবিদ্বার সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার শাহ্‌ মোস্তফা তারিকুজ্জামানের আওতাধীন অঞ্চল দেবিদ্বার থানায় অফিসার ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন মোঃ নয়ন মিয়া। কিভাবে চলছে এ অঞ্চলের সার্বিক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি? অপরাধ প্রবণতাই বা কেমন? এসব প্রশ্নের যথার্থ উত্তর নিয়ে সবুজ সংকেতের আজকের আয়োজনে থাকছে, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্রময় অঞ্চল ও দর্শনীয় স্থানসমূহ সহ সকল বিষয়াদি নিয়ে আজকের সবুজ সংকেত – দেবিদ্বার থানা।

ঢাকা থেকে প্রায় ১০২ কিলোমিটার পূর্বাংশে এবং কুমিল্লা জেলা সদর থেকে উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একটি প্রশাসনিক অঞ্চল দেবিদ্বার। এটি মোট একটি পৌরসভা এবং ১৫টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। ইউনিয়নসমূহ হলো বড়শালঘর, ইউসুফপুর, রসুলপূর, সুবিল, ফতেহাবাদ, এলাহাবাদ, জাফরগঞ্জ, উত্তর গুনাইঘর, দক্ষিণ গুনাইঘর, রাজামেহার, ভানী, ধামতী, সুলতানপুর, বরকামতা ও মোহনপুর। ২৩৯ দশমিক ১৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জনপদটিতে ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা ৪ লাখ ৭১ হাজারেরও অধিক। এ বিশাল জনগনের আইনিসেবা সুগমের লক্ষে দেবিদ্বার সার্কেল এর তত্বাবধানে কাজ করে যাচ্ছে দেবিদ্বার থানা পুলিশ। এ অঞ্চলের পূর্ব দিকে কুমিল্লার বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা, পশ্চিমে এবং উত্তরে মুরাদনগর উপজেলা ও দক্ষিণে চান্দিনা উপজেলা গঠিত।

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে দেবিদ্বার অঞ্চলের মানুষদের ছিলো প্রত্যক্ষ ভূমিকা। ৩১শে মার্চ কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষে ৩৩ জন শহিদ হন। ৭ই আগস্ট চরকামতায়, ২৯শে সেপ্টেম্বর জাকেরগঞ্জ সহ ১৪ নভেম্বর থানা সদরে গনহত্যা চালিয়ে হত্যা করে নিরীহ বাঙ্গালীদের, লুটপাট জ্বালিয়ে দেয় ঘরবাড়ি। তবে ঘুরে দাঁড়ায় মুক্তিকামী যোদ্ধারা। ৩ই ডিসেম্বর রাতে কোম্পানীগঞ্জ সেতুটি মাইন বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়। অতঃপর মিত্রবাহিনীর নেতৃত্বে একটি ট্যাংক ব্রাহ্মণপাড়া হয়ে দেবিদ্বারে আসলে হানাদারেরা সে রাতেই কুমিল্লা সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যায়। এভাবেই শত্রুমুক্ত হয় পুরো দেবিদ্বার। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের স্মৃতিচিন্‌হ হিসেবে দেবীদ্বার সদর এলাকার নিউমার্কেটে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা চত্বর।

বর্তমানে অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সমানতালে এগুচ্ছে দেবিদ্বারের অর্থনীতির চাকা। এ অঞ্চলের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি হলেও বিপুল সংখক প্রবাসী থাকায় বৈদেশিক রেমিটেন্স অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ জনপদের কৃষকেরা প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে ধান, গম, সরিষা, ভুট্রা, আলু ও শাকসবজি উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বিশেষকরে দেবিদ্বারের বিভিন্ন এলাকায় পানের বাগান লক্ষ করা যায়। তারা এসব শস্যসামগ্রী নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রয় করে। তাছাড়া, মৎস্য চাষেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এ থানা অঞ্চলের মানুষ। বিভিন্ন জায়গায় মৎস্য খামারে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ মাছ প্রতিদিন স্থানীয় খাদ্য চাহিদা পূরন করে সিলেট, চট্রগ্রাম সহ ঢাকায় বাজারজাত করে থাকে খামারীরা। এছাড়াও সদর এলাকায় বিভিন্ন চাকরি, ব্যবসাসহ নানা খাতে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে দেবিদ্বারবাসী।

বর্তমানে দেবিদ্বার ক্রমশ উন্নততর হয়ে উঠছে। বিশেষ করে, এ অঞ্চলের আইন শৃঙ্খলা স্বাভাবিক থাকায় কুমিল্লা-৪ আসনে নবনির্বাচিত তরুণ সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ বিজয়ী হওয়ার পর থেকেই ব্যপক উন্নতি সাধিত হচ্ছে। তিনি তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে চাঁদাবাজি মুক্ত ও অবৈধ ড্রেজিং বন্ধে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি নির্বাচিত হয়েই এদের সমূলে উৎখাত করে দেশব্যাপী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে দেবিদ্বারে। এ এলাকা দিয়েই বয়ে গেছে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক, যা ঢাকা-চট্রগ্রাম জাতীয় মহাসড়কে মিলিত হয়েছে। ফলে, সড়কপথে ঢাকা থেকে সরাসরি দেবিদ্বারে যাতায়াত করতে পারে এ অঞ্চলের মানুষ। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে নির্মিত হয়েছে ১৪৭ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ১৩ কিলোমিটার আধা-পাকা রাস্তা সহ ৩৩৪ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা। ফলে চিকিৎসাসেবায় দ্রুত সুফল পাচ্ছে দেবিদ্বারবাসী। তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে রয়েছে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও হাসপাতাল সহ ইউনিয়নভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক এবং পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র। গবাদিপশুর সুচিকিৎসায় রয়েছে উপজেলা প্রাণীসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল। এছাড়াও তাদের নানাবিধ প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা কার্যালয়, নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, কৃষি অফিসারের কার্যালয়, হিসাবরক্ষণ অফিসারের কার্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সহ বিভিন্ন আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। এবং শিশু কিশোরদের বিনোদনের জন্য রয়েছে ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী পৌর শিশু পার্ক।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপদ হলেও অসাম্প্রদায়িক এ অঞ্চটিতে হিন্দু মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সম্মিলিত বসবাস। তাদের উপাসনার জন্য রয়েছে উপজেলা মডেল মসজিদ সহ মোট ৪৭১টি মসজিদ ও ২৭টি মন্দির। তন্মধ্যে, গুনাইনগর ইউনিয়নে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মুঘল, তুর্কী ও পারস্যের দৃষ্টিনন্দন ক্যালিগ্রাফিতে নির্মিত মসজিদ বায়তুল আজগর সাতগম্বুজ জামে মসজিদ।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।